‘মাদার ইন্ডিয়া’ ও একটি প্রেমকাহিনি

সিনেমার শুটিং চলছে একটি গ্রামের ভিতর। খড়ের গাদায় আগুন লেগেছে। জ্বলছে পুরো গ্রাম। সেই আগুনের ভিতর দিয়ে ছুটে আসছেন সিনেমার প্রধান অভিনেত্রী।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 May 2016, 10:53 AM
Updated : 4 May 2016, 10:34 AM

ক্যামেরায় যখন এই দৃশ্য ধারণ হচ্ছে তখন হঠাৎ করেই বাতাসের গতি পাল্টে যায়। আগুন ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং চলে যায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে। প্রধান অভিনেত্রী আটকে পড়েন আগুনের বৃত্তে। হইচই পড়ে যায় ইউনিটে।

কেউ সাহস পান না তাকে উদ্ধার করার। এমন সময় নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আগুনের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন ছবিটির অন্যতম প্রধান অভিনেতা। বাঁচান নায়িকাকে। কিন্তু নিজে আহত হন। হাসপাতালে যেতে হয় তাকে। কৃতজ্ঞ নায়িকা সেবা করেন তার। তারপর দুজনের মধ্যে জন্ম নেয় প্রেম।

এটি কোনো সিনেমার গল্প নয়। এটি হলো হিন্দি ছবির কিংবদন্তি অভিনেত্রী নার্গিস এবং বিশিষ্ট অভিনেতা সুনীল দত্তের জীবনের ঘটনা। ‘মাদার ইন্ডিয়া’ ছবির শুটিংয়ে এই ঘটনা ঘটে। যে সিনেমায় তারা অভিনয় করেছিলেন মা ও ছেলের ভূমিকায়!

‘মাদার ইন্ডিয়া’ ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৫৭ সালের ২৫ অক্টোবর। এপিকধর্মী এই ছবিতে অভিনয় করেন নার্গিস, রাজকুমার, সুনীল দত্ত ও রাজেন্দ্রকুমার। ‘বলিউড-মোগল’ মেহেবুব খানের এই ছবি শুধু নার্গিসের ক্যারিয়ারে সর্বশ্রেষ্ঠ কাজই নয়, হিন্দি ছবির শতবর্ষের ইতিহাসেরও এক মাইলফলক এটি।

১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর দেশপ্রেমমূলক ছবি তৈরির হিড়িক পড়ে বলিউডে। প্রযোজক-পরিচালক মেহেবুব খান পরিকল্পনা করেন তিনি ভারত-মাতা বা দেশমাতৃকার রূপ তুলে ধরবেন রূপকের মাধ্যমে। তিনি যখন শ্বাশত ভারতীয় নারীর আত্মত্যাগ ও মহিমা রুপালি পর্দায় চিত্রিত করার পরিকল্পনা করেন তখন নার্গিস ছিলেন হিন্দি ছবির জগতে শীর্ষস্থানীয় নায়িকা। স্বাভাবিকভাবেই তাই ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র রাধার ভূমিকায় তার নামই প্রস্তাবিত হয়।

সে সময় নার্গিসের সঙ্গে আরেক কিংবদন্তি চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব রাজ কাপুরের প্রেম চলছে। কিন্তু দশ বছর ধরে চলা সেই প্রেমের পরও বিবাহিত রাজ কাপুরের জীবনে দ্বিতীয় নারী হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল নার্গিসকে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে টানাপোড়েন চলছিল।

‘মাদার ইন্ডিয়া’ ছবির গল্প আবর্তিত হয় রাধা নামে এক দরিদ্র ভারতীয় নারীর জীবনকে ঘিরে। রাধা এক গ্রামীণ গৃহবধূ। দরিদ্র হলেও তার সুখের সংসার। স্বামী শামু (রাজকুমার) এবং চার সন্তানকে নিয়ে তার জীবন। কিন্তু কৃষক শামু দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে পড়লে তার জীবনে অমানিশা ঘনিয়ে আসে। নিজের পঙ্গুত্বকে সংসারের বোঝা বলে মনে করে একদিন গৃহত্যাগ করে শামু। স্বামী পরিত্যক্তা সুন্দরী রাধার দিকে লোভের হাত বাড়ায় গ্রামের ধনী মহাজন। শত অভাব, অনাহার সত্ত্বেও মহাজনের কুপ্রস্তাবে রাজি হয় না রাধা। তার ছোট দুটি সন্তানের অকাল মৃত্যু ঘটে। দুই কিশোর ছেলে রামা ও বিরজুকে নিয়ে কৃষিকাজ চালিয়ে যায় রাধা।

এই ছবির একটি স্মরণীয় দৃশ্য হলো, গরুর পরিবর্তে ভারবাহী পশুর মতো রাধা নিজেই লাঙল টানার মুহুর্তটি। দুই ছেলে বড় হয়। রামা (রাজেন্দ্রকুমার) শান্ত ও বাধ্য হলেও প্রতিবাদী বিরজু (সুনীল দত্ত) হয়ে ওঠে ডাকাত। অন্যায়ের প্রতিবাদে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া ডাকাত সন্তানের সঙ্গে সংঘাত বাধে নীতিনিষ্ঠ মায়ের। শেষ পর্যায়ে বিরজুকে নিজে হাতে গুলি করে মারে মা রাধা।

বিরজুর ভূমিকায় প্রথমে দিলিপ কুমারের কথা ভাবা হয়। কিন্তু দিলিপ কুমার এর আগে অন্য ছবিতে নার্গিসের বিপরীতে রোমান্টিক ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। দর্শক হয়তো মা-ছেলে রূপে তাদের দেখতে চাইবে না। তাই আনকোরা ও অপরিচিত অভিনেতা সুনীল দত্তকে বেছে নেওয়া হয়।

সুনীল দত্ত ছিলেন পাঞ্জাবের এক প্রতিষ্ঠিত পরিবারের সন্তান। দেশভাগের পর ভারতে এসে বেশ সংগ্রাম চালাতে হয় তাকে। তিনি তখন বলিউডে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। ‘মাদার ইন্ডিয়া’ তাকে সেই সুযোগ করে দেয়। এই সিনেমার মাধ্যমেই তিনি খুঁজে পান তার স্বপ্নের রানীকে।

সুনীল দত্ত পরবর্তীকালে এক পত্রিকার সাক্ষাৎকারে জানান, প্রথম দেখাতেই নার্গিসের প্রেমে পড়েন তিনি। নার্গিসের সঙ্গে রাজ কাপুরের পূর্বপ্রেম সম্পর্কে সুনীল দত্ত বলেন, “তার আগের প্রেম বা আগের জীবন বিষয়ে আমার কোনো কৌতুহল ছিল না। তার অতীত নিয়ে আমি মাথা ঘামাইনি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম এই নারী আমার জীবনকে ভরিয়ে তুলবে। আমার জীবনে তিনিই প্রথম ও একমাত্র প্রেম।”

‘মাদার ইন্ডিয়া’ ছবির শুটিংয়ের সময়ই ঘটে আগুন লাগার সেই ঘটনা। জীবন বাজী রেখে তাকে উদ্ধার করায় সুনীল দত্তর প্রতি আকৃষ্ট হন নার্গিস। আহত সুনীল দত্তের অনেক সেবাও করেন তিনি। সে সময় তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

সুনীল দত্ত মানুষ হিসেবে ছিলেন দৃঢ় চরিত্রের, সৎ এবং প্রতিভাবান। নার্গিসকে ভালোবাসতেন তিনি প্রচণ্ডভাবে। তার জীবনে নার্গিসই ছিলেন একমাত্র নারী। নার্গিস ভাবলেন রাজ কাপুরের জীবনে ছায়ামাত্র হয়ে থাকার চেয়ে সুনীল দত্তের মতো একজন মানুষের স্ত্রী হওয়া শতগুণে শ্রেয়।

১৯৫৭ সালে মুক্তি পেল ‘মাদার ইন্ডিয়া’। ছবিটি ইতিহাস সৃষ্টি করে। নার্গিসের জীবনে এটি বয়ে আনে প্রভূত সম্মান ও সাফল্য। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কোনো পুরস্কারই প্রায় বাদ থাকে না। সুনীল দত্ত, রাজকুমার ও রাজেন্দ্র কুমারের ক্যারিয়ারও গতি পায় এই ছবির দৌলতে।

ছবি মুক্তির আগেই প্রেমে জড়ালেও মেহবুব খানের অনুরোধে বিষয়টি তারা গোপন রাখেন। কারণ পর্দায় মা ছেলের ভূমিকায় যারা অভিনয় করছেন তাদের মধ্যে প্রেম চলছে এমন গুজব ছবির দর্শকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারতো। ছবি মুক্তির পরের বছর ১৯৫৮ সালেই সুনীল দত্তকে বিয়ে করেন নার্গিস।

তাদের দাম্পত্য জীবন ছিল অত্যন্ত সুখের। এই দম্পতির তিন সন্তান। মেয়ে নম্রতা ও প্রিয়া এবং ছেলে সঞ্জয় দত্ত। নম্রতার সঙ্গে বিয়ে হয় রাজেন্দ্রকুমারের ছেলে অভিনেতা কুমার গৌরবের।

সুনীল দত্ত তার ক্যারিয়ারে প্রভূত সাফল্য পান। অভিনেতা, পরিচালক, প্রযোজক হিসেবে তিনি ছিলেন বলিউডের অন্যতম সম্মানিত ব্যক্তি। রাজনীতিবিদ হিসেবেও তিনি সফল। সুনীল দত্ত কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে ভারতীয় পার্লামেন্টের সদস্য ছিলেন।

সুনীল দত্ত সারাজীবন নার্গিসের প্রতি নিবেদিত ছিলেন। নার্গিস যখন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন তখন তার চিকিৎসায বিপুল অর্থ ব্যয় করেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন থাকার সময় কয়েক মাস অচেতন ছিলেন নার্গিস। তার চেতনা ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। সে সময় চিকিৎসকরা অচেতন নার্গিসের লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলার পরামর্শ দেন সুনীল দত্তকে। কারণ এটি ছিল প্রচণ্ড ব্যয়বহুল। কিন্তু সুনীল দত্ত রাজি হননি। তিনি স্থির করেছিলেন নিজের শেষ সম্বল দিয়ে হলেও তিনি স্ত্রীর চিকিৎসা চালিয়ে যাবেন। পরে চেতনা ফেরে নার্গিসের।

তবে ক্যন্সারের থাবা এড়াতে পারেননি তিনি। ১৯৮১ সালের ৩ মে ৫১ বছর বয়সে মৃত্যু হয় তার। সুনীল দত্ত স্ত্রীর স্মৃতি রক্ষার্থে গড়ে তোলেন নার্গিস দত্ত ফাউন্ডেশন। এখানে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। দরিদ্র রোগীদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। ক্যান্সার সম্পর্কে গবেষণাও পরিচালিত হয় এখানে।

সুনীল-নার্গিস দম্পতির ছেলে সঞ্জয় দত্ত তখন বলিউডের খ্যাতনামা অভিনেতা। মায়ের মৃত্যুতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। এমনকি সে সময় মাদকাসক্তও হয়ে পড়েন। সুনীল দত্ত তার সুচিকিৎসার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন এবং তাকে মাদকের নেশা থেকে ফিরিয়ে আনেন।

২০০৩ সালে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে সুনীল দত্ত বলেন নার্গিস ছিলেন তার জীবনের অনুপ্রেরণা। মৃত্যুর পরও প্রিয়তমা স্ত্রীর উপস্থিতি তিনি নিজের জীবনে সর্বক্ষণ অনুভব করতেন। ছেলের সঙ্গে ‘মুন্নাভাই এমবিবিএস’ ছবিতে তিনি অভিনয় করেছিলেন শুধু এই কথা ভেবে যে তার প্রয়াত স্ত্রী হয়তো এতে খুশি হতেন।

নার্গিস-সুনীল দত্ত দম্পতি বলিউডের আদর্শ প্রেমিক দম্পতি হিসেবে ছিলেন সুপরিচিত। ‘মাদার ইন্ডিয়া’ ছবির সেটে যে আগুন জ্বলেছিল তা অনির্বান প্রেমের শিখা হয়ে আমৃত্যু আলোকিত করেছে তাদের জীবন।