‘ভাঙ্গনের গান’ বন্দিত্ব ও উড্ডীনস্পৃহার গল্প

নাগরিক জীবনযাত্রা, টানাপড়েন, সামাজিক বৈষম্য, রাজনৈতিক অস্থিরতার নানা চিত্র ভীষণভাবে ভাবায় চিত্রশিল্পী আলমগীর হোসনকে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 July 2016, 07:54 AM
Updated : 31 July 2016, 07:54 AM

অগ্রগামী সভ্যতায় মারণাস্ত্রের ঝনঝনানি, দাসত্বের কারাগারে বন্দি মানবিক ইচ্ছাগুলোর গুমরে কাঁদা, ক্ষুধার যন্ত্রণা- এমন নানা বিষয় তিনি ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছেন রং-তুলির কারিশমায়।

তার আঁকা সেসব ছবি নিয়েই ধানমন্ডির দৃক গ্যালারিতে চলছে ‘ভাঙ্গনের গান’ শীর্ষক চিত্রকর্ম প্রদর্শনী। ২৯ ‍জুলাই শুরু হওয়া এই প্রদর্শনীটি শিল্পীর তৃতীয় একক প্রদর্শনী।

প্রদর্শনী ঘুরতে এসে চিত্র সমালোচক মঈনুদ্দীন খালেদ বলেন, “আলমগীর যে ভাষায় মানব অস্তিত্বে বন্দিত্ব ও মুক্তির প্রয়াসের বয়ান দিয়েছেন, তা বিষদ ব্যাখ্যার দাবি রাখে। তার ছবিতে প্রধান দ্রষ্টব্য মানুষ, মানুষের দেহ। বলা যায়, মানুষের দেহের ল্যান্ডস্কেপিক পরিচর্যা করতে তিনি অনিবার্যতা অনুভব করেছেন।

“আলমগীরের ছবির তাকালে ‘দাসত্ব ও মুক্তি’ এই শিরোনামটি মনে পড়ে যায়। তার ছবিতে উঠে এসেছে আটপৌরে নাগরিক জীবনের বন্দিত্বের নির্মম ছবি।”

আলমগীরের ছবিতে কখনও মনে হতে পারে, আতঙ্কিত মানব সত্তার স্নায়ুর বিকারের মানচিত্রায়নে মনোনিবেশ করেছেন শিল্পী। রেখার সর্পিল বিজড়ন, কুণ্ডলায়ন থেকে বেরিয়ে এসে শিল্পী এবার নতুন ইমেজের সঙ্গে বোঝাপড়ায় মনোনিবেশ করেছেন।

ডিজিটাল প্রযুক্তির অফুরান অনুদান কাজে লাগিয়েছেন আলমগীর হোসেন। তার ছবিতে ক্রমশ অপরিচিত হয়ে উঠেছে মানুষের দেহ। শিল্পীর ছবিতে সমাজতাত্ত্বিক ও জাতিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যে প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে।

চিত্রশিল্পী আলমগীর কবির সৃজনপ্রয়াসী মানুষের মতো আশৈশব পাঠ করেছেন, দেখেছেন বিচিত্র মৃত্যুর লোমহর্ষক ঘটনা। বেওয়ারিশ লাশ, প্রতিকারহীন সময়, নির্বিকার শিশুহত্যা, শিশুধর্ষণ, নিরপরাধের বলির পাঁঠা হওয়া- এসব নেতিবাচকতাকে আলমগীর তীব্রভাবে কটাক্ষ করেছেন, নিন্দা জানিয়েছেন রং-তুলির আঁচড়ে।

সমালোচক মঈনুদ্দীন খালেদের মতে, “আলমগীরের ছবি তুমুলভাবে জানান দেয় ভরকেন্দ্রহীন মানব অস্তিত্বের অভিব্যক্তি। তার ছবিতে মানুষের মুখ নেই, মানুষকে শনাক্ত করা যায় না। মুণ্ডুহীন মানুষের দেহ প্রলম্বিত হতে হতে আকাশে উঠে গেছে অথবা ডানে-বাঁয়ে সবটুকু স্পেসে প্রবহমান। এক বিশেষ মাংসল জ্যামিতি তৈরি হয়েছে সেই স্পেসে।”

আলমগীরের কাজে স্থানিক ও অংশত কালিক বৈশিষ্ট্য আছে। তার ছবির দিকে তাকালে প্রথমেই মনে পড়বে মেটাফরসিস তত্ত্বের কথা। এই তত্ত্ব বা ভাবনা জানান দেয়, আতঙ্ক দুর্বল হয়ে উঠলে যেকোনো প্রাণই রূপান্তরের পথ বেছে নেয়। কল্পিত বলয়ে নিজেকে সেঁধিয়ে নিরাপত্তা খুঁজে।

বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে তাকালে শিল্পীর এই কাজকে দেহসংস্থানের স্থাপত্য বা হিউম্যান অ্যানাটমির স্থাপত্যিক বয়ান বলেও আখ্যায়িত করা চলে। পরাস্ত-পরিস্থিতির ব্যাকরণে তুষ্ট নন শিল্পী, প্রমিথিউস বা সিসিফাসের উড্ডীন-স্পৃহার সংকেতও আছে তার দেহ-উৎসারিত বর্ণপ্রবাহে। তার চিত্রকর্মে বিমূর্ত হয়ে উঠেছে মানবদেহের স্বভাব-সুলভ বৈশিষ্ট্যের বিপুল রূপান্তর নাটক।

চিত্রশিল্পী আলমগীর হোসেন এর আগে ‘পারসেপশন অফ টাইম’ এবং ‘লাইনস ফ্রম লাইফ’ শিরোনামে দুটি একক চিত্রকর্ম প্রদর্শনী করেছেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে বেশকটি চিত্রকর্ম প্রদর্শনীতে ঠাঁই পেয়েছে তার আঁকা ছবি। বিভিন্ন শাখায় সম্মানসূচক পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি।

৫ অগাস্ট পর্যন্ত প্রতিদিন বিকল ৩টা থেকে রাত ৮টা প্রদর্শনীটি সবার জন্য উন্মুক্ত রয়েছে।