বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের পর্দা উঠলো

অগ্রহায়ণে নবান্নের দেশে শীত আসি আসি করেও জমে উঠছে না। এদিকে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব চতুর্থবারের মতো এসে গেছে। হালকা কুয়াশার চাদর গায়ে শুক্রবার সন্ধ্যায় তারই আবাহনী গাইলেন আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত উপমহাদেশীয় শিল্পীরা।

চিন্তামন তুষারচিন্তামন তুষারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Nov 2015, 09:55 AM
Updated : 28 Nov 2015, 09:58 AM

প্রতি বছরের মতোই নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে আয়োজিত ‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব’-এর চতুর্থ আসর শুক্রবার সন্ধ্যায় শুরু হয়েছে ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে। প্রথমদিনেই ভোর অব্দি সংগীতপ্রেমীদের জাগিয়ে রাখেন বিদুষী বোম্বে জয়শ্রী, কৌশিকী চক্রবর্তী, মিনু হক, কুশল দাস, রাহুল শর্মা এবং তাদের সার্থক পদাঙ্ক অনুসরণকারী কয়েক খুদে শিল্পী।

এবারের উৎসবের পর্দা উঠেছে বাংলাদেশের বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী ও নির্দেশক মিনু হকের পল্লবী ড্যান্স গ্রুপের ভরতনাট্যম পরিবেশনার মাধ্যমে। ২৪ শিল্পীর নূপুরের ছন্দে সন্ধ্যার আলস্য দূর হতেই মঞ্চে ওঠেন বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের ছয় খুদেসহ আট তবলাশিল্পী; যাদের সর্বকনিষ্ঠের বয়স মাত্র সাত। পণ্ডিত সুরেশ তালওয়ালকরের তত্বাবধানে তারা তবলা কীর্তন পরিবেশন শুরু করায় হালকা কুয়াশায় ছেয়ে যাওয়া স্টেডিয়ামে উষ্ণতা ছড়িয়ে পরে।

তবলা কীর্তন শেষ হলে মঞ্চে ওঠেন অধ্যাপক ড. অসিত রায়ের নেতৃত্বে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগ। ধ্রুপদিয়া ওস্তাদের আট শিষ্য-শিষ্যার দলটি স্বভাবতই ধ্রুপদ পরিবেশন করেন। তাদের পরিবেশনা ছিল রাগ মালকোষ। চৌতাল ও সুলতালে দুটি সনাতন ধ্রুপদ পরিবেশন করে দলটি।

এদেশে উন্মুক্ত মঞ্চে প্রথম কোনো দক্ষিণ ভারতীয় নারী বাঁশি শিল্পী হিসেবে মঞ্চে পা রাখেন জয়াপ্রদা রামামূর্তি। স্বাভাবিক দৈর্ঘ্য এবং ছিদ্রের বাঁশি হাতে জয়াপ্রদা কর্ণাটকি ধারায় প্রথমেই শোনান রাগ হংসধ্বনি। সংশ্লিষ্ট সংগীতকারের নাম উল্লেখ করে চড়া সুরেই শুরুটা করেন তার। এরপর একে একে শুনিয়েছেন রাগ হিন্দোলম, রাগ বেহাগের রবীন্দ্রসংগীত, রাগ আহির ভৈরব, দেশ রাগে রবীন্দ্রসংগীত ‘এসো শ্যামল সুন্দর’।

জয়াপ্রদা জানালেন, যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলসে বসে ১৭ বছর আগে রবীন্দ্রসুর শিখেছিলেন পণ্ডিত রবীশঙ্কর ও তার দক্ষিণী স্ত্রী সুকন্যা রাজনের কাছ থেকে।

গুণী পিতা শিবকুমার শর্মার সার্থক উত্তরাধিকার রাহুল শর্মার সন্তুরে টঙ্কার আগেও শুনেছে ঢাকার শ্রোতা। তবে এবারের পরিদবেশনাটা অন্যবারের সঙ্গে একটু পার্থক্য রচনা করবে নিশ্চিতভাবেই। আত্মবিশ্বাসী এবং প্রলম্বিত আলাপ শেষে নিখুঁত জোড়। সবশেষে ঝালায় পৌছে আরো টনটনে অনুভূতি ‍সৃষ্টি করে কখনো ডাবল স্ট্রোক, কখনো বাহাতের কারুকাজ, কিছুই বাকি রাখেননি তরুণ এই সন্তুর বাজিয়ে। তিনি রাগ বাচস্পতি পূর্ণাঙ্গ এবং ঝাপতাল ও ত্রিতালে গৎ বাজিয়ে শোনান আরো।

এরপরই মঞ্চে আর্বিভূত হন হালের জনপ্রিয় এবং তরুণ উচ্চাঙ্গসংগীত শিল্পী বিদুষী কৌশিকী চক্রবর্তী। পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী তনয়ার প্রথম পরিবেশনা ছিল রাগ মালকোষ, মধ্যম দৈর্ঘ্যের আলাপে সূক্ষভাবে আঁশ মিশিয়ে গেলেন শুধু। ভরাট কণ্ঠে একেই বুঝি বলে ঠাস বুনোট! পিতার মতোই কখনো খাদ থেকে তারা, কখনো তারা থেকে খাদে আসা যাওয়া করলেন পেলব স্বরগুলো বাছাই করে অথবা স্বরগুলোতে নিজস্ব পেলবতা মিশিয়ে।

কৌশিকী এক ফাঁকে বললেন, বড়ে গোলাম আলী খাঁ সাহেবের উদ্ভাবন পাঁচ রাগের এই মিশ্রণটি নিতান্তই পৌরুষিক কাজ। তবু তিনি সাহস করছেন ‘পৃথিবীর সেরা শ্রোতাদের’ জন্য। পরক্ষণেই শুরু হলো তার ‘পৌরুষিক’ কায়দায় সপাটতান, গমকতান ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকারের তানের দক্ষতা প্রদর্শন। এবার যেন পুরোপুরি অন্য মেজাজ কৌশিকীর।

পরবর্তীতে একটি দাদরা এবং রাগ ও রবীন্দ্রসংগীতের একটি মিশ্রণ শোনালেন কৌশিকী। মিশ্রণটি মূলত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী শ্রাবণী সেনের সঙ্গে যৌথভাবে প্রকাশিত অ্যালবামের।

উৎসবে প্রায় নিয়মিত হয়ে উঠেছেন সেতার শিল্পী কুশল দাস। নিপাট বাদনশৈলীর জন্য পরিচিত এই শিল্পী কখনো আবার তন্দ্রাহরার ভূমিকাও নিতে পারেন। তিনি এদিন পরিবেশন করেন রাগ হেমন্ত ও পাহাড়ি রাগের একটি ধুন।

আকণ্ঠ সংগীত সুধা পানে অভ্যস্ত শ্রোতাদের শেষ চুমুকের প্রশান্তি জাগাতে সবশেষে মঞ্চে ওঠেন বিদুষী বোম্বে জয়শ্রী। কার্ণাটকি ধারার এই শিল্পী শুরু থেকেই আদিতালে রাগ হংসধনি, মায়ামালভগৌল, কলাবতী, হংস নন্দী, মিরার ভজনে শ্যাম কল্যাণ এবং দেশ রাগে তিল্লানা পরিবেশন করেন। তার পরিবেশনার শুরু থেকেই দক্ষিণী তালযন্ত্র ঘটম ও মৃদঙ্গমে বুঁদ হয়ে যান শ্রোতারা এবং বেহালায় নিখুঁত শিল্পীর স্বরানুগমনের সঙ্গে সঙ্গে তোম, নোম কখনও বন্দিশ শুনতে শুনতে সুরের জাদুতে সমাপ্তি ঘটে প্রথম দিনের।

চিত্রশিল্পী কাইয়ূম চৌধুরীর প্রয়ানের সাক্ষী হয়েছে এই উৎসব। গত বছরের তৃতীয় আসরের চতুর্থ দিনের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য শেষে মঞ্চেই অসুস্থ হলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে এই উৎসব চত্বরে আর ফেরেননি তিনি। আগের উৎসবগুলোতেও তাকে দেখা গেছে নিয়মিতভাবে। চতুর্থ আসর উৎসর্গ করা হয়েছে তারই স্মৃতিতে।

উৎসবের উদ্বোধন করতে আসা বিশিষ্ট ব্যাক্তিদের কণ্ঠে ঝড়ে পড়লো প্রয়াত শিল্পীর স্মৃতিকাতরতা। এবারেও প্রধান অতিথি হিসেবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী ‍আসাদুজ্জামান নূর, স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী, ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম আর এফ হোসেন, রবি আজিয়াটা লিমিটেডের চিফ অপারেটিং অফিসার মাহতাব উদ্দিন আহমেদ এবং অতি অবশ্যই উৎসব আয়োজক বেঙ্গল ফাউন্ডশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের।

অনুষ্ঠান পাঁচদিন চালু রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ সিদ্ধান্তবলে অনুমতি দেওয়ায় বিশেষ ধর্নবাদ জ্ঞাপন করেন আবুল খায়ের।

একইসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বাংলাদেশের জেলাভিত্তিক সংস্কৃতিবৈচিত্র্য নিয়ে ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া বাংলা উৎসবের আনুষ্ঠানিক ঘোষণাও দেন।

আগামীকাল শনিবার উৎসবের দ্বিতীয় দিন শুরু হবে সন্ধ্যা ৭টায়। চলবে পরদিন ভোর ৫টা পর্যন্ত। দ্বিতীয় দিনের উৎসবে অংশ নেবেন ধ্রুপদিয়া অভিজিৎ কুন্ডু, বীণাবাজিয়ে জয়ন্তী কুমারেশ, বেঙ্গল পরম্পরার তরুণ খেয়ালিয়া সুস্মিতা দেবনাথ সুচি, ধ্রুপদিয়া পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকর, তবলিয়া পণ্ডিত সুরেশ তালওয়ালকর, কার্ণাটকি ধারার শিল্পী ড. বালা কৃষ্ণা ও বাঁশি শিল্পী রণু মজুমদারের যুগলবন্দী, এস্রাজ বাজিয়ে শুভায়ূ সেন মজুমদার এবং পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী।

আয়োজরকরা জানান, পাঁচদিনের এই উৎসবের এবারে অংশ নিচ্ছেন প্রায় দুশ সংগীত ও নৃত্যশিল্পী।