‘গানের অ্যালবাম হয়ে গেছে স্মৃতিচিহ্ণ’

২০০১ সালে ‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়’ গানেরটির মাধ্যমে হঠাৎ করেই গানের জগতে আগমন শিল্পী আসিফ আকবরের।

তানজিল আহমেদ জনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 April 2016, 09:00 AM
Updated : 16 April 2016, 12:52 PM

এক দশকেরও বেশি সময়ের ক্যারিয়ারে সিনেমায় প্লেব্যাক এবং ত্রিশটিরও বেশি অ্যালবামের মাধ্যমে এদেশের সংগীত জগতে গড়ে নিয়েছেন নিজের পাকাপোক্ত আসন। সম্প্রতি বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনের বিদ্যমান সম্যসা, সংগীতের গতিপথ ও সম্ভাবনার দিকগুলো নিয়ে গ্লিটজের সাথে কথা বললেন দুবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী এই শিল্পী।

গ্লিটজ: গানের কপিরাইট কার পাওয়া উচিত?

আসিফ আকবর: আন্তজার্তিক আইন অনুযায়ী কিংবা আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতেও কোম্পানী, শিল্পী, সুরকার সবাই প্রতি মাসে একটি র্নিদিষ্ট পরিমানে রেভিনিউ পেয়ে থাকেন, যা ১৯৪৩ সাল থেকেই তাদের দেশে চালু রয়েছে। এছাড়াও তাদের দেশে শিল্পীদের যে সোসাইটি রয়েছে, তার মাধ্যমে যে কোনো শিল্পী কোথায় গান করছেন, কার গান গাইছেন ইত্যাদি বিষয়ে আগেই একটি তালিকা দেওয়ার মতো বাধ্যবাধকতাও কপিরাইট সোসাইটির মাধ্যমে রয়েছে।

এমন ধরনের কোনো ফাউন্ডেশন বাংলাদেশে গড়ে ওঠেনি। এখন যা হচ্ছে তা বিচ্ছিন্নভাবে হচ্ছে। শিল্পী ও প্রযোজক মুখোমুখি হওয়ার কারণেই এই সম্যসাটা তৈরি হয়েছে। আমার মনে হয় আলোচনা সাপেক্ষে বিষয়টা শেষ করে ফেলা উচিত। নইলে অনুপ্রবেশকারীরা ঢুকতে থাকবে।

গ্লিটজ: গানের অ্যালবাম মানেই হলো সেখানে শ্রোতাদের জন্য ৮/১০টি গান থাকবে। কিন্তু স্বল্প সংখ্যক গান নিয়ে বাজারে সম্প্রতি বেশ কয়েকজন শিল্পীর গানের অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। এই বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখছেন এবং এক্ষেত্রে শ্রোতারা কি ঠকছেন বলে মনে করেন?

আসিফ আকবর:
না, এটা একদমই ঠিক না। এখন গানের অ্যালবাম হয়ে গেছে সুভেনিয়্যার (স্মৃতিচিহ্ণ)। ইনফ্যাক্ট এখন অ্যালবামের পাঁচশ, এক হাজার কপি প্রকাশ করা হয় শুধুমাত্র পরিচিত মানুষকে উপহার দেওয়ার জন্য। এখনকার সময়ে অ্যালবাম বলে আর কোনো শব্দ নেই। এখন সব কিছুই হয়ে গেছে অনলাইন প্রোডাকশন। টেলকো প্রোডাকশনও চলে আসছে।

একটি গান নিয়ে গানের অ্যালবাম প্রকাশ করা হলে এটা সেই শিল্পীর ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু শ্রোতাদের জন্য অ্যালবামের যে মূল কনসেপ্ট তা এখন আর নেই। সুতরাং অনলাইনে যে ডিস্ট্রিবিউশন হচ্ছে সেটার সাথে তাল মিলিয়ে একটা সময়ে হয়ত সুভেনিয়্যার প্রকাশ করা হবে; গানের অ্যালবাম না। আর শ্রোতারা কেন ঠকবে? আগে একটি গানের অ্যালবাম হয়তো দুই লাখ, তিন লাখ, পাঁচ লাখ কপি বিক্রি হতো। কিন্তু এখন ইউটিউবের মাধ্যমে দশ লাখ, বিশ লাখ, পঞ্চাশ লাখ শ্রোতা গান শুনতে পারছেন। এটাতো আরো ভাল। আমি সব কিছু খুব ইতিবাচকভাবেই দেখি।

গ্লিটজ: আমরা অনলাইন বিতরণের দিকে যদি ঝুঁকে পড়ি সেক্ষেত্রে এতো আয়োজন করে গানের মোড়ক উম্মোচনের অনুষ্ঠানের যৌক্তিকতা কী?

আসিফ আকবর: আমি তো কাউকে উপহার হিসেবে একটি গানের লিঙ্ক দিতে পারবো না। আমি কাউকে একটি টেলিফোনের কোড উপহার দিতে পারবো না। সেক্ষেত্রে আমাকে একটি ফিজিকাল অ্যালবাম প্রকাশ করতে হবে। এটা এক ধরনের আনুষ্ঠানিকতা মাত্র, আর কিছুই না। আর গানের অ্যালবাম প্রকাশের পরই মিডিয়ায়, পত্রিকায়, টেলিভিশনগুলোতে নিউজগুলো প্রকাশিত হয়। এটা একজন শিল্পীর জন্য অ্যাডভান্টেজ। কারণ এখন এতো বেশি কাজ হচ্ছে, এতো বেশি সংখ্যায় গান তৈরি হচ্ছে যেখান থেকে বের হওয়ার জন্য যথোপযুক্তভাবে কিছু করার কোনো উপায় নেই। সেক্ষেত্রে অ্যালবাম প্রকাশ করলে একটা ফোকাসে থাকে। এই ফোকাসটার জন্যই আসলে অ্যালবাম প্রকাশ করা।

গ্লিটজ: এখনকার সময়ে প্রতিনিয়ত নতুন শিল্পীরা আসার ফলে অগ্রজরা কি স্পটলাইটের বাইরে চলে যাচ্ছেন বলে মনে হয়?

আসিফ আকবর: না, মোটেই এমন কোনো কিছু হচ্ছে না। এখনও আমরা অনেক ভাল অবস্থানেই রয়েছি। সবাই গান করছেন। এখনকার পৃথিবী উম্মুক্ত। আমরা এখন গুগলগ্রামে বসবাস করি। এখনকার সময়ে কে গান গাইবে আর গাইবেনা, কে প্রমিনেন্ট, কে নতুন, বিখ্যাত কে আর কে অখ্যাত, কার সুরেলা কণ্ঠ কিংবা কে বেসুরে গান করলো- এসব বাছবিচার আর নেই। এখন পুরে বিশ্ব উম্মুক্ত। যে কেউই মানুষের কাছে নিজের গানটি উপস্থাপন করতে পারে। মানুষ গানটি গ্রহণ করলে করবে আর না করলে নাই।

গ্লিটজ: মিউজিক ইন্ড্রাস্ট্রিতে টেলিফোন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর এগিয়ে আসাটাকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

আসিফ আকবর: এক্ষেত্রে একটি মাত্র প্রতিষ্ঠান ঠিকমতো পজিটিভলি কাজ করছে। তারা তাদের ভূলগুলোও শুধরে নিয়েছে। কিন্তু বাকি টেলিফোন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে। তারা কোনো পারিশ্রমিক প্রদান করছেন না। তারা বিভিন্ন শিল্পীকে ও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোকে পাওনা পরিশোধে বিলম্ব করছেন। কেবলমাত্র একটি টেলিফোন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কোনো আসল প্রতিষ্ঠান নাই। সবগুলো ফেইক। সবাই ফেইক বিজনেস করছে। তারা মনোপলি ব্যবসা করছেন।

গ্লিটজ: ব্যয়বহুল মিউজিক ভিডিও নির্মানের বিষয়টি একজন শিল্পীর জন্য কতটুকু ইতিবাচক?

আসিফ আকবর:
এখন তো একটি গান শোনার সাথে সাথে দেখতেও হয়। ইউটিউবে একটি গান আপলোড করলে যতটুকু শুনবে কিন্তু একটা মুভমেন্ট থাকলে তা আরো বেশি দেখা হবে। ভিডিও স্ট্রিমিং এখন একটা কাউন্টেবল স্থানে চলে এসেছে, যেখান থেকে মুনাফা আসা সম্ভব। কাজেই এটা খুবই ইতিবাচক।

গ্লিটজ: পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্যে বাংলাদেশের গানের অবস্থান কোথায় আছে বলে মনে করেন?

আসিফ আকবর: বাণিজ্যিক জায়গা থেকে কলকাতা সফল। পাশাপাশি তারা নিজেদের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে এবং আমাদের কাছ থেকে তারা এখন লোক সংস্কৃতি শিখছে বা আমি বলবো এটা তারা নিজেদের ভেতরে ধারণ করছে। সেই দিক থেকে আমাদের সংগীত ওদের সংগীতের ওপর আগ্রাসান চালাচ্ছে! এই দিক থেকে আমরা বেশ এগিয়ে আছি।

আর কলকাতা হলো একটা শহর, পশ্চিমবঙ্গ একটা প্রদেশ কিন্তু আমরা একটা স্বাধীন দেশ। একটা জিনিস লক্ষ্য করলে দেখবেন ভারতের দক্ষিণেও সারা বিশ্বে দেখানোর মতো ‘বাহুবলি’, ‘মাগাধিরা’র মতো সিনেমা তৈরি হচ্ছে। সেক্ষেত্রে আমাদের এমন একটি উপস্থাপনা দিতে হবে যেন আমাদের বাজারটা বড় হয়। আর এই বাজারটাকে বড় করতে হলে ঐ প্রান্তের বাংলা ভাষাভাষী ও এই প্রান্তের বাংলা ভাষাভাষী সবাইকে একই প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসতে হবে। আর এটা সংগীত ও সিনেমার মাধ্যমেই সম্ভব।

গ্লিটজ: বাংলাদেশের সংগীত কি আদৌ সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের স্বীকার?

আসিফ আকবর: আমাদের যে সংস্কৃতি আছে তা একটি শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাড়িয়ে আছে, দাড়িয়ে থাকবে। আমাদের প্রতিটি জেলায় আলাদা আলাদা সংস্কৃতি রয়েছে। প্রকারভেদে কখনো দেখা যায়, একটি জেলাতেই তিন-চারটে সংস্কৃতি রয়েছে। আমাদের সংগীতের নেটওয়ার্কিংটা অত্যন্ত শক্তিশালী। বতর্মানে যেসব লোক সঙ্গীতগুলো শুনে থাকি - লালন শাহ, হাসন রাজা, শাহ আব্দুল করিম তাদের মতো এমন শিল্পী আর কোথা থেকেই বা আবার আসবে কিংবা তাদেরকে কেউ মেরেও ফেলতে পারবেনা।

হয়তো কালের গর্ভে কিছু গান হারিয়ে যাবে। কিছু গান হয়তো মানুষ গ্রহণ করবে না। কিন্তু গান চলছে গানের গতিতে। গান তৈরি হচ্ছে, শ্রোতারা গান শুনছে, হয়তো আগের মতো গান টিকছে না। কিন্তু কোনো না কোনো ভাবে গান বেরিয়ে আসছে এবং শ্রোতারা গান শুনছে।

গ্লিটজ: আমাদের বাংলা গান কোন দিকে যাচ্ছেন বলে মনে করেন?

আসিফ আকবর: এখন সিস্টেম লস চলছে, পুরোটাই একটা ভ্যাকুয়্যামে রয়েছে। আমি আমার ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে পারদর্শী হলেও অনেক শিল্পীই এই ঝামেলার মধ্যে নিজেকে জড়াতে চাইবেন না। তারা কারিগরী দিকটি ভালমতো বুঝতে চাইবেন না। কারণ একজন শিল্পী কখনোই তা চাইবে না। তবে আস্তে আস্তে এই সচেতনা বাড়াতে হবে। আমি বিশ্বাস করি তা হয়ে যাবে। একটু সময় লাগবে, কারণ নতুন কিছু আসলে তা খাপ খাইয়ে নিতে সময় লাগে। বলতে গেলে আমরা একটা ট্রানজ্যাকশন পিরিয়ডের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, আমরা ভালোর দিকেই যাচ্ছি।