‘আইসক্রিম’-এর স্বাদ ভালোই

তীব্র গরমে হিম হিম আইসক্রিম খেতে কে না পছন্দ করে! কিন্তু নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রাখতে না পারলে তা গলে যাবে নিমিষেই। ঠিক তেমনই প্রতিটি সম্পর্কের কিছু সীমারেখা থাকে, এর বাইরে পা রাখলে সম্পর্কের আর মূল্য থাকে না।

জেনিফার ডি প্যারিসবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 May 2016, 07:37 AM
Updated : 6 May 2016, 07:47 AM

একটি গতানুগতিক ত্রিভুজ প্রেমের গল্প নিয়ে নির্মিত সিনেমার নাম ‘আইসক্রিম’ কেন রাখা হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। রূপক অর্থে এর জবাব দেয়ার চেষ্টা করেছেন পরিচালক রেদওয়ান রনি; কিন্তু তাতে ঠিক কতখানি সফল তিনি?

টিভি নাটকে জনপ্রিয়তা পাওয়ার পাশাপাশি ‘চোরাবালি’র মাধ্যমে বড়পর্দায়ও হাত পাকিয়েছেন রনি, দীর্ঘদিন পর ফিরলেন ‘আইসক্রিম’ নিয়ে। পোস্টার, টিজার এবং ট্রেইলার— তিনটিই ইঙ্গিত করেছে বড় শহরের তিন যুবক-যুবতীর মধ্যেকার গল্প ‘আইসক্রিম’, যা শুরুতেই সিনেমাটির জন্য দর্শকের নির্দিষ্ট করে দেয়।

‘আইসক্রিম’র গল্প গড়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণী প্রিয়তাকে ঘিরে, যার প্রেমিক ইতোমধ্যেই পড়াশুনার পাঠ চুকিয়ে চাকরি করছেন। তাদের প্রেম চলছিল ভালোভাবেই, হঠাৎ তাদের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়ায় আরেক যুবক নাদিম।

গল্পতে নতুনত্ব না থাকলেও আকর্ষণ ছিলো, তবে পুরো কাহিনি ঘুরে বেড়িয়েছে এই তিন চরিত্রের মধ্যেই। গল্পের দুর্বলতা ধরতে গেলে বলা যায়, প্রধান চরিত্রগুলোর জীবনের সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য চরিত্রদের একেবারেই গুরুত্ব দেননি পরিচালক। ত্রিভুজ প্রেমের জটিলতা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি আশপাশের অনেক বিষয়কে এড়িয়ে গেছেন, যা গল্পকে করতে পারতো আরও শক্তিশালী।   

প্রধান কলাকুশলীদের তিনজন ছিলেন উদয়, টুশি এবং রাজ, যারা প্রত্যেকেই নতুন মুখ। এছাড়া খুবই স্বল্প পরিসরে পর্দায় দেখা গেছে অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান, ওমর সানি এবং প্রয়াত চিত্রনায়িকা পারভিন সুলতানা দিতিকে।

টুশি অর্থাৎ নায়িকা প্রিয়তার নানার চরিত্রে অভিনয় করেছেন এটিএম শামসুজ্জামান। তার চরিত্রের সঙ্গে দর্শকের পরিচয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুরনো বাংলা সিনেমার মতো করে তিনি গড়গড় করে বলতে থাকেন প্রিয়তার বাবা-মায়ের ইতিহাস, যা বাস্তব সম্মত মনে হয়নি।

বলা হয়েছিল, স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদের অনেক বছর পর আমস্টারডাম থেকে মেয়ে প্রিয়তার খোঁজ নিতে চাইছেন বাবা। এরপর অনেকেই হয়তো পরের কোন দৃশ্যে প্রিয়তার বাবার আগমনের অপেক্ষায় থাকবেন, কিন্তু কোন উপসংহার ছাড়াই শেষ হয়ে যায় মা মরা মেয়ে প্রিয়তার বাবার উপস্থিতি।

এমন আরও কয়েকটি ছোট ছোট গল্প তৈরির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল সিনেমাজুড়েই, কিন্তু মূল গল্পের চাপে পরিণতি পায়নি একটিও। এদিকে প্রিয়তাকে ঘিরে গল্প গড়ে ওঠার কারণে তার দুই নায়কের পারিবারিক তথ্য সম্পর্কে জানা যায় না প্রায় কিছুই।

যদিও তিন জন মানুষের জীবনের একটি নির্দিষ্ট এবং জটিল সময়ের গল্প বলা হয়েছে এখানে, কিন্তু তাদের জীবনের সঙ্গে জড়িত কারও হদিস ঠিকমতো দিতে পারেননি পরিচালক। প্রিয়তার প্রেমিকের মায়ের চরিত্রে শুধু দুটি দৃশ্যে পর্দায় এসেছেন দিতি, তার চরিত্রটি আরও শক্তিশালী হতে পারত।

প্রিয়তার একমাত্র পরিবারের সদস্য, তার ‘বয়ফ্রেন্ড’কে নানার সঙ্গে প্রয়োজনীয় কয়েকটি হাতে গোনা দৃশ্য ছাড়া আর কিছু দেখা যায়নি। প্রিয়তার আংটি পড়ানোর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল না দুই পরিবারের অন্য কোন আত্মীয়-স্বজন। দৈনন্দিন জীবনে ঘনিষ্ঠ না হলেও বিয়ে-শাদিতে ঘরভর্তি পরিবার-পরিজন না থাকাটা বাঙালি ঐতিহ্যের বিপরীতই বলা চলে। 

প্রিয়তার সঙ্গে নাদিমের পরিচয়ের ব্যাপারটিতেও কিছুটা তাড়াহুড়া লক্ষ্য করা যায়। ফেইসবুকে হঠাৎ কোন সুন্দরীর প্রোফাইল দেখে বন্ধু হওয়ার প্রস্তাব দিয়ে বসে অনেক ছেলেই। কিন্তু যখন মেয়েটি তার প্রস্তাব গ্রহণ করে না আর দশজনের মতোই, তখন তার চেহারা আলাদাভাবে মনে থাকার কথা নয়। কিন্তু একদিন সশরীরে ছেলেটিকে দেখে প্রিয়তা কীভাবে তাকে একবারেই চিনতে পারলো, তা ব্যাখ্যা করেননি পরিচালক।

যেহেতু তিন প্রধান চরিত্রের ব্যক্তিগত জীবনের উপর নজর দিয়েছেন পরিচালক, তাই তাদের বন্ধুদের চরিত্রগুলো প্রাধান্য পেয়েছে বেশি। বিজ্ঞাপনী সংস্থার কর্মী প্রিয়তার প্রেমিকের সঙ্গে তার সহকর্মী-বন্ধুদের কথোপকথন দর্শককে আনন্দ দেবে, নাদিমের চরিত্র গঠনের বেলায়ও তার বন্ধুর সংলাপ ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রাণোচ্ছল একটি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়ে প্রিয়তা, যে কীনা একজন আলোকচিত্রীও, তার বন্ধুদের উপস্থিতির কিছুটা হলেও প্রয়োজন ছিল।

আধুনিক প্রেক্ষাপটের গল্প, কিন্তু সম্পর্কের এই জটিলতা এবং প্রিয়তার আত্মদ্বন্দ্ব মোটেও নতুন নয়। ত্রিভুজ প্রেমের এই টানাপোড়েনে যুগের পর যুগ ভুগেছেন অনেক প্রেমিক-প্রেমিকা, প্রতিবার গল্পের ইতিও একই রকম হয় না। তাই গল্পের শেষটা পর্যন্ত আশায় বুক বেঁধে দর্শক অপেক্ষা করবেন, এরপর কী হয় জানার জন্য। সেদিক থেকে গল্পের গাঁথুনি চমকপ্রদ না হলেও চিত্রনাট্য যুগিয়েছে বিনোদনের খোরাক।

শুধু চিত্রনাট্যের কারণেই নয়, নেপথ্য সংগীত, চিত্রগ্রহণ এবং সর্বোপরি শিল্পীদের বাস্তব সম্মত অভিনয়ে চোখে পড়েছে দর্শক ধরে রাখার প্রচেষ্টা।

ট্রেইলারে যৌন দৃশ্যের অবতারনা চোখে পড়লেও সিনেমাতে সম্ভবত সেন্সরের কাঁচি চলেছে। যার ফলে চোখে পড়েনি অনেক কিছুই। তবে সমঝদারদের জন্য ইশারাতেই অনেক কিছু বুঝিয়েছেন পরিচালক।

আসা যাক অভিনয় প্রসঙ্গে। ‘আইসক্রিম’-এ অভিনয় করেছেন নতুন তিন শিল্পী, যাদের অভিনয়ের অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে। কিন্তু এই সিনেমা তাদের দেখে তা মনে হবে না কারও। নতুন হিসেবে অভিনয়ের পরীক্ষায় বেশ ভালোভাবেই উতরে গেছেন তিন জন।

প্রিয়তার চরিত্রে রূপদান করেছেন ‘লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার ২০১৪’ তারকা নাজিফা টুশি। ব্যক্তিগত জীবনেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হওয়ায় তার অভিনয়ে ছিল সাবলীলতা। অচেনা এক পুরুষের মিষ্টি কথা যে সহজেই ভুলিয়ে দিতে পারে এক নারীর মনকে, তা বেশ ভালোভাবেই উপস্থাপন করেছেন টুশি।

একদিকে তার প্রেমিক, যার মধ্যে সেই সব গুণাবলী আছে যা কোনো নারী চায়। আবার অপরদিকে নাদিমের পাগল প্রেমের নিষিদ্ধ আকর্ষণ। দুইয়ের মাঝে অন্তর্দ্বন্দ্বে পিষ্ট হওয়া দ্বিধান্বিত প্রিয়তার চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টার কার্পণ্য করেননি টুশি, তা বোঝা গেছে তার অভিনয়ে।

শান্ত, ক্ষমাশীল এবং দায়িত্ববান প্রেমিকের চরিত্রে অভিনয় করেছেন উদয়, প্রিয়তার জন্য যার ভালোবাসার সীমা নেই। তার চরিত্রে আবেগ অনেক আবেগী হলেও সবসময় সব আবেগ ফুটিয়ে তুলতে পারেননি তিনি। তবে সংলাপ এবং চরিত্রের গভীরতার কারণে উতরে গেছেন এই অভিনেতা।

তিন জনের মধ্যে সবচেয়ে ভাল অভিনয় করেছেন যিনি, তিনি হলেন শরিফুল রাজ। যাকে দেখা গেছে নারী ভোলানো ছলনাময় যুবক নাদিমের চরিত্রে। নিজের প্রেমিকা থাকলেও তার অগোচরে অন্য মেয়েদের সঙ্গে ছলনা করেই সময় কাটে তার।

এভাবেই একদিন প্রিয়তার সঙ্গে তার পরিচয় হয়, এক পর্যায়ে সে প্রিয়তার প্রেমে পড়ে। তবে প্রিয়তার দ্বিধা এবং প্রত্যাখ্যান তার আত্মসম্মানে আঘাত হানে এবং সেই প্রেম ধীরে ধীরে রূপ নেয় জেদে।

‘আইসক্রিম’র সবচেয়ে শক্তিশালী চরিত্র বলা চলে নাদিমকে। শুরু থেকে প্রিয়তার পেছন পেছন ঘুরে তার মন জয় করা, এরপর প্রত্যাখ্যানের অপমানের প্রতিশোধ— চরিত্রটির উত্থান থেকে পতন সবটুকুতে নিজের পুরোটা ঢেলে দিয়েছেন রাজ। কিন্তু হতাশা! তার চরিত্রের সঙ্গে ন্যায়বিচার করতে পারেননি পরিচালক।

ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যের পর বলতে গেলে হঠাৎ করেই শেষ হয়ে যায় নাদিমের চরিত্র। ঠিকমতো দর্শককে বিদায় জানানোর সুযোগটাও দেয়া হয়নি তাকে। যার কারণে প্রিয়তা এবং তার প্রেমিকের মধ্যে এতো জটিলতা, তাকে পর্দা থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে হঠাৎ করেই।

পুরো সিনেমায় সংলাপের ক্ষেত্রে ‘খাইসো’, ‘করসো’-- এরকম শব্দের ব্যাপক ব্যবহার রেদওয়ান রনির নাটকের কথা মনে করিয়ে দেবে অনেককেই। তবে, সম্পাদনার বেলায় পাওয়া গেছে দক্ষতার পরিচয়।

‘আইসক্রিম’র চিত্রগ্রহণ আলাদাভাবে প্রশংসার দাবীদার। প্রাকৃতিক আলোর ব্যবহার, উপর থেকে নেওয়া রাতের শহরের দৃশ্য এবং ক্লাইম্যাক্সের সময়ের কিছু দৃশ্য ধারণ করা হয়েছে চমৎকারভাবে।

সংগীতের ব্যাপারে বলা যায়, এই সিনেমাতে আলাদাভাবে নায়ক-নায়িকার নাচানাচি দেখতে এলে হতাশ হতে হবে দর্শককে। কিন্তু স্বল্প পরিসরের প্রতিটি গান রাখা হয়েছে ঘটনার সঙ্গে মিল রেখেই। এর মধ্যে অর্ণব এবং চিরকুট ব্যান্ডের গানদুটি ছিল আলাদাভাবে মনে রাখার মত।

‘আইসক্রিম’ সিনেমাটি মূলত নির্মাণের ক্ষেত্রে নিজের ভক্তমহলকেই গুরুত্ব দিয়েছেন পরিচালক। বাণিজ্যিক ঘরানার মশলাদার নাচ-গানে ভরপুর কোনো সিনেমা নয় ‘আইসক্রিম’, যা ঢালাওভাবে সব শ্রেণির দর্শকের ভাল লাগবে।

বরং ‘আইসক্রিম’ বলেছে শহুরে যুবক-যুবতীদের আধুনিক প্রেমের জটিলতার গল্প, যাকে বাস্তবতার এক টুকরো ছবি বলা যায়। এখানে নাচ-গান নয়, বরং চিত্রনাট্য এবং অভিনয়ই আসল মসলা। আর তাই, গ্রাম কিংবা মফস্বল নয়,বাংলাদেশের বড় শহরগুলোর বাসিন্দাদের মধ্যে গড়ে ওঠা সিনেমাপ্রেমী সমাজকেই কেবল তুষ্ট করতে পারবে সিনেমাটি।