বলা চলে চলচ্চিত্রটি এদেশীয় কিন্তু কাঠামো ভিনদেশীয়। যদিও গত কয়েকদিন থেকেই ইমন ফেইসবুকে জানাচ্ছিল, ভীষণ কষ্ট করা আবেগ নিঃসৃত ছবি এটি তার। কিন্তু, শিল্পীকে তো খানিকটা নির্মোহও হতে হয়, যৌক্তিক-অযৌক্তিক হয়ে উঠার জন্য।
আমরা যখন চলচ্চিত্র নির্মাণে হাতেখড়ি নিচ্ছিলাম, তখন সবচেয়ে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল যা, আবেগকে কিভাবে এই আবেগহীন টেকনিক নির্ভর জগতে আবেগী করে তোলা যায়। কারণ, যখন নির্মাণের কাজটি করা হয় তখন এর গবেষণা, স্ক্রিপ্ট, শুটিং, এডিটিং কোনো পর্যায়ে আর যাই থাকুক, আবেগের কোনো স্থান নেই। আজ অবধি চলচ্চিত্র নির্মাণই যখন সবচেয়ে কঠিনতম কাজ আমার কাছে তখন আবু শাহেদ ইমন সদ্য মুক্তি দিলেন এরকম একটি কঠিনতম কাজের। তাই খুব আর্দ্র হবার চেষ্টা করবো “জালালের গল্প” নিয়ে মতামত প্রকাশে।
ইমন দীর্ঘদিন চলচ্চিত্র নির্মাণের ওপর পড়াশোনা করেছেন, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া হয়ে দক্ষিণ কোরিয়া পর্যন্ত। পড়াশোনার সুবাদে ইমনের ছবি যে একটি মাত্র দেশের ভাষায় কথা বলবে না তা সহজেই অনুমেয়। বাইরের ফিল্ম স্কুলের ছাত্ররা একটি স্ক্রিপ্ট কোনো একটি মুহুর্তের অনুভুতি থেকে লিখে নাই। তাতে অনেক যুক্তি-তক্কো-গপ্পো থাকে, থাকে প্রচুর গবেষণা ও রেফারেন্স। নির্মাতার উদ্ভব, তার ব্যক্তি জীবন,অতীত, দেশ-কালÑসংস্কৃতি, প্রতিবেশ-পরিবেশ সবই সেই চলচ্চিত্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। দর্শক হিসেবে আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছি সেসব রেফারেন্সের পর রেফারেন্স এবং তার যথোপযুক্ত বিন্যাস। সবচেয়ে মোক্ষম হয়েছে ল্যান্ডস্কেপের রেফারেন্স। নদী বিধৌত বাংলাদেশের পটভূমিতে জলের নানান মাত্রার ব্যবহার। জলের জলজ রূপটি খুব স্পষ্ট। ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র জালাল জলে ভেসে চলা এক জীবন। যে জলের মতো এদেশের অসংখ্য মানুষ ভেসে চলে অনির্দিষ্ট যাত্রায়। নদীর জলই নির্ধারণ করে দেয় এদেশের কোটি মানুষের ভাগ্য। সেই কোটি মানুষের এক মানুষ- জালাল।
এদেশে নদীরা যে নানা ভঙ্গিমায় বহমান এবং তাদের রূপ এবং রং যে আলাদা তাও খানিকটা পেয়ে যাই এক ছবিতে। এমনকি চড়ায় জমে থাকা ক্ষীণ জলে মানুষের চিরন্তন মনের ছায়া, চাপকল থেকে প্রচ্ছল জলের ধারা সবই এ ছবির রূপকল্প হিসেবে আসে। সেই যে জীবনানন্দের কথা, “আমি শুধাই এ হৃদয়ের / সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়”... চমৎকৃত হয়েছি মহাভারতের কর্ণের জন্মযাত্রা ও বেহুলার ভাসান যাত্রার রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার দেখে। জন্ম পরিচয়হীন জালালকে আমরা পাই নদীতে ভাসমান একটি হাঁড়িতে। কর্ণকেও ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল হাঁড়িতে। সেটা ছিলো মাটির, জালালের হাঁড়ি দস্তার।
মানব জীবনের এক একটি অধ্যায়কে ভিন্ন ভিন্ন চেহারায় ধরবার চেষ্টা। বেঁচে থাকা, টিকে থাকার লড়াইয়ে জন্ম, মৃত্যু, ভালোবাসার একটি বিন্যাস ইমন যে ঘটাতে চেয়েছে তা বোঝা দুষ্কর নয়। বলবার ভঙ্গিটিও বেশ সহজ।
কি বলবো একে? মিডল সিনেমা। সাধারণ দর্শককে দেখানো হবে একটি আটপৌরে কাহিনি। সে তার আমোদ নিয়ে বাড়ি ফিরে যাবে। আর যে বুঝে নেওয়ার সে তার সকল রস ঠিকঠাক ধরে ফেলবে। ইমন বোধ করি তা খানিকটা পেরেছে। যদিও কোথাও কোথাও বড় ধরনের হোঁচট খেয়েছে। খাওয়াই স্বাভাবিক। পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হিসাবে এটি তার প্রথমকাজ বৈকি!
যা হোক, ‘দ্য অ্যারাইভাল’ এ আসা যাক। পুরোটা জুড়েই কর্ণের কাহিনিকে নতুন করে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সেই জেলের বাড়িতে আশ্রয় লাভ, সৌভাগ্য ফিরে আসা। তবে যে ক’বার হাঁড়িতে শিশুকে ভাসিয়ে দেওয়ার দৃশ্যায়ন করা হয়েছে ততবারই যে তাতে কোনো মানব সন্তান ছিল না তা খুব স্পষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছে। অথচ এ তেমন কোনো নির্মমতা নয়। হাঁড়িতে সত্যি সত্যি শিশুটিকে রাখলে এমন কোনো ক্ষতি হত না। অথবা হাঁজির ভিতর ওজনদার কিছু রাখা যেতে পারতো। শেষ দৃশ্যে যখন শিলার শিশু সন্তানকে হাঁড়িতে করে বহন করা হয় তখন তা ডাঙ্গায় ছিল। ফলে ফাঁপা হাঁড়ির শুন্যতা আরো চোখে লাগছিল। বাচ্চা কাঁদছে কিন্তু কোন নড়াচড়া নেই তা কি হয়! আরও একটি বিষয় হলো, শিশু চরিত্রের কন্টিনিউয়িটি গ্যাপ। যে শিশুর পায়ের পাতা জলে ভেজানো হলো, সে কি পরবর্তীতে কোলে-কাঁখের সেই এই শিশু? বাচ্চাটি যেন একবার বড় আরেকবার ছোট হতে থাকলো সময় সময়।
আর যারা শিশুর পা ধোয়া জল নিয়ে ব্যবসা করলো তা ধর্মীয় ব্যবসা হওয়ার পরও তাদের মাথায় চুটি, মুখে দাঁড়ির চিরায়ত রূপটি দেখা গেলো না কেন? এসব টুকিটাকি ঝামেলা আছে এ পর্বে। তবে সবাই যথাযথ অভিনয় করে গেছে। বিশেষভাবে পার্শ্বচরিত্রেরা।
দ্বিতীয় পর্বে আমরা মুগ্ধ এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের উপস্থাপনে। এ নদী চিরায়ত বাংলার নদী, এ জল ভীষণ জলময়। জালালকে সাঁতার শেখাবার সময়টিতে রীতিমত জলের গন্ধ ভেসে আসছিলো যেন। অনেক ডিটেইলের কাজ আছে এই অধ্যায়ে। যে ডিটেনল প্রায় অনুপস্থিত এদেশীয় কাহিনিচিত্রে। জালালের বেড়ে ওঠা এবং জীবনের নগ্নতা দেখবার সময় এটি। ভীষণ ভালো কাস্টিং হয়েছে জালালের চরিত্রায়নে।
চোখ খুব প্রয়োজনীয় একটি অনুষঙ্গ চলচ্চিত্রে। ক্যামেরা কি! সেও তো একজোড়া চোখই, তাই হয়তো এই শিল্পে পাত্র-পাত্রীর চোখ খুব দামী একটা বিষয়। যার ব্যবহার খুব ভালো মতো আছে ইমনের ছবিতে। প্রায় সংলাপবিহীন জালাল তার চোখের ভাষায় সমস্ত কথা বলে গেল অনায়াসে। তীব্র, তীক্ষ্ণ সে ভাষা। কিঞ্চিৎ আদি রসের প্রয়োগের চেষ্টাও করেছে দেখলাম। এবং তা ঠিক অপ্রাসঙ্গিক নয়। গ্রামে দেবর-ভাবী সম্পর্কের মধ্যে তা অহরহ হয়ে থাকে। এর ফলে দর্শক ভেবে নেয় আঁটকুড়ে করিমের স্ত্রী রহিমার সঙ্গে বুঝি চাকর ছেলেটির সন্তান জন্মদানের ঘটনাটি ঘটবে। কিন্তু, তা না ঘটিয়ে চিরন্তন কবিরাজী চালায় ইমন। দর্শকের প্রত্যাশায় আঘাত করা নির্মাতার একটি টেকনিক। কিন্তু, কবিরাজের তুকতাক দীর্ঘায়িত হওয়ায় আমরা বুঝে যাই কি ঘটতে চলেছে। কাজেই, প্রত্যাশা ভঙ্গের সারপ্রাইজ লাগসই হয় না। সবকিছু ধারনা অনুযায়ীই ঘটে চলে। শর্মীমালা, তৌকির এবং কবিরাজ চরিত্রে কাজী রকিব চরিত্রানুগ ছিলেন। আর জালাল চরিত্র দানকারী মোহাম্মদ ইমন তো আবু শাহেদ ইমনের মানসপুত্র এ কথা বলাই বাহুল্য। এ অধ্যায়ের শেষ দৃশ্যে দেখতে পাই ভেলায় জালালকে ভাসিয়ে দেয়া হবে ঠিক যেমনটি ভাসানো হয়েছিল বেহুলা-লখিন্দরকে অনির্দিষ্ট যাত্রায় মিথের রেফারেন্স আরও আছে আঁচকুড়ে রাজার সাথে করিমের রূপক বয়ানে।
অন্ধতা, কুসংস্কার, লোভ এবং তা উপজীব্য করে ব্যবসা -অবজেক্ট হিসাবে প্রধান ছিল প্রথম দুই অধ্যায়ে। তৃতীয় অধ্যায়ে এসে ধারাবাহিকতা উল্টে গেল কাহিনীতে, বিন্যাসে। এটাও একটা কাঠামো মানছি। ছন্দের মধ্যে ছন্দপতন। এর বাস্তবতায় জালালের অন্তর্গত বৈপরীত্য। অমানবিক জগতে মানবিকতার পরাজয়। পরাজিত হওয়াই যার নিয়তি। ঠিক যেমনটা হয়ে থাকে গ্রীক উপাখ্যান -এ।
দ্য ডিপারচার পর্বে এসে কিম কি দুক ভর করে ইমনের ওপর। পর্ব জুড়ে নিষ্ঠুরতা তাই প্রকটভাবে দৃশ্যমান। নিষ্ঠুরতার কাহিনি অবশ্য আছে গোটা ছবি জুড়েই। নিষ্ঠুরতার বৈপরীত্যে দাঁড়ানো অসহায় জালালের মমত্ববোধের সংঘর্ষ নানা রূপে বয়ান করাই তো জালালের গল্প। জল এবং জালাল নানা আকারে নানা জায়গায় যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে তা প্রনিধানযোগ্য। কিন্তু, সবচেয়ে বেশি হোঁচট ঘটেছে এই পর্বে এসেই। সেটা কি মোশাররফ করিম (সজীব) খাওয়ালো, নাকি ইমন খেলো তা জানা নেই। জানা নেই এই কারনে যে, আমরা জানি, কাহিনি চিত্রে ‘ডিরেক্টর ইজ দ্য গড’ এবং তার অভিনেতা ও সেই ঈশ্বরের হুকুম তামিল করে থাকে। তবে কেন মোশাররফ করিম তার ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলো না। অভিনেতার মৃত্যু ঘটে যখন তাকে ম্যানারিজম পেয়ে বসে। মোশাররফ করিম তার ম্যানারিজমে আটকা পড়েছেন।
বরাবরের মত এবারও আমি হতাশ আবহ সঙ্গীতে। কেন যেন এদেশের সঙ্গীত পরিচালকেরা সিনেমার ভাষাটা ধরতে পারেন না। চলচ্চিত্রের সাথে তাদের যোগাযোগ বোধহয় অতটা জোড়ালো নয়। একই মিউজিক ট্র্যাক বারবার ব্যবহার না করে অ্যামবিয়ান্সে থাকা যেত। অ্যাম্ববিয়ান্সের আর্ট তো ইমনের অজানা নয়। ক্যামেরার কাজ গতানুগতিকতার মাঝে হঠাৎ হঠাৎ ভালো।
শেষটা যেন তাড়াহুড়ো করেই হলো। দীর্ঘ উপাখ্যান শেষে হঠাৎ যদি কেউ বলে বসে, আমার কথাটি ফুরোলো, নটে গাছটি মুড়োলো - তখন যে ছন্দপতন হয় এখানেও তাই হলো। জালালের (আরাফাত রহমান) এতক্ষনের আলাপ বিস্তার ক্রমশ বিলীন হল না নদীগর্ভে। আরো চার পাঁচটি শট হয়তো দিতে পারতো জল থেকে উঠে আসা জালালের জলের গর্ভে হারিয়ে যাবার বেদনার গভীরতা।
তথাপি, আবু শাহেদ ইমনকে ধন্যবাদ তার একাগ্রতার জন্য। এত কম সময়ে নিজেকে পরিণত পরিচালকে রূপান্তরিত করবার জন্য। এ ছবি তাকে প্রতিষ্ঠা দেবে, পুরস্কার দেবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু, যে ব্যক্তি ইমনকে আমি পরিচালক হিসেবে চিনি তার কাছে যে ভবিষ্যতে আরো ঢের ঢের চমৎকার ছবি পাবো তা আমি নিশ্চিত।