টিভি ক্ল্যাসিক: মুখরা রমণী বশীকরণ

বাংলাদেশ টেলিভিশন বা বিটিভিতে আজ পর্যন্ত নির্মিত অনুষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ হলো নাটক ‘মুখরা রমণী বশীকরণ’।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 April 2016, 06:32 AM
Updated : 23 April 2016, 06:32 AM

ভীষণ বদমেজাজী এক সুন্দরী তরুণী ক্যাথেরিনা মিনোলা। সময়টা মধ্যযুগের ইতালি। ব্যস্ত শহর পাদুয়া। এই শহরের এক অভিজাত ধনী ব্যক্তি বাপতিস্তা। তার  ‍দুই মেয়ে ক্যাথেরিনা ও বিয়াংকা। রূপে দুজনেই অসামান্য। বিয়াংকা বিনয়ী ও মিষ্টভাষী। কিন্তু ক্যাথেরিনা কর্কশভাষী, প্রচণ্ড ঝগড়ুটে ও মারকুটে। 

বিয়াংকাকে বিয়ে করতে অনেক তরুণ আগ্রহী। কিন্তু বাপতিস্তার সিদ্ধান্ত হলো আগে তিনি বড় মেয়ের বিয়ে দেবেন। ক্যাথেরিনার বিয়ের আগে বিয়াংকাকে কোনোভাবেই বিয়ে দেবেন না তিনি।

বিয়াংকার তিন পাণিপ্রার্থী লুসেনশিও, গ্রেমিও এবং হরটেনসিও তাই স্থির করে আগে তারা ক্যাথেরিনার জন্য উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান করবে। এ সময়ে পাদুয়ার আসেন এক ধনী যুবক পেট্রুশিও। তিনি এসেছেন তার উপযুক্ত ধনী ও সুন্দরী কনের খোঁজে।

ক্যাথেরিনাকে বিয়ে করতে আগ্রহী হন পেট্রুশিও। তিনি বাপতিস্তার কাছে প্রস্তাব নিয়ে যান এবং ক্যাথেরিনাকে রাজি করাবেন বলে দৃঢ় অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। ক্যাথেরিনার সঙ্গে দেখা করে পেট্রুশিও তাকে আদর করে কেইট বলে ডাকেন। কেইটের গালাগাল ও কথার আঘাত হেসে উড়িয়ে দেন তিনি। বিয়েতে কেইটের আপত্তিকে কানেই তোলেন না চালাক পেট্রুশিও। স্থির হয়ে যায় তাদের বিয়ের দিন।

বিয়ের আসরে নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে এসে হাজির হন পেট্রুশিও। তার ভয়ংকর মেজাজে পুরোহিতসহ অতিথিরা সবাই ভয়ে থমকে যায়। বদমেজাজী কেইটও ভয় পেয়ে যায়। হাস্যরসাত্বক বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে কেইটের সঙ্গে বিয়ে হয় পেট্রুশিওর। বিয়ের পরই কেইটকে নিজের শহরে নিয়ে যায় পেট্রুশিও। নিজের প্রাসাদে পৌছানোর পর কর্মচারীদের উপর ভীষণভাবে রাগারাগি করতে থাকেন তিনি। গৃহর্মীদের আনা কোনো খাবারই পছন্দ হয় না তার। কোনো পোশাক, কোনো খাবারই তfর স্ত্রী মহামান্যা কেইটের উপযুক্ত নয় এই অভিযোগে সব কিছু ছুঁড়ে ফেলে দিতে থাকেন তিনি। ফলে কেইটকে রীতিমতো না খেয়ে থাকতে হয়। কেইটকে ঘুমাতেও দেন না তার উগ্রমেজাজী স্বামী। কারণ বিছানায় জল ঢেলে সেটি মহামান্য স্ত্রীর শোবার অনুপযুক্ত বলে ঘোষণা করেন তিনি । ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত কেইট নিজের স্বভাবসিদ্ধ ঝগড়া ভুলে পেট্রুশিওকে শান্ত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এইভাবে পেট্রুশিওর কথায় সায় দিতে এবং শান্তি রক্ষায় উদগ্রিব হয়ে বশীভূত হন ক্যাথেরিন।

এদিকে বিংয়াংকাকে  বিয়ে করতে সক্ষম হন লুসেনশিও। একজন ধনী বিধবাকে বিযে করেন গ্রেমিও। বিয়াংকার বিয়ের ভোজে উপস্থিত হন সস্ত্রীক পেট্রুশিও ও গ্রেমিও। সে আসরে তিন নববিবাহিত স্বামী লুসেনশিও, গ্রেমিওে এবং পেট্রুশিও বাজি ধরেন কার স্ত্রী সবচেযে মিষ্টভাষী ও অনুগত তা নিয়ে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে এ বাজি জেতেন পেট্রুশিও। কারণ তার ডাকে সাড়া দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে আসরে হাজির হন কেইট। অথচ অন্যদের স্ত্রীরা স্বামীর ডাককে পাত্তাই দেয় না। এভাবে পেট্রুশিওর চাতুর্যে শেষ পর্যন্ত ঝগড়ুটে ক্যাথেরিনা পরিণত হন মিষ্টভাষী ও অনুগত স্ত্রীতে।

উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের বিখ্যাত কমেডি ‘দ্য টেইমিং অব দ্য শ্রু’র এই কাহিনিকে বাংলায় রূপান্তর করেন শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী। তিনি নাটকটির বাংলা নাম দেন ‘মুখরা রমণী বশীকরণ’।

১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের পর নতুনভাবে গড়ে উঠতে থাকে বিটিভি। সেসময় বিটিভির রামপুরা ভবন গড়ে ওঠেনি। ডিআইটির একটি অংশে চলতো বিটিভির কাজ। সেই ছোট পরিসরেও নির্মিত হয়েছে অসাধারণ সব অনুষ্ঠান। ডিআইটির ছোট ভবনে নির্মিত বিটিভির একটি অসাধারণ কাজ হলো ‘মুখরা রমণী বশীকরণ’ নাটক। নাটকটির প্রযোজক ছিলেন মুস্তাফা মনোয়ার। অসামান্য প্রতিভাধর এই শিল্পীর নির্দেশনায় ‘মুখরা রমণী বশীরণ’ হয়ে ওঠে এমন একটি নাটক যা আজ অবধি নির্মিত বিটিভির শ্রেষ্ঠ প্রযোজনার অন্যতম।

ক্যাথেরিন বা কেইট চরিত্রে ছিলেন সে সময়ের গ্ল্যামারাস ও সাহসী অভিনেত্রী আজমেরী জামান রেশমা। অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন তিনি মুখরা রমণীর চরিত্রে। পেট্রুশিও চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেন গোলাম মুস্তাফা। বিয়াংকা চরিত্রে ছিলেন লায়লা হাসান এবং লুসেনশিও চরিত্রে ছিলেন হাসান ইমাম। কেরামত মাওলা এবং এটিএম শামসুজ্জামান ছিলেন আরও দুটি বিশেষ চরিত্রে। এই নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে যারা অভিনয় করেছিলেন তাদের প্রত্যেকের অভিনয় ছিল দুর্দান্ত। মুনীর চৌধুরীর ঝরেঝরে ও স্বচ্ছন্দ্য অনুবাদে সংলাপগুলো ছিল দারুণ প্রাণবন্ত।

শেক্সপিয়ারের নাটকের সংলাপে বৈষ্ণব পদাবলীর ব্যবহারও ছিল বিষ্ময়কর। কেইটের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশে পেট্রুশিও বারে বারে উচ্চারণ করে ‘লাখো লাখো যুগ হিয়া রাখিনু…’।

অনুচরের ভূমিকায় কেরামত মাওলার উচ্চারিত সংলাপ ‘তিনি আসছেন না, তবে তার ঘোড়া আসছে’ ছিল অসাধারণ। নাটকে শেকসপিয়ারের সৃষ্টিকর্মের আমেজ পুরোপুরি বজায় রেখে বাংলায় লাগসই শব্দ ব্যবহার করা হয়। দৃশ্য ও পোশাকে ইতালির মধ্যযুগের আবহ রূপ পায়।

নাটকটির পোশাক পরিকল্পনা ছিল চমৎকার। সেটও ছিল অসাধারণ। সেসময়ের সীমিত সাধ্যে কিভাবে এমন সেট নির্মাণ সম্ভব হয়েছিল তা সত্যিই বিষ্ময়ের উদ্রেক করে। ডিআইটি ভবনের প্রবেশপথে, স্টুডিওর সামনের করিডোরে এবং স্টুডিওর ভিতরে স্বল্প পরিসরে গড়ে তোলা হয়েছিল সেটের বিভিন্ন অংশ। ‘মুখরা রমণী বশীকরণ’ নাটকটি যুক্তরাজ্যের গ্রানাডা টিভির ‘ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি অব টিভি ড্রামা’য় স্থান পেয়েছিল। এমন একটি ক্ল্যাসিক প্রযোজনার মূল কৃতিত্ব নিশ্চিতভাবেই ছিল মুস্তাফা মনোয়ারের। তারই প্রতিভায় নাটকটি শিল্পসার্থক হয়ে ওঠে। অভিনয় গুণে, পরিচালনায়, পোশাক পরিকল্পনায়, শিল্প নির্দেশনায়, শব্দসংযোজনে, সম্পাদনায়  এই অসামান্য শিল্পকর্ম আজও বিটিভির ক্ল্যাসিক হিসেবে গণ্য।