সত্যজিৎই সেরা

বৃষ্টি পড়ছে। দু’চোখ ভরে সেই বৃষ্টির সৌন্দর্য দেখছে দুই শিশু। এই দৃশ্যটি ক্যামেরায় ধারণ করার জন্য এক চিত্র পরিচালক অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন বৃষ্টির। অন্যান্য পরিচালকের মতো স্টুডিওর কৃত্রিম বৃষ্টি দিয়ে কাজ চালাতে তিনি নারাজ। তিনি চান বাংলার অপরূপ প্রকৃতির অনবদ্য দৃশ্যায়ন। কারণ তিনি যে সত্যজিৎ রায় – সেলুলয়েডে যিনি সৃষ্টি করেন অমর কাব্য।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 April 2016, 06:04 AM
Updated : 23 April 2016, 06:04 AM

সত্যজিৎ রায় বাংলা চলচ্চিত্র জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচালক এবং বিশ্বের সেরা পরিচালকদের মধ্যে রয়েছেন প্রথম সারিতে।

‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’, ‘অপুর সংসার’, ‘দেবী’, ‘জনঅরণ্য’, ‘নায়ক’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘জলসাঘর’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘গুপীগাইন বাঘা বাইন’, ‘আগন্তুক’-এর মতো অনেক কালজয়ী চলচ্চিত্রের স্রষ্টা সত্যজিৎ রায় এমনই এক পরিচালক যাকে কোনো নির্দিষ্ট ঘরানার ফ্রেমে আবদ্ধ করা যায় না। প্রতিবারই নতুন সৃষ্টির মাধ্যমে তিনি অতিক্রম করেছেন নিজেকে। তার সৃষ্টিসম্ভার বিচিত্র ও বহুমুখী। প্রকৃতির সৌন্দর্য, মানবমনের জটিল অনুভূতি, সম্পর্কের টানাপোড়েন, অন্তর্দ্বন্দ্ব সামাজিক অসংগতি, বৈষম্য, অপরাধ, গোয়েন্দা কাহিনি, রাজনীতি, চিরায়ত সাহিত্য সবকিছুই তার চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু হয়েছে।

কিংবদন্তি এই শিল্পীর জন্ম ১৯২১ সালের ২মে কলকাতায়। তার পূর্বপ্রজন্মের মানুষরা বাস করতেন কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদির মসুয়া গ্রামে। সেখানে তাদের বিশাল জমিদারি ছিল। পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সময় থেকেই তাদের পরিবার মসুয়া থেকে কলকাতায় স্থায়ী আবাস গড়ে তোলে। ১০০ গড়পার রোডে রায়চৌধুরীদের বিশাল প্রাসাদোপম বাড়িতে তারা বাস করতেন। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এবং তার ছেলে সুকুমার রায় দুজনেই খ্যাতনামা শিশুসাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক। সুকুমার রায় ৩৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। সেসময় তার একমাত্র সন্তান সত্যজিত রায়ের বয়স মাত্র ২ বছর। মায়ের সঙ্গে তিনি চলে আসেন মামার বাড়িতে। এই মামার বাড়িতেই বড় হয়েছেন সত্যজিৎ রায়। তার ডাকনাম ছিল মানিক। তিনি মানিকবাবু বা মানিকদা নামে চলচ্চিত্রজগতে পরিচিত ছিলেন।

সত্যজিৎ রায় বালিগঞ্জ গভর্মেন্ট স্কুল, প্রেসিডেন্সী কলেজ এবং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। বিশ্বভারতীতে নন্দলাল বসু ও অন্যদের কাছে চারুকলার শিক্ষা গ্রহণ করেন তিনি।

১৯৪৩ সালে তিনি ব্রিটিশ বিজ্ঞাপনী সংস্থা  ডি জে কিমারে কাজ শুরু করেন। এখানে চাকরির পাশাপাশি তিনি বিশিষ্ট প্রকাশনা সংস্থা সিগনেট প্রেসে কাজ করতে থাকেন। সুকুমার রায়ের মতোই তার ছবি আঁকার হাত ছিল অসাধারণ|। সিগনেট প্রেস থেকে প্রকাশিত অনেক বইয়ের প্রচ্ছদ, গ্রাফিক ডিজাইন করতেন তিনি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’র কিশোর সংস্করণ ‘আম আাঁটির ভেঁপু’ বইটিরও প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করেন সত্যজিৎ রায়। বইয়ের ভিতরে প্রচুর ছবি আঁকতেন তিনি। সেসময়ই এ কাহিনিকে চলচ্চিত্রে রূপ দেওয়ার চিন্তা মাথায় আসে তার।

১৯৪৭ সালে সত্যজিৎ রায় অন্য কয়েকজনের সঙ্গে মিলে কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। তার আত্মজীবনীমূলক বই ‘যখন ছোট ছিলাম’, তার আত্মীয়া ও পরে স্ত্রী বিজয়া রায়ের স্মৃতিকথা এবং সত্যজিৎ রায়ের অন্যান্য লেখা থেকে জানা যায় কলকাতার সেসময়কার গতানুগতিক বাণিজ্যিক ছবি সম্পর্কে ছোটবেলা থেকেই একটা নেতিবাচক ধারণা তার মধ্যে ছিল। তিনি মার্কিন ব্রিটিশ, ফরাসি ও অন্যান্য দেশের চলচ্চিত্র দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। শিল্পমানসম্পন্ন ছবি তাকে আকর্ষণ করতো সবসময়। চাকরিসূত্রে তিনমাস লন্ডনে থাকার সময় তিনি দেখেন ইতালির বিখ্যাত ছবি ‘দ্য বাইসাইকেল থিফ’। ছবিটি তাকে চলচ্চিত্র বানাতে অনুপ্রাণিত করে ।

১৯৫২ সালে সত্যজিৎ ‘পথের পাঁচালী’র নির্মাণ শুরু করেন। ছবির অভিনয় শিল্পী ও কলাকুশলীদের অধিকাংশই ছিলেন একেবারে নতুন|। বিজয়া রায়ের গয়না বিক্রির টাকা ও নিজের সঞ্চিত সব টাকা দিয়ে এই চলচ্চিত্রের নির্মাণ শুরু করেন তিনি। টাকার অভাবে ছবি তৈরির কাজ মাঝপথে আটকে যায়। পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী তখন ডা. বিধান চন্দ্র রায়। তিনি ব্রাহ্ম সমাজের সূত্রে রায় পরিবারের বিশেষ পরিচিত ছিলেন। সত্যজিতের অনুরোধে সরকারী কিছু অনুদান পায় ‘পথের পাঁচালী’। অর্থের অভাব সত্ত্বেও ছবিটির চিত্রনাট্য একটুও পরিবর্তন করতে রাজি হননি সত্যজিৎ। তিনি ছিলেন এমনই আপোষহীন।

১৯৫৫ সালে মুক্তি পায় ‘পথের পাঁচালী’। সৃষ্টি হয় ইতিহাস। ভারতে ও ভারতের বাইরে ‘পথের পাঁচালী’ রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করে। দেশে বিদেশে দর্শক সমালোচক ছবিটি দেখে অভিভূত হন। বাংলার গ্রামীণ জীবনের এমন শিল্পিত চিত্রায়ন, শিশুমনের এমন অভিব্যক্তির প্রকাশ রূপালি পর্দায় আগে কখনও দেখা যায়নি।

এই সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি নির্মাণ করেন এর সিকুয়েল ‘অপরাজিত’। কিশোর অপুর কাহিনি। দর্শক-সমালোচকরা আগের চেয়েও সাদর অভ্যর্থনা জানায় ছবিটিকে।

এর পর সত্যজিৎ রায় নির্মাণ করেন ‘পরশপাথর’। হাস্যরসের আড়ালে সমাজের নির্মম বাস্তবতার চিত্রায়ন এটিকেও দারুণ সাফল্য এনে দেয়।

ক্ষয়িষ্ণু জমিদারী প্রথার করুণ ট্র্যাজিডি নিয়ে মুক্তি পায় ‘জলসাঘর’। অসামান্য এই ছবিও অলোড়ন তোলে। এখানে প্রধান চরিত্রে ছবি বিশ্বাসের অভিনয়ও ছিল অনবদ্য।

অপু-ত্রয়ীর শেষ ছবি ‘অপুর সংসার’ মুক্তি পায় ১৯৫৯সালে। সৌমিত্র ও শর্মিলা ঠাকুরের মতো নতুন দুই তারকা অভিনয়শিল্পীর জন্ম হয় তার হাত ধরে| এই ছবিটিও ব্যাপক সমাদর পায়।

সত্যজিৎ রায়ের পরবর্তি ছবিগুলো হলো ‘দেবী’, ‘তিনকন্যা’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘অভিযান’, ‘চারুলতা’, ‘নায়ক’, ‘মহানগর’, ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’, ‘চিড়িয়াখানা’। কাহিনির দিক থেকে প্রতিটি ছবিই নিজস্ব দীপ্তিতে ভাস্বর। প্রতিটি ছবিই পরিচালনা, অভিনয়, দৃশ্যায়ন, সংগীত, সংলাপসহ সামগ্রিকভাবে নিখুঁত শিল্প। এবং প্রতিটি ছবিই দর্শক ও সমালোচকদের কাছে সমাদৃত।

১৯৬৮ সালে মুক্তি পায় ‘গুপীগাইন বাঘা বাইন’। উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর লেখা শিশুতোষ গল্পের ভিত্তিতে নির্মিত হয় এই ছবি। অসাধারণ একটি শিল্পকর্ম এটি। শিশুতোষ ছবি বলা হলেও এটির ভিতরে রয়েছে দারুণ সব রাজনৈতিক বক্তব্যও। এই সিরিজের আরেকটি ছবি ‘হীরক রাজার দেশে’। এ ছবিতেও রাজনৈতিকভাবে ধারালো সব বক্তব্য রয়েছে যা বলা হয়েছে হাস্যরসের আড়ালে। দুটি ছবিই পায় তুমুল জনপ্রিয়তা।

সত্যজিৎ রায় পরিচারিত সব ছবিই অসাধারণ ও তার নিপুণ পরিচালনার সাক্ষরবাহী। এরই মধ্যে বিশেষভাবে বলা প্রয়োজন কযেকটি ছবির কথা। ‘অশনি সংকেত’ তেমনি এক ছবি। ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাংলায় ভয়াবহ মন্বন্তরের উপর লেখা বিভূতিভূষণের উপন্যাস অবলম্বনে এই ছবিতে অন্যতম প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট অভিনয়শিল্পী ববিতা। ছবিটি মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎসবে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায়।

উর্দুভাষায় নির্মিত ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ও একটি অসামান্য ছবি। মুন্সী প্রেমচাঁদের গল্প অবলম্বনে নির্মিত ছবিটিতে আওধের (লখনৌ) শেষ নবাব ওয়াজেদ আলি শাহর ট্র্যাজিডি চিত্রায়িত হয়। ছবিটিতে আমজাদ খান, সঞ্জিবকুমার, শাবানা আজমির মতো নামজাদা অভিনয়শিল্পীরা ছিলেন।

সত্যজিৎ রায় তার নিজের লেখা জনপ্রিয় গোয়েন্দা সিরিজ ফেলুদার কাহিনি নিয়ে দুটি ছবি নির্মাণ করেছেন। ‘সোনার কেল্লা’ ও ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’। দুটি ছবিই অনেক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বিশেষ করে মুকুল ও রুকুর ভূমিকায় দুই শিশু অভিনেতার অভিব্যক্তি যেভাবে তুলে আনেন পরিচালক তাতে ছবি দুটি শিল্পের বিচারে শীর্ষস্তরে উন্নীত হয়।

সত্যজিৎ রায় তার ‘জনঅরণ্য’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘সীমাবদ্ধ’, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, ‘গণশত্রু’, ‘শাখা প্রশাখা’, ‘আগন্তুক’ এসব ছবির মধ্য দিযে বাঙালি মধ্যবিত্তের চরিত্র দুর্দান্তভাবে তুলে ধরেন। চিত্রনাট্য, সংলাপ ও পরিচালনার পাশাপাশি অধিকাংশ ছবির সংগীত পরিচালনা তিনি নিজেই করেছেন।

সত্যজিৎ রায় ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ছিলেন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রপরিচালক। তিনি ভারত সরকারের ভারত রত্ন, পদ্মভূষণ, পদ্মশ্রী সম্মাননা এবং দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৯২ সালে বিশ্ব চলচ্চিত্রশিল্পে অবদানের জন্য পেয়েছেন অস্কার। ফরাসি সরকার তাকে লিজিওঁ ডি’অনারে ভূষিত করে। অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডি লিট পেয়েছেন। গোল্ডেন লায়ন পেয়েছেন ভেনিসে।  বার্লিন, মস্কো, কান চলচ্চিত্র উৎসবে একাধিকবার পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। দেশী বিদেশী অসংখ্য পুরস্কার জমা হয়েছে তার ঝুলিতে। তিনি সর্বকালের সেরা বাঙালি ব্যক্তিত্বদের অন্যতম।

সত্যজিৎ রায় মৃত্যুবরণ করেছেন ২৪ বছর আগে। কিন্তু তিনি চিরদিন বেঁচে থাকবেন তাঁর কালজয়ী সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে।