নারীর আত্ম অনুসন্ধানের গল্প ‘পরমা’

কথা সাহিত্যিক বনফুলের ‘নিম গাছ’ গল্পটি যদি চলচ্চিত্রে রূপ দেওয়া যেত তাহলে তা কি অনেকটা ‘পরমা’ হয়ে উঠতো না?

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 April 2016, 09:59 AM
Updated : 22 April 2016, 09:59 AM

নিমগাছের আদর সকলের কাছে। তার পাতা, বাকল ও ডালের আদর কবিরাজের কাছে অপরিসীম। এমনকি তার বাতাসও উপকারী। হ্যা উপকারী বলেই তার আদর। কিন্তু তার সৌন্দর্য নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। সে থাকে আবর্জনার পাশে, বাড়ির পিছনের আঙিনায়। ফুলগাছের মতো তার যত্ন করে না কেউ, বাড়ির শোভাবর্ধকও সে নয়। অথচ তারও রয়েছে নিজস্ব রূপ, আকর্ষণ। একমাত্র এক কবির চোখে ধরা পড়ে তার রূপ। নিমগাছের ইচ্ছা হয় সেই লোকটির সঙ্গে চলে যেতে, কিন্তু পারে না। কারণ শিকড় যে অনেকদূর পর্যন্ত গেঁথে গেছে মাটিতে।

চৌধুরি বাড়ির লক্ষ্মী বউ পরমারও একই দশা। পরমা যে একসময় ভুলতেই বসেছিল তার নিজের নাম, পরিচয়। সে কারও মা, কারও কাকীমা, কারও পুত্রবধূ তো কারও জা, কারও বৌদি। সে সংসার দেখে, শয্যায় স্বামীকে সঙ্গ দেয়, উচ্চপদস্থ স্বামীর সঙ্গে হাসিমুখে পার্টিতে যায় মিসেস ভাস্কর চৌধুরি সেজে। বৃদ্ধা শাশুড়ির সেবা করে। কলেজপড়ুয়া মেয়ে আর স্কুলপড়ুয়া দুই ছেলের যত্ন নেয়। জীবনে তার তো আর কোনো ভূমিকা নেই। অথচ সেও লেখাপড়া জানা মেয়ে। কিন্তু তার গড়ে ওঠেনি নিজের পরিচয়, নিজস্ব বলয়। বিয়ের আগে সে একসময় সেতার বাজাতো, গান গাইতো। কিন্তু বিয়ের পর তার আর গানের চর্চা করা হয়নি।

দুর্গা পূজা চলছে। বিশাল যৌথ পরিবারের লক্ষী বউয়ের ভূমিকায় রয়েছে পরমা। ভাসুরের ছেলের বন্ধু এক তরুণ আলোকচিত্রী রাহুল রায়। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী সে। থাকে নিউইয়র্কে। ছবি তোলার জন্য ঘুরে বেড়ায় সারা বিশ্ব। তার কৌতুহল কলকাতার দুর্গাপূজা। দেবী প্রতিমার ছবি তুলতে গিয়ে তার ক্যামেরায় ধরা পড়ে পরমার মুখ। সে মুখের অপরিসীম সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয় রাহুল। শুধু তাই নয়, তার কৌতুহল জাগে বাঙালি গৃহবধূর অন্তর্জীবন সম্পর্কে।

পরের বছর পরমার বাড়িতে আসে সে। ভাসুরের ছেলে ও স্বামীর অনুরোধে রাহুলের জন্য ফটোসেশনে সময় দিতে রাজি হয় পরমা।

রাহুলের সঙ্গে সে যায় কলকাতার বিভিন্ন জায়গায়। আজন্ম পরিচিত শহর তার চোখে ধরা দেয় অন্যরূপে। নিজের পুরনো বাড়িতে গিয়ে তার মনে পড়ে শৈশব স্মৃতি। তার বিধবা পিসীমার কথা। পরিবারের অমতে প্রেমের সম্পর্কে জড়ানোয় যাকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল ছাদের ঘরে।

এক পর্যায়ে রাহুলের সঙ্গে আবেগময় প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যায় পরমা। এই প্রেম তাকে প্রেরণা দেয় জায়া ও জননীর মুখোশ খুলে নারী হিসেবে নিজের দিকে তাকানোর। রাহুলের প্রশ্ন, ‘আচ্ছা, পরমা আপনি কি ভাবেন সারাদিন?’ পরমা ফিরে তাকায় নিজের জীবনের দিকে। সে তো কিছুই ভাবে না। নিজস্ব কোনো চিন্তার জগৎ তো তার নেই। নিজের চাওয়া পাওয়া উপলব্ধি করে সে। একসময়ের ভালোলাগা কবিতা, গান সবই তো তার জীবনে অতীত। রাহুলের সঙ্গে পরমাও চায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেতে, জীবনকে নিজের মতো করে যাপন করতে। সরল, জীবন সম্পর্কে অসচেতন এক গৃহবধূ থেকে সে হয়ে ওঠে আত্মসচেতন মানুষ।

রাহুল চলে যায় একসময়। রাহুলের চিঠিপত্র আসে পরমার এক বান্ধবীর ঠিকানায়। পরমার দিন কাটে আগের মতোই সংসারের বলয়ে। তার কিছু ছবি বিদেশি পত্রিকায় প্রকাশ করে রাহুল। সে পত্রিকাটি হাতে পড়ে পরমার স্বামীর। সেসব ছবির মধ্যে একটি ছিল তার স্নানের। যেটি পরিবারের লোকেরা কখনও দেখেনি। হুলুস্থুল পড়ে যায় সংসারে। নিন্দায়, কুৎসায় মুখর হয়ে ওঠে পরিবার ও সমাজ। এক মুহূর্তে সংসারে নিজের প্রকৃত অবস্থানটি চিনে নেয় পরমা। স্বামী মুখ ফিরিয়ে নেয়, বিরূপ হয়ে ওঠে সন্তান। শাশুড়ি, ননদ সকলেই হয়ে ওঠে নিন্দায় মুখর। তার এতদিনের সেবা, শ্রম সব এক দিনে ভুলে যায় সংসার।

অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করতে চায় পরমা। হাসপাতালে নেওয়া হয় তাকে। চিকিৎসায় বেঁচে যায় সে। পরিবারের সদস্যরা তার প্রতি অনুকম্পা বোধ করে। ফিরিয়ে নিতে চায় তাকে পরিবারের ভিতরে। কিন্তু পরমা আর ফিরতে চায় না। রাহুলের হাত ধরে নয়, নিজের শক্তিতে নিজের জীবনের পথ সন্ধান করতে চায় পরমা। বান্ধবীকে সে অনুরোধ করে তার জন্য চাকরি খুঁজতে। চিকিৎসক যখন বলে তার মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজন যাতে সে সব অপরাধবোধ কাটিয়ে উঠতে পারে, তখন পরমা বলে তার কোনো অপরাধবোধ নেই। পরমার মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। সে ছোট একটি চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের স্বাধীন জীবনের পথে এগিয়ে যায় এবং আগের সব বন্ধনকে অস্বীকার করে নতুনভাবে বাঁচতে চায়। মিসেস চৌধুরী থেকে সে হয়ে ওঠে পরমা।

অসাধারণ এই কাহিনির ছবিটি পরিচালনা করেন অপর্ণা সেন। চিত্রনাট্যও তার। ছবিতে পরমা চরিত্রে অভিনয় করেন রাখি। তার স্বামীর চরিত্রে দীপংকর দে, রাহুলের ভূমিকায় ছিলেন মুকুল শর্মা। বান্ধবী শীলার চরিত্রে ছিলেন অপর্ণা সেন। চিকিৎসকের ভূমিকায় ছিলেন অনিল চ্যাটার্জি।

পরমা চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেন রাখি। স্বামী চরিত্রে দীপংকর দে ছিলেন অসাধারণ। রাহুলের ভূমিকায় মুকুল শর্মার অভিনয়ও প্রশংসিত হয়। ছোট ছোট ও অর্থবহ সংলাপ, মন্তাজ, ছোট ছোট দৃশ্য, সিনেমাটোগ্রাফি, দুর্দান্ত অভিনয় এবং নিপুণ পরিচালনা ছবিটির মূল সম্পদ। ১৯৮৪ সালে মুক্তি পায় ছবিটি। বাণিজ্যিক সাফল্যের পাশাপাশি সমালোচকদের বিপুল প্রশংসা পায় ছবিটি। ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয় করে সেরা ছবি হিসেবে।

চল্লিশ বছর বয়সী এক নারীর সঙ্গে এক তরুণের নিছক প্রেমকাহিনি ছবির বিষয়বস্তু নয় বরং নারীর আত্ম অনুসন্ধান, তার নিজস্ব জগতকে খুঁজে ফেরা এবং নিজের পরিচয়ে জীবন যাপনের আত্মবিশ্বাস অর্জন করার গল্প বলে পরমা।