অবিভক্ত বাঙালি ঋত্বিক ঘটক

দেশভাগের বেদনা কখনো ভুলতে পারেননি তিনি। তার সৃষ্টিকর্মে ফিরে ফিরে এসেছে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা বিচ্ছিন্ন হওয়ায় বাস্তুহারা মানুষের অসহনীয় কষ্টের দৃশ্য। দুই বাংলার সাধারণ বাঙালির জীবন সংগ্রাম তিনি অমর করেছেন সেলুলয়েডে। তিনি ঋত্বিক ঘটক, বাংলা চলচ্চিত্রের এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Feb 2016, 05:57 AM
Updated : 6 Feb 2016, 06:28 AM

‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘সুবর্ণরেখা’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এর মতো অসামান্য সৃষ্টিকর্মের সুবাদে বাংলা চলচ্চিত্রে তিনি অমর হয়ে আছেন।

ঋত্বিক ঘটকের জন্ম পুরান ঢাকায় ১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর। তার বাবা সুরেশ চন্দ্র ঘটক ছিলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি নাটক ও কবিতা লিখতেন। বড় ভাই মণীষ ঘটকও বিখ্যাত লেখক। ফলে ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে ওঠেন তিনি। রাজশাহী কলেজের ছাত্র ছিলেন ঋত্বিক ঘটক। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর কলকাতা চলে যান পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। কিন্তু পূর্ব বঙ্গকে এবং বিশেষ করে পুরান ঢাকার জিন্দাবাহারে হৃষিকেষ লেনে তাদের বাসস্থানের কথা তিনি ভুলতে পারেননি কখনো। কলকাতাকে তিনি দেখেছেন ‘বাঙাল’ ও ‘উদ্বাস্তু’র চোখ দিয়ে। তিনি  ১৯৪৮ সালে তার প্রথম নাটক ‘কালো সায়র ‘লেখেন। মঞ্চ নাটকে তিনি ছিলেন বেশ সক্রিয়। ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সদস্য ছিলেন। সে সময় নাটক লিখতেন, অভিনয় এবং পরিচালনাও করতেন। গোগল এবং ব্রেশটের রচনাবলী বাংলায় অনুবাদ করেন তিনি।

নাটকের সূত্রেই ১৯৫১ সালে চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন। নিমাই ঘোষ পরিচালিত ‘ছিন্নমূল’ ছবিতে সহকারী পরিচালকের কাজ করেছিলেন। সিনেমাটিতে অভিনয়ও করেন তিনি। ১৯৫২ সালে ‘নাগরিক’ ছবির মাধ্যমে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৫৮ সালে মুক্তি পায় তার পরিচালিত ‘অযান্ত্রিক’ ও ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’। সুবোধ ঘোষের ছোট গল্প অবলম্বনে নির্মিত হয় ‘অযান্ত্রিক’ ছবিটি। ট্যাক্সি ড্রাইভার বিমল আর তার পুরনো ঝক্করমার্কা গাড়ির মধ্যকার সম্পর্ক ছবির মূল ঘটনা। পরিচালকের মুন্সীয়ানায় এক সময় গাড়িটিকে মনে হতে থাকে মানবিক সত্তাবিশিষ্ট। সম্পূর্ণ নতুন এক দুঃখবোধের জন্ম হয় ছবিটি দেখলে। যন্ত্র সভ্যতায় নিঃসঙ্গ মানুষের সঙ্গী হিসেবে যন্ত্রকেই মনে হতে থাকে অনেক মানবিক। ছবিটি ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষভাবে প্রশংসা কুড়ায়।
‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ একটি শিশুতোষ চলচ্চিত্র। শিবরাম চক্রবর্তির লেখা বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে এই ছবিটি তৈরি করেন ঋত্বিক ঘটক। তবে তিনি কাহিনিতে যোগ করেন নতুন মাত্রা। হাস্যরস থেকে অনেক ক্ষেত্রেই জন্ম হয় গভীর উপলব্ধির। ছবির মূল চরিত্র কিশোর কাঞ্চনের চোখ দিয়ে তিনি দেখেন মমতাহীন কলকাতা শহরকে। ১৯৫৮ সালে তিনি হিন্দি ছবি ‘মধুমতি’র কাহিনিকার হিসেবে বিপুল জনপ্রিয়তা ও প্রশংসা পান। বিমল রায় পরিচালিত এবং দিলিপ কুমার-বৈজন্তিমালা অভিনীত ছবিটির কাহিনি ছিল পুনর্জন্মভিত্তিক যা বাণিজ্যিকভাবে দারুণ সফল হয়েছিল এবং সমালোচকদের প্রশংসাও কুড়ায়। মূলত, এই সিনেমা থেকেই হিন্দি চলচ্চিত্রে পুনর্জন্মভিত্তিক কাহিনির ধারা শুরু হয়।

১৯৬০ সালে মুক্তি পায় ‘মেঘে ঢাকা তারা’। অসামান্য একটি ছবি। পূর্ববঙ্গের এক স্কুল শিক্ষকের পরিবার উদ্বাস্তু হয়ে আসে কলকাতায়। সে পরিবারের বড় মেয়ে নীতার সামান্য চাকরির টাকায় চলে পুরো সংসার। চরম দারিদ্র্য কিভাবে মানুষের মনুষ্যত্বকেও খর্ব করে ফেলে তার করুণ দলিল ‘মেঘে ঢাকা তারা’। ছবির প্রথম দৃশ্যে দেখা যায় নীতা হেঁটে বাড়ি ফিরছে অনেক দূর থেকে। রাস্তায় ছিঁড়ে যায় তার পুরনো চটি জুতো। এই একটি দৃশ্যের মাধ্যমেই পরিচালক ইঙ্গিত দেন তার কঠোর জীবন সংগ্রামের। ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র নীতার ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করেন সুপ্রিয়া দেবী।

উদ্বাস্তু জীবনের কষ্ট, দারিদ্র্য নিয়ে তিনি ১৯৬১ ও ১৯৬২ সালে ‘কোমল গান্ধার’ এবং ‘সুবর্ণরেখা’ নির্মাণ করেন। দুটি ছবিই মানুষের জীবন যন্ত্রণা ও দারিদ্র্যের কষাঘাতকে সার্থকভাবে তুলে ধরে। কিন্তু জীবনঘনিষ্ঠ এই ছবি দুটি ব্যবসায়িকভাবে সফল হয়নি।

ঋত্বিক ঘটক পুনেতে ভারতীয় চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন ইন্সটিটিউটে শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি শিশুতোষ ‘হীরের প্রজাপতি’সহ বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রের কাহিনিকার হিসেবে প্রশংসিত হন।

১৯৬৯ সালে ভারত সরকার ঋত্বিক ঘটককে পদ্মশ্রীতে ভূষিত করে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ঋত্বিক ঘটক তার জন্মভূমিতে আসেন চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য। অদ্বৈত মল্লবর্মণের চিরায়ত উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ অবলম্বনে তার পরিচালনায় নির্মিত হয় এক অসাধারণ চলচ্চিত্র। তিতাস নদীর তীরবর্তী মানুষের জীবন, প্রেম, লোকজ ঐতিহ্য সার্থকভাবে প্রতিফলিত হয় ছবিতে। এটি বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে আছে। সর্বকালের অন্যতম সেরা এই চলচ্চিত্রটি আমাদের অমূল্য সম্পদ।

১৯৭৪ সালে মুক্তি পায় ঋত্বিক ঘটকের শেষ চলচ্চিত্র ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’। এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তিনি যেন খুঁজে ফিরেছেন নিজেকেই। আত্ম-উপলব্ধি ও আত্মবিশ্লেষণের নির্মোহ শিল্পরূপ এই ছবি। এই চলচ্চিত্রের কাহিনিকার হিসেবে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান তিনি।

ঋত্বিক ঘটক বেশ কয়েকটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। এর মধ্যে  ‘দ্য লাইফ অফ দ্য আদিবাসিজ’, ‘ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’, ‘ফিয়ার’, ‘রঁদেভু’, ‘আমার লেনিন’, ‘পুরুলিয়ার ছৌ’, ‘দুর্বার গতি পদ্মা’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

১৯৭৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি এই মহান বাঙালি চলচ্চিত্রকার মৃত্যুবরণ করেন। ‘মেঘে ঢাকা তারা’ এবং ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ এর মাধ্যমে  বাঙালির জনজীবনের অসাধারণ রূপকার হিসেবে তিনি চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।