মহাশ্বেতা দেবীর লেখনি যখন সেলুলয়েডে

মহাশ্বেতা দেবী শুধু একজন লেখিকা কিংবা সমাজকর্মী নন, স্বাধীন ভারতের ইতিহাসের ঘটনাবলীর সঙ্গে তার নাম জড়িয়ে রয়েছে ওতপ্রোতভাবে। তিনি দেখেছেন নকশাল আন্দোলনের ভয়ঙ্কর পতন, নিজের কাছ থেকে অনুভব করেছেন নন্দীগ্রামের দাঙ্গায় আহত অসংখ্য মানুষের কষ্ট।

গ্লিটজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 July 2016, 09:20 AM
Updated : 29 July 2016, 09:26 AM

মহাশ্বেতা দেবীর লেখনী ছিল শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদী কণ্ঠ। সে কণ্ঠ দিয়ে তিনি চুরমার করতে চেয়েছেন অসংলগ্নতা আর আগ্রাসী পুঁজিবাদী সমাজের কাঠামোকে। শতবর্ষী হয়ে বেঁচে থাকার বছর দশেক আগেই সে কণ্ঠরোধ হলো, দীর্ঘ এক বছর রোগে ভুগে চলে গিয়েছেন এই কিংবদন্তী নারী ব্যাক্তিত্ব।

মহাশ্বেতা দেবীর লেখা ছোট গল্প কিংবা উপন্যাস শুধু মলাটবদ্ধ কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, ভারতের ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর সাক্ষী এই নিদর্শনগুলো প্রাণ পেয়েছে সেলুলয়েডেও। মহাশ্বেতা দেবীর লেখা অবলম্বনে তেমনই পাঁচটি সিনেমার কথা জেনে নেওয়া যাক-

১.
সাংঘার্শ (১৯৬৮)

ব্রিটিশ ভারতে ফকির এবং সাধুদের দাপট ছিল রীতিমত বিষ্ময়কর। কোম্পানির শাসনের চোখকে ফাঁকি দিয়েই তারা তাদের লুটতরাজ এবং হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে গিয়েছে পরাধীন ভারতবর্ষের বুকে। ইতিহাসের পাতায় যদিও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ফকিরদের অবদান রয়েছে, স্থানীয় ভাবে- বিশেষ করে বেনারসে ফকির এবং সেখানকার সাধু-সন্তদের মধ্যবর্তী বিরোধ ছিল ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়।

এসকল ঘটনাকে মহাশ্বেতা দেবী লিপিবদ্ধ করেছিলেন তার 'লায়লি আসমানের আয়না' গল্পে, আর এই গল্প অবলম্বনে পরিচালক হারনাম সিং রাওউয়ালি নির্মাণ করেন 'সাংঘার্শ' সিনেমাটি। নির্মানশৈলীর নৈপুণ্যে অসাধারণভাবেই তিনি তার সিনেমায় উনিশশতকের ঘটনাবলী দেখাতে পেরেছিলেন। দিলীপ কুমার, ভৈজান্তিমালা অভিনীত এই সিনেমাটি পেয়েছিল দারুণ সাফল্য।

২.
রুদালি (১৯৯৩)

হিন্দু সমাজের জাত বিদ্বেষের অভিশাপকে সবসময়ই আঘাত করেছেন মহাশ্বেতা তার লেখা দিয়ে। উঁচু জাতের কোন পুরুষের মৃত্যুতে ভাড়া করে আনা হতো নিম্ন বর্ণের কোন নারীকে, যিনি সেই পুরুষের মৃত্যুতে অর্থের বিনিময় করতেন অশ্রু বিসর্জন। নিচু বর্ণের এই নারীদের রাজস্থানে ডাকা হতো 'রুদালি' নামে।

এই শিরোনামেই এক রাজস্থানী নারীর দুর্দশার গল্প লিখেছিলেন পদ্মবিভূষণ পদক জেতা এই লেখিকা, যেখানে উঁচু বর্ণের ব্যাক্তিদের রাঙ্গাচক্ষুর কারণে 'রুদালি' নারীকে বিসর্জন দিতে হয় তার ব্যক্তিজীবন। কাল্পানা লাজমি এই গল্পটিকেই বড় পর্দায় রূপ দেন ১৯৯৩ সালে। ভারত থেকে অস্কারে যাবার জন্য অসংখ্য বিদেশি সিনেমার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীতাও করেছিল 'রুদালি'। কেন্দ্রীয় চরিত্রে মানবিক এক অভিনয় দিয়ে সেবার ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার জিতেছিলেন অভিনেত্রী ডিম্পল কাপাডিয়া।

৩.
হাজার চৌরাসি কা মা (১৯৯৮)

সত্তর দশকের কলকাতায় চারু মজুমদারের ইশতেহারের ডাকে নকশালবাড়ি আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল অসংখ্য শিক্ষিত তরুণ। অন্যান্য অনেক তরুণের মত কলেজপড়ুয়া ব্রতিও গিয়েছিল সে আন্দোলনে। কিন্তু বাড়িতে খবর এলো, সে ফিরেছে লাশ হয়ে। লেখাপড়ায় ভাল, আদরের সন্তান ব্রতী নয় বরং হাজার চুরাশি নাম্বার লাশের দায়িত্ব বুঝে নিতে বলা হয় তার মা, সুজাতাকে। নকশালবাড়ি আন্দোলনে ছেলে হারানো এক মায়ের মর্মস্পর্শী এই গল্প লিখেছিলেন মহাশ্বেতা দেবী, তার ‘হাজার চুরাশির মা’ উপন্যাসে। সেই গল্প থেকেই ভারতে ১৯৯৮ সালে নির্মিত হয় 'হাজার চৌরাসি কা মা'। প্রায় ১৮ বছর পর সেলুলয়েডের জগতে ফিরে শোকাহত সেই মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন জয়া বচ্চন। কলকাতায় ষাট থেকে আশির দশকের মধ্যে বামপন্থী নকশালদের আন্দোলনে পুলিশি অত্যাচার এবং গুলিবর্ষণে নিহত হয়েছিল এরকম অসংখ্য তরুণ। গুমোট এই পরিস্থিতির বেদনাবহুল প্রেক্ষাপট পরিষ্কারভাবেই ধরা পড়েছিল জয়া বচ্চনের সুজাতা চ্যাটার্জি চরিত্রটিতে। গোভিন্দ নিহালানি নির্মিত 'হাজার চৌরাশি কা মা' সেবার পেয়েছিল সেরা ভারতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। 

৪.
মাটি মায় (২০০৭)

দীর্ঘ লেখনি জীবনে মহাশ্বেতা দেবী বর্ণপ্রথা নিয়েই লিখেছেন অনেক কিছুই। তেমনি আরেকটি গল্প অবলম্বনে মারাঠি নির্মাতা চিত্রা পালেকার নির্মাণ করেন 'মাটি মায়' সিনেমাটি। নন্দিতা দাসের অনবদ্য অভিনয়ে ফুটে ওঠে সমাজের চাকচিক্যর আড়ালের অন্ধকার দিকটি।

পরিবারের দীর্ঘ সময়ের প্রথা বজায় রাখতেই গোরখোদকের পেশা বেছে নিতে হয় চান্দিকে। কিন্তু সবকিছু বদলে যায়, যখন চান্দির কোলে আসে সন্তান। লাশের কবর খুঁড়তে হাত কাঁপে চান্দির, ছোট শিশুদের মৃতদেহগুলোকে দেখে গা শিউরে ওঠে তার। এদিকে নিজের কাজ ছেড়ে দেবার আকাঙ্খা পোষণ করায় চান্দির উপর নেমে আসে গ্রামবাসীদের অত্যাচার। মৃতশিশুদের সে দুধপান করাচ্ছে, এমন অপবাদ জুটে যায় তার নামে। 'ডাইনি' আখ্যা দিয়ে তার উপর চালানো হয় নির্মম অত্যাচার।

৫.
গাঙ্গর (২০১০)

ভারতকে অগ্রসরবর্তী একটি দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলেও মহাশ্বেতা দেবী এই পরিচয়কে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। সারা ভারত জুড়ে নারী অত্যাচার আর ধর্ষণের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনাগুলো তাকে নাড়া দিত বারবারই। সেরকম এক প্রেক্ষাপট থেকেই তিনি লিখেছিলেন 'চোলি কি পিছে'।

নিজের সিনেমার জন্য এই গল্পটিকেই বেছে নিয়েছিলেন ইতালিয় পরিচালক ইতালো স্পিনেলি। এক ফটোগ্রাফারের ক্যামেরার চোখ খুঁজে নেয় বাঙালি এক মা গাঙ্গরকে, যে বুকের দুধ পান করাচ্ছিলো তার সন্তানকে। এ ছবি পত্র-পত্রিকায় ছাপায় হঠাতই গাঙ্গরের জীবন হয়ে ওঠে নরক। এমনকি পুলিশ স্টেশনে তাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় গণধর্ষণের শিকার হবার জন্য। নারীর প্রতি পুরুষ সমাজের নৃশংসতার গল্প দগদগে ঘা এর মত পীড়া দেয় সিনেমাটিতে।