‘অস্তিত্ব’: ভালো গল্পের ভালো সিনেমা

চকচকে ট্রেইলার এবং নাচে-গানে ভরপুর সিনেমা নির্মাণ শিখেছি আমরা আরও আগেই। তবে ভালো গল্প কিংবা পরিচালনায় দক্ষতার অভাব যাদের হতাশ করেছে এতদিন, তাদের জন্য ‘অস্তিত্ব’ এনেছে সুখবর।

জেনিফার ডি প্যারিসবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 May 2016, 12:04 PM
Updated : 17 May 2016, 12:04 PM

ছোটপর্দা মাতানো অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশা প্রথমবার অভিনয় করছেন কোনো বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রে। তিশার বিগত কাজগুলোর ওপর আস্থা থেকেই ‘অস্তিত্ব’র প্রতি দর্শকের আগ্রহ ছিল বেশি। আবার তিশার সঙ্গে জুটি বাঁধবেন তরুণীদের ‘আই ক্যান্ডি’ আরিফিন শুভ। সবমিলিয়ে এই জুটির রসায়ন নিয়ে আলাদা একটা আগ্রহ ছিলই।

সিনেমাটি দেখে পয়সা উসুল হয়েছে পুরোদমে। প্রায় আড়াই ঘন্টা সিনেমা হলে বসে থেকে বিরক্ত হওয়ার বদলে দর্শককে ভালো কিছু সময় উপহার দিতে সক্ষম হয়েছেন পরিচালক অনন্য মামুন।

‘অস্তিত্ব’র গল্প গড়ে উঠেছে মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে, যেখানে সামাজিক সচেতনতার আলাদা বার্তা থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে সচেতনতামূলক একঘেয়ে কোনো প্রামাণ্যচিত্র মনে হবে না সিনেমাটিকে, বরং গল্পে গল্পে দর্শকের মনের অনেক অনুভূতিকেই নাড়া দিয়ে যাবেন পরিচালক।

সিনেমার শুরুর অংশটা যদিও দর্শকের মনে জাগাবে সেই পুরনো হতাশা, এবারও বুঝি ধুম-ধাড়াক্কা আর ফালতু কিছু সংলাপ কপচানো দেখতে হবে! কিন্তু বিরক্তি নিয়ে উঠে যাওয়ার আগেই তাদের আবার টেনে বসাবে সিনেমাটির গল্প।

শুরুর দিকে দেখান তিশার ছোট ভাইয়ের সঙ্গে তার সহপাঠিনীর প্রেমের দৃশ্য এবং একটি গানকে পুরোপুরি বাহুল্য মনে হয়েছে সিনেমাটির জন্য। নবাগত শিল্পীদের জড়তা এবং চিত্রায়নের অদক্ষতা ভালো প্রযুক্তির ক্যামেরা দিয়েও ঢাকা যায়নি।

পুরো সিনেমাটির গল্প গড়ে উঠেছে মূলত শ্রীমঙ্গলে, যাকে বর্তমান বাংলা সিনেমার নতুন চল বলা যায়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে ফ্রেমবন্দী করতে গিয়ে অনেক সময় সেই এলাকার মানুষের সঙ্গে কলাকুশলীদের পোশাক কিংবা জীবনযাত্রা কোনটারই মিল রাখতে পারেন না নির্মাতারা, এক্ষেত্রেও হয়েছে তাই।

অবশ্য অবাস্তবতা কিংবা হুলুস্থুলের পালা ওখানেই শেষ, বাকি অংশে চোখে পড়বে যথেষ্ট যত্নের ছাপ। গল্পের বিভিন্ন দিকে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন পরিচালক। যেমন মানসিক প্রতিবন্ধীর স্কুলে তিশা আগমন, সবার মধ্যে থেকেও একটু আলাদা হয়ে থাকা। বিভিন্ন সময়ে ছোট ছোট অনেক ধরণের বিষয় গল্পটিকে শেষ পর্যন্ত আকর্ষণীয় করে রেখেছে। বরাবরের মতো এই বাংলা সিনেমাটির শেষ পরিণতি কী হবে, দর্শক এত সহজে ধরতে পারবেন না।

‘অস্তিত্ব’-এর গল্পের একটি লক্ষ্য ছিল; কাহিনিকেও সেই অনুযায়ী ঢেলে সাজান হয়েছে সুন্দরভাবে। প্রতিটি পরত ধীরে ধীরে দর্শকের চোখের সামনেই তৈরি হবে, ফলে আগ্রহ বজায় থাকবে। সিনেমার প্রধান চরিত্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা যায়, ফলে বলা যায় নির্মাতা হিসেবে এবার সার্থক অনন্য মামুন।

সিনেমাটির গল্প অনুযায়ী কলাকুশলী নির্বাচন ছিল একদম সঠিক। ২০ বছর বয়সী মানসিক প্রতিবন্ধী মেয়ে পরীর চরিত্রে মনে হয় তিশা ছাড়া আর কাউকে এত ভাল মানাত না। আবার একই সঙ্গে দুর্ধর্ষ এবং মমতাময় শিক্ষক ইনতুর চরিত্রে যেন খাপে খাপে মিলে গেছেন শুভ।

অভিনয় দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করে এরমধ্যেই আলাদা আলাদা ভক্তশ্রেণী গড়ে উঠেছে শুভ এবং তিশা দুজনেরই। একজন ধৈর্য্যশীল শিক্ষকের চরিত্রে শুভ দশে দশ। তেমনই প্রতিবন্ধী তরুণী হিসেবে তিশার অভিনয় আরও একবার মুগ্ধতা ছড়াল।

একজন প্রতিবন্ধীর সঙ্গে তার শিক্ষকের প্রেম, এমন সম্পর্ক সচরাচর দেখা যায় না। এই ব্যাপারটি মাথায় রেখে তাদের সম্পর্ক গড়ে ওঠার পুরো গল্পটি দর্শককে দেখিয়েছেন পরিচালক। ফলে শুভ-তিশার রসায়ন এই সিনেমার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ, যা দর্শকের হৃদয়কে ছুঁয়ে যাবে।

পরীর মা হিসেবে বর্ষীয়ান অভিনেত্রী সুচরিতাও ছিলেন পরিমিত, কারও অভিনয়ে চোখে পড়েনি বাড়তি কোন আড়ম্বর। এমনকি সাবলীলভাবে অভিনয় করেছে কয়েকজন প্রতিবন্ধী শিশুও।

গল্প, চিত্রনাট্য, অভিনয় আর পরিচালনায় মুন্সিয়ানার ছাপ থাকলেও, চিত্রগ্রহণে আনাড়িপনা চোখে পড়েছে অনেক বেশি। শ্রীমঙ্গলের সবুজ সৌন্দর্য আরও ভালভাবে ধারণ করা সম্ভব ছিল। তবে সম্পাদনার দিক থেকে পুরোপুরি ব্যর্থ ‘অস্তিত্ব’। অদক্ষ সম্পাদনা কীভাবে একটি ভালো সিনেমাকে নষ্ট করে দিতে পারে, তার জ্বলন্ত প্রমাণ সিনেমাটি। গল্পের বিভিন্ন মোড়ে দৃশ্যের এত দ্রুত পরিবর্তন অনেক সময়ই দর্শককে বিভ্রান্ত করবে।

‘অস্তিত্ব’ কোনো গতানুগতিক ধারার গল্প নিয়ে নির্মিত নয়, কিন্তু এরপরও বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের সব রকমের মশলা পরিচালক এতে রেখেছেন। সিনেমার প্রতিটি গান শ্রুতি মধুর এবং দেখতেও সুন্দর।

বিভিন্ন সময়ে গল্পের ফাঁকে ফাঁকে দেখান গানগুলো কিন্তু খাপছাড়া মনে হয়নি মোটেও। আর ‘আইটেম’ গান মানেই যে খোলামেলা পোশাক নয়, তাও যেন নির্মাতা বুঝিয়ে দিলেন তিশার কালো পালাজ্জো এবং কোট পড়া নাচ দিয়ে।    

পরিচালক অনন্য মামুনকে যারা ‘ব্ল্যাকমেইল’-এর মাধ্যমে চেনেন, তারা ‘অস্তিত্ব’ দেখে যারপরনাই অবাক হবেন। কারণ হিন্দি সিনেমা ‘গুন্ডে’র হুবহু নকল ‘ব্ল্যাকমেইল’ নির্মাণ করেছেন যে পরিচালক, তার হাতে ‘অস্তিত্ব’র মতো চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্ভব, এটা অবাক হওয়ার মতো ব্যাপারই বটে!

একটি কথা না বললেই নয়, টাকার অভাবে প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও অনেক নির্মাতাই নাকি চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারেন না, এই অভিযোগ নতুন নয়। কিন্তু প্রযোজনার বিনিময়ে সিনেমায় বিজ্ঞাপনের মাত্রা দিন দিন এতটাই ছাড়িয়ে যাচ্ছে, যা দেখলে মনে হতে পারে সিনেমা নয়, আমরা বিজ্ঞাপন দেখতে এসেছি।

সব মিলিয়ে বলা যায়, ‘কৃষ্ণপক্ষ’র পর এবছর মুক্তি পাওয়া ভালো সিনেমাগুলোর মধ্যে সহজেই রাখা যায় ‘অস্তিত্ব’কে। হলিউড কিংবা বলিউডপ্রেমীদের মন জয় করার জন্য এখনও আরও অনেক খাটতে হবে আমাদের নির্মাতাদের। তবে নির্মাতা হিসেবে অনন্য মামুনের ভুল-ত্রুটি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা লক্ষ্য করা যাবে এই সিনেমায়।