জিনাত আমান: যৌনতাকে শিল্পে উন্নীত করেছিলেন যিনি

‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ ছবির রূপা, ‘ইয়াদো কি বারাত’- এর সুনিতা, ‘ইনসাফ কি তারাজু’র ভারতী, ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ এর জেনিস,কিংবা ‘ডন’ এর রোমা - যার কথাই বলা হোক না কেন, চোখে ভেসে ওঠে এক সাহসী ও আবেদনময়ী নারীর ছবি। তিনি জিনাত আমান।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Nov 2015, 06:25 AM
Updated : 19 Nov 2015, 06:25 AM

ষাটের দশকের শেষ পর্যন্ত হিন্দি ছবিতে যৌনতার প্রতীক হতেন মূলত ভ্যাম্প বা খলনায়িকা কিংবা পার্শ্ব-চরিত্রের অভিনেত্রীরা।

নায়িকারা কেবল ছিলেন নিষ্পাপ সৌন্দযর্ের সারল্যমণ্ডিত। কিন্তু সেই ইমেজ ঝেড়ে ফেলেন জিনাত আমান। সনাতন ভারতীয় নারীর পরিবর্তে তিনি পর্দায় আসেন সাহসী, প্রতিবাদী, কখনো বখাটে, কখনো লাস্যময়ী হয়ে। তিনি হয়ে ওঠেন যৌনতার প্রতীক। তবে কেবল শরীরী আবেদন নয়, অভিনয়গুণের জন্যও তাকে মনে রাখতে হবে হিন্দি সিনেমাপ্রেমীদের।

জিনাত আমানের জন্ম ১৯৫১ সালের ১৯ নভেম্বর মুম্বাইয়ে। তার বাবা আমানুল্লাহ খান চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার ছিলেন। জিনাত আমানের বয়স যখন ১৩ বছর তখন তার বাবার মৃত্যু হয়। তার মা একজন জার্মান নাগরিককে বিয়ে করে জার্মানিতে চলে যান। মায়ের সঙ্গে জিনাত আমানও সেখানে যান।

জিনাত আমান সাউথ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, কিন্তু স্নাতক হওয়ার আগেই ভারতে চলে আসেন। মুম্বাইয়ে ফেমিনা পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এর পর মডেলিংয়ে ক্যারিয়ার গড়ে তোলেন। মিস ইন্ডিয়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে তিনি সেকেন্ড রানার্স আপ হন। ১৯৭০ সালে তিনি মিস এশিয়া প্যাসিফিক পুরস্কার জয় করেন।  প্রথম ভারতীয় নারী হিসেবে তিনি এই সুন্দরী প্রতিযোগিতায় শিরোপা জয় করেন।

১৯৭১ সালে ‘হালচাল’ ছবিতে ছোট্ট একটি ভূমিকায় অভিনয়ের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রের পর্দায় তার যাত্রা শুরু হয়। ওই বছরই ‘হাঙ্গামা’ছবিতে অভিনয় করেন তিনি।  ছবি দুটি সফল হয়নি। চলচ্চিত্রে ক্যারিয়ার গড়ার আশা ছেড়ে তিনি তখন জার্মানিতে মায়ের কাছে চলে যাবার কথা ভাবছিলেন। সে সময় দেব আনন্দ ‘হরে রাম হরে কৃষ্ণ’ ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ দেন তাকে। এই ছবিতে এক বখে যাওয়া মাদকাসক্ত হিপ্পি তরুণীর ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। সিনেমায় তাকে দেখা যায় ভারতীয় বংশোদ্ভূত জেনিসের রূপে যার আসল নাম জাসবির এবং যে কানাডা থেকে নেপালে এসেছে। সিনেমায় তার চরিত্রটি ছিল দেব আনন্দের বোনের। এই ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য প্রথম প্রস্তাব দেয়া হয় অভিনেত্রী জাহেদাকে। কিন্তু তিনি দ্বিতীয় নায়িকা হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়ায় শেষ মুহূর্তে সুযোগ পান জিনাত আমান। এই ছবি তাকে এনে দেয় বিপুল খ্যাতি। ‘দম মারো দম’ গানের সঙ্গে তার অভিব্যক্তি ছিল অনবদ্য। ফিল্ম ফেয়ার আসরে পার্শ্ব-চরিত্রে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার ঘরে তোলেন তিনি। বেঙ্গলি ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন তাকে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার দেয়। রাতারাতি তারকা হয়ে যান তিনি।

এরপর দেব আনন্দের সঙ্গে জুটি বেঁধে অনেক ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। ‘হীরা পান্না’, ‘ইশক ইশক ইশক’, ‘প্রেম শাস্ত্র’, ‘ওয়ারেন্ট’, ‘ডার্লিং ডার্লিং’, ‘কালাবাজার’ ছবিতে তার অভিনয় প্রশংসিত হয়।

‘প্রেম শাস্ত্র ’ছবিতে তার চরিত্রটি ছিল জটিল। মায়ের সাবেক প্রেমিকের প্রেমে পড়া এক তরুণীয় ভূমিকায় তার অভিনয় ছিল দারুণ।

১৯৭৩ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ইয়াদো কি বারাত’ ছবিতে নতুন নায়ক বিজয় আরোরার বিপরীতে জিনাত আমান ছিলেন অনেক বেশি উজ্জ্বল। বিশেষ করে ‘চুরালিয়া হ্যায় তুমনে যো দিলকো’ গানের সঙ্গে তার দুষ্টু অভিব্যক্তি দর্শকদের হৃদয় চুরি করে নেয়। গিটার হাতে আধুনিক তরুণীর বেশে পর্দায় দেখা দেন তিনি।

১৯৭৮ সালে মুক্তি পায় রাজ কাপুরের নির্মিত ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’। এ ছবিতে শশী কাপুরের বিপরীতে অভিনয় করেন জিনাত আমান। ছবিতে দৈহিক সৌন্দর্য ও মনের সৌন্দর্যের মধ্যে চিরাচরিত প্রভেদ ও দ্বন্দ্ব তুলে ধরা হয়। মনের সৌন্দর্য ও গুণ ছাপিয়ে যায় করূপ। ছবিটির বক্তব্য নিঃসন্দেহে ছিল চমৎকার। কিন্তু এ ছবিতে এক গ্রামীণ নারীর ভূমিকায় জিনাতকে দেহের আবরণ অনেকটাই উন্মুক্ত করতে হয়েছিল। ফলে রক্ষণশীলদের তোপের মুখে পড়েন তিনি। তবে ছবিতে তার অভিনয়ও ছিল দুর্দান্ত। চিত্র সমালোচকরা মন্তব্য করেন যে অভিনয় প্রতিভায় তিনি যৌনতাকে শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করেছেন। ছবিটি বাণিজ্যিক সাফল্যের  পাশাপাশি তাকে এনে দেয় ফিল্ম ফেয়ার আসরে সেরা অভিনেত্রীর মনোনয়ন। তিনি হয়ে ওঠেন ভারতীয় চলচ্চিত্রে যৌনতার প্রতীক।

সে বছরই মুক্তি পায় সুপার হিট ছবি ‘ডন’। অমিতাভ বচ্চনের বিপরীতে এই ছবিতে সাহসী, শক্তিময়ী এক নারীর চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। ভাইয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধকামী রোমা চরিত্রে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ মানানসই। অ্যাকশন নায়িকার চরিত্রে সাফল্য তার ক্যারিয়ারে ভিন্ন মাত্রা এনে দেয়।

‘ইনসাফ কা তারাজু’ ছবিতে ধর্ষণের শিকার এক নারীর ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করেন তিনি। সে সুবাদে ফিল্মফেয়ারে সেরা অভিনেত্রীর মনোনয়ন পান।

‘কুরবানি’ ছবিতে জিনাত আমান ছিলেন আধুনিক এক নৃত্যশিল্পীর ভূমিকায় দারুণ সফল। ‘লায়লা ও লায়লা’ গানের সঙ্গে তার নাচ এবং আবেদনময় অভিনয় ছিল দুর্দান্ত।

নায়িকা চরিত্রে যৌন আবেদন যুক্ত করার দিক থেকে জিনাত আমান ছিলেন পথ প্রদর্শক। তার সময়ের সব সেরা নায়কদের বিপরীতেই অভিনয় করেছেন। ধর্মেন্দ্র, জিতেন্দ্র, অমিতাভ বচ্চন, শশী কাপুর, শত্রুঘ্ন সিনহা সকলের বিপরীতেই সফল ছিলেন তিনি। ‘লাওয়ারিস’, ‘দোস্তানা’ ইত্যাদি ছবিতে অমিতাভ বচ্চনের বিপরীতে তার পর্দা রসায়ন ছিল দারুণ।

‘আলীবাবা ৪০ চোর’ ছবিতে অভিনয় করে তিনি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে ভীষণ জনপ্রিয়তা পান। ছবিতে মূল নায়িকা ছিলেনহেমা মালিনী। জিনাত আমান ছিলেন আলিবাবার ভাই কাশেমের স্ত্রীর ভূমিকায়। ছবিটি ছিল সোভিয়েত-ভারত যৌথ প্রযোজনার। 'খাতুব্বা' শিরোনামে একটি গানের সঙ্গে দারুণ আবেদনময় নাচ পরিবেশন করেন তিনি। এই নাচ তাকে সোভিয়েত ইউনিয়নে দারুণ জনপ্রিয়তা এনে দেয়। এই ছবিটি আশির দশকে ঢাকাতে প্রদর্শিত হয়েছিল এবং বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

ব্যক্তি জীবনে অনেক বারই প্রেমের গুঞ্জনের জন্ম দিয়েছেন তিনি।

পাকিস্তানি ক্রিকেট তারকা ইমরান খানের সঙ্গে তার সম্পর্কের বিষয়টি আশির দশকের শুরুর দিকে বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।

জিনাত আমান ১৯৮৫ সালে বিয়ে করেন বলিউড অভিনেতা, প্রযোজক ও পরিচালক মাজহার খানকে।  তাদের বিবাহিত জীবন খুব একটাসুখের ছিল না। তাদের বিচ্ছেদের গুজব বহুবার শোনা গেছে। জিনাত আমান বিচ্ছেদের মামলাও দায়ের করেছিলেন। তবে তার আগেই ১৯৯৮ সালে  মাজহার খানের মৃত্যু হয়। এই দম্পতির দুই সন্তান রয়েছে। জিনাত আমান আর বিয়ে করেননি।

বলিউডে আবেদনময়ী নায়িকার অভাব নেই। কিন্তু জিনাত আমান সব সময়ই তার অনন্য অবস্থানে রয়ে যাবেন।