দ্বিতীয় দিনের শুরুতেই বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের তরুণ শিক্ষার্থী অভিজিৎ কুন্ডু ধ্রুপদ পরিবেশন করেন রাগ ভূপালিতে। তার সঙ্গে পাখোয়াজে সঙ্গত করেন প্রতাপ আওয়াদ।
উৎসবের নিয়মিত শিল্পী ধ্রুপদিয়া পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকর দিনটাকে অন্যরকম করে তুললেন রাগ ইমন পরিবেশনার মাধ্যমে। জনপ্রিয় ধারার আধুনিক সংগীতকাররা বহুল প্রচলিত রাগে পরিণত করেছেন ইমনকে। কিন্তু এই রাগটি যে লঘু মেজাজের হলেও প্রার্থনার, ভক্তিরস প্রদর্শনের উপায়, তাই মনে করিয়ে দিলেন ধ্রুপদিয়া উদয় ভাওয়ালকর।
পণ্ডিত ভাওয়ালকর নোম-তোমে দীর্ঘ আলাপে স্বর ও সুরকে বশ করে কখনো পাঠালেন আকাশে কখনো বা মিশিয়ে দিলেন মাটিতে, মাটির নিচ থেকে আবার তুলেও আনলেন শ্রোতাদের। অন্যান্য বারের মতোই শিল্পীর কণ্ঠের গাম্ভীর্যতা অক্ষুন্ন ছিল, সঙ্গে যোগ হয়েছে রাগ ইমনের সরল-সম্মোহনী সুর। শেষে আবার রাগ আরানায় শিবস্তুতি শুনিয়ে ধ্রুপদের তাৎপর্য বুঝিয়ে দিয়েছেন। তার সঙ্গে যন্ত্রে সঙ্গত করেন প্রতাপ আওয়াদ ও গোবিন্দ কুন্ডু।
উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন একটি যন্ত্র বীণা। কয়েক প্রকারের মধ্যে একটি, রুদ্রবীণার সঙ্গে উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসবের দ্বিতীয় আসরেই শ্রোতাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন বাহাউদ্দিন ডাগর । এবার একই গোত্রীয় আরেকটি জনপ্রিয় যন্ত্র স্বরস্বতী বীণা বাজিয়ে শোনালেন জনপ্রিয় বীণাবাদক জয়ন্তী কুমারেশ। প্রায় ঘণ্টা খানেকের পরিবেশনায় জয়ন্তী কুমারেশের হাতে বীণার সুর প্রায় সময়ই পাশ্চাত্যের যন্ত্র গিটারের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। গিটারের স্বরের চলন ও সুর অনেকটাই এরকম। জয়ন্তী প্রথমে পরিবেশন করেন রাগ কাফি, এরপর রাগ বেহাগ এবং সবশেষে শোনান দক্ষিনী লোক সুর। তাকে যন্ত্রে সঙ্গত করেন লতিফুন জুলিও, আর শাঙ্করনারায়ন ও শ্রী কৃষ্ণাস্বামী।
পণ্ডিত সুরেশ তালওয়ালকর এ বছর তার মেয়ে সাওয়ানি তালওয়ালকরকে সঙ্গে নিয়ে মঞ্চে ওঠেন। সাওয়ানি সম্প্রতি উচ্চাঙ্গসংগীতের ব্যান্ড ‘সখী’র অংশ হয়েছেন, যার প্রত্যেক সদস্যই নারী। এ ব্যান্ডের অন্যতম উদ্যোক্তা কৌশিকী চক্রবর্তী। আর পণ্ডিত সুরেশ তালওয়ালকর বেঙ্গল পরম্পরার মাধ্যমে এদেশের নবীন প্রতিভাকে তৈরি করার কাজে নিয়োজিত করেছেন নিজেকে।
প্রথমেই ঝাপতাল পরিবেশনা করেন পণ্ডিত সুরেশ তালওয়ালকর ও তার দল। পরবর্তীতে আরো শোনান প্রখ্যাত তবলিয়া আল্লারাখার সৃষ্ট কায়দা, যা রাগ বা তাল মূর্ছনার সমার্থক বলে জানান পণ্ডিত সুরেশ তালওয়ালকর। বন্দিশসহ ত্রিতালে রাগ সোহানির মাধ্যমে পরিবেশনা শেষ হয় তাদের। তবলার পুরো পরিবেশনাটি ছিল দারুণ উপভোগ্য। বাবা-মেয়ের সঙ্গে যন্ত্রে সঙ্গত করেন ওমকার দালভি, ভিনয় রামাদাশান, অজয় যোগলেকর।
এবারের উৎসবের চমকগুলোর একটা হলো জনপ্রিয় ও প্রবীণ কর্ণাটকী সংগীতজ্ঞ ড. বালামুরালি কৃষ্ণার সঙ্গে বাঙালি বাঁশি শিল্পী পণ্ডিত রণু মজুমদারের যুগলবন্দী। অনেকদিন ধরেই তাদের যুগল পরিবেশনার সাক্ষী হয়েছে বিশ্ববাসী, এবার সেই সুযোগটি পেলো বাংলাদেশ।
মঞ্চে পা রাখতেই ৮৫ বছর বয়সী ড. বালামুরালী কৃষ্ণাকে দাড়িয়ে সম্মান জানান দর্শক-শ্রোতা। প্রথমে তিনি নিজের রচিত একটি বন্দিশ শোনান। পরে রণু মজুমদারের সঙ্গে তিনতাল ও আদিতালে রাগ আভোগী কানারায় যুগলবন্দী এবং একটি তিলানা পরিবেশন করেন। তিন গুণীর সঙ্গে আরো সঙ্গত করেন ডি আর কৃষ্ণাকুমার, ডি আর কে কৃষ্ণাকুমার, বিভি রাঘভেন্দ্র রাও ও এন সুব্রামানিয়াম।
শান্তিনিকেতনে বেড়ে উঠেছেন এস্রাজ বাজিয়ে শুভায়ু সেন মজুমদার। জন্মসূত্রেই তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সম্পর্কিত, আবার সাঙ্গিতিক ভাবেও! বললেন তার হাতের যন্ত্রটি বাঙালির কাছে প্রথম তুলে ধরেছিলেন কবিগুরুই। তরুণ এই শিল্পী তাই রবীন্দ্ররচনা শোনাতে ভোলেননি। এর আগে তিনি রাগ খাম্বাজ পরিবেশন করেন।
এদিনের সবশেষ শিল্পী হিসেবে অজয় চক্রবর্তী মঞ্চে দাড়িয়েই হাতজোড় করে নমস্কার জানান সবাইকে, প্রত্যুত্তরে দর্শকদেরও একই কায়দা অবলম্বন করতে দেখা গেলো। তিনি রাগ বৈরাগীতে খেয়াল পরিবেশন করেন প্রথমে। খেয়ালের তিনটি বন্দিশ যার প্রথমটিতে ছিল আল্লাহ প্রেমের কথা। যোগিয়া রাগাশ্রয়ী বাংলা গান ‘যামিনী যে হলো ভোর’ শোনান সবশেষে। তাকে যন্ত্র সঙ্গত করেন সত্যজিত তালওয়ালকর, অজয় যোগলেকর ও অনল চট্টোপাধ্যায়।
অনুষ্ঠান শেষের দিকে জানা গেলো আগামী দিনটির সূচনা হবে বাংলাদেশি নৃত্যশিল্পী ওয়ার্দা রিহাবের দলের নৃত্য পরিবেশনার মাধ্যমে।
আয়োজকরা আরো জানালেন, এ বছর অংশ নেওয়া দুশতাধিক শিল্পীর মধ্যে বাংলাদেশির সংখ্যা প্রায় ৮০ জন, যাদের অধিকাংশেরই বয়স ৩০ বছরের নিচে।
ছবি: জাহাঙ্গীর আলম