পালাবি কোথায়: নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের চিত্র

আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে ১৮৮৬ সালে শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য অধিকারের দাবিতে আন্দোলন করেছিলেন। করেছিলেন আত্মত্যাগ। এরপর পার হয়েছে ১৩০বছর। কিন্তু এখনও কি শ্রমিকের অধিকার পুরোপুরি অর্জিত হয়েছে?

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 May 2016, 06:00 AM
Updated : 1 May 2016, 06:00 AM

বাংলাদেশের নারীর শ্রমে ঘামেই গড়ে উঠেছে এদেশের পোশাকশিল্প। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস এই শিল্পে নিয়োজিত নারীশ্রমিকদের বঞ্চনা ও দুঃখ বন্দি থাকে কারখানার চারদেয়ালের ভিতরেই। পদে পদে হয়রানি ও লাঞ্চনার শিকার হয়েও এই নারীশ্রমিকরা সচল রাখেন অর্থনীতির চাকা। শুধু দেশের অর্থনীতি নয়, সংসারের চাকাটিও তো ঘুরছে এই পোশাকশ্রমিকদের শ্রমেই। তবু তাদের প্রতি সংঘটিত অন্যায়ের বিচার হয় না। বরং বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।

বাংলাদেশে একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন একদল নারী। তারা বিভিন্ন ভাবে কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার। বিশেষভাবে তারা যৌন হয়রানির শিকার। একসময় প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন তারা। বাঁশহাতে ঘিরে ধরেন নির্যাতনকারীকে। নারীদের সম্মিলিত 

প্রতিরোধের মুখে পালাতে পথ পায় না অপরাধী। এমনি প্রতিবাদী বক্তব্য নিয়ে ‘পালাবি কোথায়’ ছবিটি নির্মাণ করেছিলেন সদ্য প্রয়াত চলচ্চিত্র পরিচালক শহীদুল ইসলাম খোকন।

ছবির সূচনাতেই নারী শ্রমিকের অধিকার নিয়ে কিছু কথা শোনা যায় ব্যাকগ্রাউন্ডে। টাইটেলের পর শুরু হয় কাহিনি।

মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে শিরীন(সুবর্ণা মুস্তাফা)। পাত্রপক্ষ যৌতুক চায় বলে বিয়ে হয় না তার। কারণ যৌতুক দিয়ে বিয়ে করতে রাজি নন তিনি। শিরীন চাকরি করেন একটি পোষাক কারখানায টাইপিস্ট ও ম্যানেজারের পিএস হিসেবে। ওই কারখানার ক্লিনার শ্রমজীবী নারী নূরী(চম্পা)। তার স্বামী বাচ্চু(আলীরাজ)। বেকার বাচ্চু স্ত্রীর টাকা চুরি করে প্রায়ই। টাকা দিয়ে সে মদ খায়।

পোশাক কারখানার ম্যানেজার (হুমায়ূন ফরিদী) একজন বিবাহিত পুরুষ। ম্যানেজার দুঃশ্চরিত্র। নারীশ্রমিকদের ও কর্মীদের নানাভাবে যৌন হয়রানি করে সে। বিভিন্ন কৌশলে তার কাছ থেকে আত্মরক্ষা করে নারীরা।

অফিসে কম্পিউটার বিভাগ খোলা হয়। নতুন কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন মিলি চৌধুরী(শাবানা)নামে এক প্রতিবাদী নারী। তিনি হেড অফিস থেকে এসেছেন। শিরীনের ধারণা হয় কম্পিউটার ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে টাইপিস্টের আর প্রয়োজন হবে না। তাই ভিতরে ভিতরে দুঃখিত হন তিনি। কিন্তু অচিরেই মিলির সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় শিরীনের।

কারখানার সুপারভাইজার নার্গিস একজন খল চরিত্রের নারী। সুপারভাইজার সবসময় শ্রমিকদের উপর নির্যাতন চালায়।

মিলি চট্টগ্রামে স্বামী সন্তান রেখে শাশুড়ির অনুমতি নিয়ে ঢাকায় এসেছেন। থাকেন কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে। টুকরো টুকরো দৃশ্যের মাধ্যমে মিলি, নূরী ও শিরিনের পারিবারিক জীবন এবং সেই জীবনের সংকট তুলে ধরা হয়। নারীরা যে পারিবারিকভাবেও নানা রকম বৈষম্যের শিকার, আবার কর্মক্ষেত্রেও তার রয়েছে বিভিন্ন সমস্যা- এর সবই উঠে আসে সিনেমাটিতে।

শিরিনকে বিপদে ফেলার জন্য নার্গিস একটি জরুরি ফাইল লুকিয়ে রাখে। কিন্তু নূরী ও মিলির কারণে ফাইলটি উদ্ধার হয়।

কারখানার নারীকর্মীদের সংগঠিত করেন মিলি। সবাইকে তিনি বোঝাতে সক্ষম হন, নারীর পাশে নারীকেই দাঁড়াতে হবে। নারীরা পরষ্পরের সহযোগিতায় এগিযে যায়। মিলির অনুপ্রেরণায় সাহস সঞ্চয় করে তারা। নারী-পুরুষ সমাধিকারের মন্ত্রে তিনি দীক্ষিত করেন তাদের।

একদিন অফিস ছুটির পরও শিরীনকে কাজের অজুহাতে থাকতে বলে ম্যানেজার। একা পেয়ে শিরীনের উপর হামলা চালায সে। কিন্তু নূরী এবং মিলি এগিয়ে আসে শিরিনের সাহায্যে। সবাই মিলে কাবু করে তাকে এবং বাঁশ হাতে ম্যানেজারকে তাড়া করে সব নারী। এভাবেই উপযুক্ত শাস্তি পায় লম্পট ম্যানেজার।

‘পালাবি কোথায়’ কমেডিধর্মী ছবি। হাস্যরসাত্বক বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে কর্মজীবী নারীর অধিকারের বিষয়টি তুলে ধরা হয়। শাবানা, চম্পা ও সুবর্ণা মুস্তাফা সুঅভিনয়ের মাধ্যমে চরিত্রগুলো তুলে ধরেন। হুমায়ূন ফরিদীর কমেডি অভিনয় ছবিটির প্রধান সম্পদ। শহীদুল ইসলাম খোকনের দক্ষ পরিচালনায় ছবিটি গতি পায়। সংগীত পরিচালক ছিলেন আলম খান। কাহিনি ও সংলাপ লেখেন কাজী মোরশেদ। সংলাপ ছিল গতিশীল ও সহজবোধ্য। সংগীত মাঝারি মানের।

বাংলাদেশে নারী অধিকারের পক্ষে বাণিজ্যিক ঘরানার ছবির মধ্যে অন্যতম প্রধান ছবি ‘পালাবি কোথায়’। খুব জটিল বা উচ্চস্তরের বক্তব্য কিংবা নান্দনিক দৃশ্যায়ন হয়তো এ ছবিতে নেই। নেই তেমন কোনো শিল্পিত উপস্থাপন। হয়তো সাধারণ দর্শক আকর্ষণের জন্য সাদামাটাভাবে এবং কমেডির মাধ্যমে নারীর উপর হয়রানির বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে বাংলাদেশের সাধারণ দর্শকের কাছে শ্রমজীবী নারীর অধিকারের বিষয়টি তুলে ধরার ক্ষেত্রে ‘পালাবি কোথায়’ ছবির অবদান অনস্বীকার্য।

‘পালবি কোথায়’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে পরিচালক নারী অধিকারের পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন। হুমায়ূন ফরিদী প্রযোজিত ছবিটিতে অতিথি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন আফজাল হোসেন। ‘পালাবি কোথায়’ মুক্তি পায় ১৯৯৬ সালে। ছবিটি দর্শক সমাদৃত হয়। বক্তব্য ও অভিনয়ের কারণে সমালোচকদের প্রশংসাও কুড়ায়।

‘পালাবি কোথায়’ নিছক কমেডি নয় বরং নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের জন্য ব্যতিক্রমী একটি ছবি। বিশ বছর আগে নির্মিত হলেও ছবিটি তাই আজও প্রাসঙ্গিক।