রোমান্টিক প্রেমিক রক হাডসন

রক হাডসনকে বলা চলে হলিউডের ইতিহাসে অন্যতম সুদর্শন নায়ক। সুঅভিনেতা হিসেবে খ্যাতি মিলেছিল। তবে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন আকর্ষণীয় অবয়বের জন্য। হলিউড তারকাদের মধ্যে তিনিই প্রথম এইডস আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মৃত্যুর পরও তাকে নিয়ে চলে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ ও মামলার পালা।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Oct 2015, 10:44 AM
Updated : 2 Oct 2015, 10:44 AM

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে হলিউডের অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেতা ছিলেন রক হাডসন। বিশেষ করে ‘কাম সেপ্টেম্বর’, ‘নেভার সে গুডবাই’, ‘লাভার কামব্যাক’ ‘সেন্ড মি নো ফ্লাওয়ার্স’ এর  মতো রোমান্টিক ছবিতে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এলিজাবেথ টেলর, ডোরিস ডে, জিনা লোলো ব্রিজিতা, জুলি অ্যান্ড্রুজের মতো নায়িকাদের সঙ্গে তার পর্দা-রসায়ন ছিল দুর্দান্ত। শুধু চলচ্চিত্রেই নয় টেলিভিশনেও তার ক্যারিয়ার ছিল সফল।

রক হাডসনের জন্ম ১৯২৫ সালের ১৭ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়ে। তার প্রকৃত নাম রয় হ্যারল্ড স্কেরার জুনিয়র। মা ছিলেন টেলিফোন অপারেটর। ত্রিশের মহামন্দার সময় তার বাবা স্ত্রী-সন্তান ত্যাগ করে চলে গেলে মা আবার বিয়ে করেন। সৎ বাবা ওয়ালেস ফিটজেরাল্ড রয়ের পদবি বদলে ফিটজেরাল্ড করে দেন। শৈশব কেটেছে বেশ দারিদ্র্যের মধ্যে। পড়ালেখার পাশাপাশি খবরের কাগজ বিক্রি, গলফ ক্লাবে সহায়তাকারীর চাকরিসহ বিভিন্ন কাজ করতে হয়েছে। স্কুলে তিনি ছিলেন লাজুক এক ছেলে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নৌবাহিনীর প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। যুদ্ধ শেষে ১৯৪৬ সালে তিনি লস এঞ্জেলসে যান এবং অভিনেতা হওয়ার জন্য সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগে ভর্তি হন। লেখাপড়ার পাশাপাশি ট্রাক চালানোর কাজ করতেন। অভিনয়ে সুযোগ খুঁজছিলেন তিনি। এই সময় তিনি নিজের ছবি পাঠান হেনরি উইলসন নামে একজন প্রতিভা অন্বেষণকারী ব্যবসায়ীর কাছে। হেনরি উইলসন তার নায়কোচিত চেহারা ও সৌষ্ঠব দেখে তাকে প্রতিষ্ঠিত করার কাজ হাতে নেন। উইলসনই তার নাম রাখেন রক হাডসন। যদিও রক হাডসন নিজের এই নামটি কখনো পছন্দ করেননি তবু এই নামেই বিশ্বব্যাপী খ্যাতি পান তিনি।

 ১৯৪৮ সালে ‘ফাইটার স্কোয়াড্রন’ ছবিতে ছোট্ট একটি ভূমিকায় সুযোগ পান হাডসন। ছবিতে এক লাইনের একটি সংলাপ বলতে ৩৮বার টেক নেয়ার প্রয়োজন হয়েছিল তার। এর পর অভিনয়, নাচ, গান, ঘোড়ায় চড়া, তলোয়ার খেলাসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন যাতে অভিনেতা হিসেবে সাফল্য আসে। এত পরিশ্রম অবশ্য বৃথা হয়নি। তার দীর্ঘ সুগঠিত দেহ ও সুন্দর চেহারা  পরিচালকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৩ সালের মধ্যে ২৫টির বেশি ছবিতে পার্শ্ব-চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। ফিল্মি ম্যাগাজিনগুলোতে তিনি ছিলেন প্রিয় মুখ।

১৯৫৪ সালে ‘ম্যাগনিফিসেন্ট অবসেশন’ ছবিতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করে বিপুল জনপ্রিয়তা পান রক হাডসন। তরুণীরা তার অটোগ্রাফ সম্বলিত ছবির জন্য পাগল হয়ে ওঠে। তিনি হয়ে ওঠেন আধুনিক মার্কিন তরুণ প্রেমিকের প্রতীক যিনি প্রেমিকার মন জয় করতে দুঃসাহসী কাজে প্রস্তত।

১৯৫৬ সালে ‘জায়ান্ট’ ছবিতে এলিজাবেথ টেলরের বিপরীতে নায়কের ভূমিকায় তুমুল জনপ্রিয়তা পান হাডসন। তাদের পর্দা রসায়ন ছিল অনবদ্য। অস্কারে সেরা অভিনেতা বিভাগে প্রথম মনোনয়ন পান এ ছবির সুবাদেই। এলিজাবেথ টেলরের সঙ্গে তার বন্ধুত্বের সূচনা এ ছবি থেকেই। আজীবন তারা ছিলেন পরস্পরের ভাল বন্ধু।

একের পর এক মুক্তি পায় রক হাডসন অভিনীত সাড়া জাগানো ছবি, ‘অল দ্যাট হেভেন অ্যালাউস’, ‘বেঙ্গল ব্রিগেড’, ‘ক্যাপ্টেন লাইটফুট’, ‘ওয়ান ডিজায়ার’, ‘টারনিশ্ড এঞ্জেলস’, ‘রিটেন অন দ্য উইন্ড’, ‘নেভার সে গুডবাই’। পর্দায় রোমান্টিক প্রেমিকের ভূমিকায় হলিউডে চিরকালীন স্থান দখল করে নেন তিনি। সেই সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক এবং যুদ্ধফেরত বীরের ভূমিকাতেও জনপ্রিয়তা পান। এ ছবিগুলো তাকে সুঅভিনেতা হিসেবেও প্রতিষ্ঠা এনে দেয়।

১৯৫৭ সালে মুক্তি পায় ‘আ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস’। এ ছবিতে অভিনয়ের সিদ্ধান্ত ছিল রক হাডসনের জন্য একটি বড় ভুল। ছবিটি বক্স-অফিসে ব্যর্থ তো হয়ই তার অভিনয়ও সমালোচিত হয়। অথচ এ  ছবির জন্য ‘সায়োনারা’, ‘ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই’, ‘বেনহার’-ছবিতে প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব হাতছাড়া করেছিলেন হাডসন।

তবে তার জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি। বরং ষাটের দশকে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিগুলোর সুবাদে তিনি সারা বিশ্বেই জনপ্রিয়তা পান। ‘টোয়াইলাইট ফর দ্য গডস’, ‘দিস আর্থ ইজ মাইন’, ‘পিলো টক’, ‘কাম সেপ্টেম্বর’, ‘লাভার কামব্যাক’, ‘ম্যানস ফেভারিট স্পোর্ট’, ‘টোব্রুক’, ‘সেন্ড মি নো ফ্লাওয়ার্স’সহ অসংখ্য ব্যবসাসফল রোমান্টিক ছবিতে অভিনয় করে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছান তিনি। ৭০টিরও বেশি ব্যবসাসফল ছবিতে অভিনয় করেছিলেন হাডসন।  তার অভিনীত  অন্যান্য ছবির মধ্যে ‘ব্লাইন্ড ফোল্ড’, ‘ডার্লিং লিলি’, ‘দ্য লাস্ট সানসেট’, ‘আইস স্টেশন জেবরা’, ‘এমব্রায়ো’, ‘অ্যাভালান্শ’, ‘দ্য অ্যাম্বাসেডর’ ইত্যাদি দারুণ জনপ্রিয়তা পায়।

টিভিতেও তিনি ছিলেন জনপ্রিয় অভিনেতা ও উপস্থাপক। ‘ম্যাকমিলান অ্যান্ড ওয়াইফ’, ‘হুইলস’, ‘ডাইনেস্টি’সহ বিভিন্ন জনপ্রিয় টিভি সিরিয়ালে অভিনয় করেন তিনি। আশির দশকে বিটিভিতে রক হাডসন অভিনীত ‘হুইলস’ এবং ‘ডাইনেস্টি’ টিভি সিরিয়াল দুটি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

১৯৮৫ সালের ২ অক্টোবর মাত্র ৫৯ বছর বয়সে মৃত্যু হয় রক হাডসনের। তিনি এইডসে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং এ সংক্রান্ত বিভিন্ন জটিলতায় মারা যান।

মৃত্যুর পর তার ব্যক্তিজীবন নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা-সমালোচনা ও গুজবের জন্ম হয়। তিনি সমকামী ছিলেন। তবে বৈরী সামাজিক মনোভাবের কারণে সেটি খোলাখুলি স্বীকার করেননি। তার মৃত্যুর পর মার্ক ক্রিস্টিয়ান নামে এক ব্যক্তি বিপুল অংকের ক্ষতিপূরণ দাবি করে হাডসনের সম্পত্তির অধিকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করে। তার অভিযোগ ছিল হাডসন এইডস রোগে আক্রান্ত হওয়ার কথা তার কাছ থেকে গোপন করে তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়েছিলেন। যদিও সে ব্যক্তি এইচ আইভিতে আক্রান্ত ছিলেন না।

রক হাডসন তার বিশাল সম্পত্তি এইডসের চিকিৎসা ও গবেষণা সংক্রান্ত কাজে এবং অন্যান্য সমাজসেবামূলক কাজে দান করে গেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান, অভিনয় শিল্পী এলিজাবেথ টেলর, সুসান সেইন্ট জেমস, ডোরিস ডে, রবার্ট স্ট্যাব, অ্যাঞ্জি ডিকিনসনসহ রক হাডসনের বন্ধুরা তার অমায়িক ও হাসিখুশি স্বভাব, দানশীলতা ও পরোপকারের জন্য তাকে দারুণ ভালোবাসতেন।