হুমায়ূন আহমেদ-এর সেরা পাঁচ

তাকে বলা হয় বাংলাদেশের কথার জাদুকর। গল্প আর উপন্যাসে নিজ লেখনির জাদুতে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে পাঠকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। তবে কেবল কালি আর কলমেই নয়, হুমায়ূন তার জাদুর পরশ বুলিয়েছেন রূপালি পর্দাতেও।

গ্লিটজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 July 2016, 12:56 PM
Updated : 19 July 2016, 12:56 PM

শুরুটা হয়েছিল ছোটপর্দার নাটকের জন্য একজন গল্পকার হিসেবেই। আশির দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত ‘এইসব দিনরাত্রি’ ধারাবাহিক নাটক দিয়ে এই পথে যাত্রার শুরু। এরপর ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘নক্ষত্রের রাত’-এর মতো জনপ্রিয় নাটক নির্মীত হয় তার গল্পেই। ১৯৯২ সালের ‘শঙ্খনীল কারাগার’ সিনেমাটির গল্পকারও তিনিই। এই সিনেমার মাধ্যমেই সেরা গল্পকারের জাতীয় চলচ্চিত্রকারের সম্মান অর্জন করেন হুমায়ূন আহমেদ।

ধীরে ধীরে এক ঘন্টার নাটক তৈরীর মাধ্যমে পরিচালনাতেও আসেন তিনি। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৯৪ সালে মুক্তি পায় হুমায়ূন আbহমেদ নির্মীত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমণি’। এরপর একে একে তিনি নির্মাণ করেছেন আরও সাতটি সিনেমা।

কিংবদন্তী এই কথাসাহিত্যিক ও নির্মাতার চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকীতে তার নির্মীত পাঁচটি সিনেমা নিয়ে এবারের আয়োজন।

আগুনের পরশমণি

১৯৯৪ সালের সিনেমা ‘আগুনের পরশমণি’ দিয়ে রূপালি জগতে প্রবেশ ঘটে হুমায়ূন আহমেদ-এর। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধভিত্তিক এই সিনেমার মূল চরিত্রগুলোতে অভিনয় করেছিলেন বিপাশা হায়াত, আসাদুজ্জামান নূর, আবুল হায়াত, ডলি জহুর এবং শিলা আহমেদ।

মুক্তির পরপরই সাড়া ফেলে দেয় সিনেমাটি। ‘আগুনের পরশমণি’র অন্যতম বিশেষত্ব হলো, এতে যুদ্ধের চিত্র সরাসরি না দেখিয়েও যুদ্ধের ভয়াবহতাকে তুলে ধরা হয়েছিল সুচারুরূপে।

বাংলাদেশ সরকারের অনুদানের ছবি ‘আগুনের পরশমণি’ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ আটটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে।

শ্রাবণ মেঘের দিন

১৯৯৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত দ্বিতীয় চলচিত্র। তারই লেখা উপন্যাস অবলম্বনে নূহাশ চলচ্চিত্রের ব্যানারে ছবিটি নির্মাণ করা হয়।

সিনেমার গল্প এগিয়েছে ভাটি অঞ্চলের এক গ্রামের গায়ক মতিকে কেন্দ্র করে। মতির প্রতি গোপন প্রণায়সক্ত কুসুমের জীবনে আঁধার নেমে আসে যখন, ঢাকা থেকে আসা জমিদারের নাতনি শাহানার প্রেমে পড়ে মতি। ওদিকে কুসুমের সঙ্গে বিয়ে দিতে উজান থেকে সুরুজকে খুঁজে নিয়ে আসে তার বাবা।

হুমায়ূন আহমেদ নির্মীত সবচেয়ে জনপ্রিয় ও ব্যবসা সফল সিনেমা এটি। সিনেমায় মতির চরিত্রে জাহিদ হাসান ও কুসুম চরিত্রে মেহের আফরোজ শাওন-এর অভিনয় দারুন প্রশংসিত হয়। তবে সিনেমাটি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ওঠে সুবীর নন্দীর কণ্ঠে গাওয়া ‘এক যে ছিল সোনার কন্যা’ গানটির দৌলতে। এই সিনেমার জন্যও সেরা গল্পকার এবং সেরা গীতিকারের পুরস্কার অর্জন করেন হুমায়ূন আহমেদ।  

শ্যামল ছায়া

২০০৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই সিনেমাটিও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের উপর ভিত্তি করে নির্মিত।এই ছবিটি ২০০৬ সালে "সেরা বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র" বিভাগে একাডেমি পুরস্কার এর জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানি হানাদারদের কবল থেকে বাঁচতে শহর, গ্রাম থেকে দিগ্বিদিক পালাতে শুরু করে বহু মানুষ। নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ওই সময় ধর্ম, বর্ণ, জাত, শ্রেণি নির্বিশেষে সবাই নেমে এসেছির এক কাতারে। এমনই একদল মানুষের নৌকাযোগে পালানোর গল্প নিয়ে নির্মীত হয়েছে সিনেমাটি। সিনেমার শেষদিকে দেশের ডাকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে আপাতদৃষ্টিতে নিরিহ, সহায়হীন এইসব সাধারণ মানুষই।

সিনেমাটিতে অভিনয় করেছিলেন রিয়াজ, মেহের আফরোজ শাওন, স্বাধীন খসরু, চ্যালেঞ্জার সহ আরও অনেকে। সিনেমার শেষ অংশে ছদ্মবেশী মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের চরিত্রে অতিথি হিসেবেও দুর্দান্ত অভিনয় করেছিলেন প্রয়াত  অভিনেতা হুমায়ূন ফরীদি।

দুই দুয়ারী

মরণব্যাধি এইডসকে উপলক্ষ্য বানিয়ে সম্পূর্ণ পারিবারিক এই ছবিটিতে হুমায়ূন আহমেদ তুলে ধরেছেন একজন ‘রহস্য মানবে’র মন ভালো করার কিছু রহস্যের ঘটনা। ছবিতে নাম ভুমিকায় অভিনয় করেন অভিনেতা রিয়াজ।

সিনেমার অন্য দুই প্রধান চরিত্রে অভিনয় করছেন মেহের আফরোজ শাওন ও মাহফুজ আহমেদ। হাস্য রসাত্মক নানা ঘটনার প্রবাহে এইডস-এর মতো ব্যাধির ভয়াবহতাকে তুলে ধরেন নির্মাতা।  

ঘেটু পুত্র কমলাঃ

এটি হুমায়ূন আহমেদ নির্মিত সর্বশেষ চলচ্চিত্র। সিনেমাটি আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তির আগেই যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরের একটি হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তবে এর আগে একমাসের জন্য দেশে ফিরে ২০১২ সালের মে মাসের ৩০ তারিখে তিনি ছবিটি দেখে যেতে পেরেছিলেন। এ সময় তিনি এ চলচ্চিত্রটি টেলিভিশনে মুক্তি না দিয়ে প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শনের কড়া নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

হুমায়ূন আহমেদ তার বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন লেখায় এই সিনেমাটি তৈরির ইচ্ছা প্রকাশ করে গেছেন। দেড় শতাব্দী আগের জমিদারী প্রথার বাংলায় বিত্তবান পরুষদের কুরুচিপূর্ণ যৌনলালসার শিকার কিভাবে হতো ‘ঘেঁটুগান’-এর শিশুরা, সেটাই এই সিনেমার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন হুমায়ূন।

সিনেমাটিকে হুমায়ূন আহমেদ-এর নির্মাতা জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ হিসেবে বিবেচনা করেছেন অনেকেই। পরের বছর এই সিনেমার জন্যই সেরা নির্মাতা এবং সেরা চিত্রনাট্যকারের মরণোত্তর পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। ৮৫তম অস্কার প্রতিযোগিতায় ‘সেরা বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র ’ বিভাগের জন্য বাংলাদেশ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল এই সিনেমাটিকেই।