বাংলা গানের 'রানার'

আসামের চা বাগান। সবুজের রাজ্যে প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে্র বেড়ে ওঠে একটি শিশু। সে শোনে জলপতনের গান, শোনে হাওয়ার শব্দ আর গাছের পাতার বাঁশি। প্রকৃতির বিচিত্র সুর তাকে মোহিত করে। বড় হয়ে এই ছেলেটি হয় একজন বিখ্যাত সুরকার ও গীতিকার যিনি বাংলা গানের মোড় ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তার নাম সলিল চৌধুরী।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Sept 2015, 05:51 AM
Updated : 5 Sept 2015, 05:51 AM

‘কোনো এক গাঁয়ের বধূ’, ‘ও আলোর পথযাত্রী’, ‘ধিতাং ধিতাং বোলে’, ‘উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা’সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা  তিনি। সলিল চৌধুরী তার নিজের লেখা ও সুর করা গান দিয়ে যেমন খ্যাতি পেয়েছেন, তেমনি কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘রানার’, ‘অবাক পৃথিবী’সহ বিভিন্ন কবিতায় সুরারোপের জন্যও জনপ্রিয়তা পেয়েছেন।

সলিল চৌধুরীর জন্ম ১৯২৫ সালের ১৯ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণায় হরিনাভিতে। তার বাবা জ্ঞানেন্দ্রময় চৌধুরী ছিলেন আসামের লতাবাড়ি চা বাগানের চিকিৎসক। বাবার চাকরিসূত্রে আসামের চা বাগানেই কাটে তার শৈশব। বাবা ছিলেন পাশ্চাত্য সংগীতের ভক্ত। তাদের বাড়িতে মোৎজার্ট, বেথোভেন, চাইকোভস্কিসহ ধ‍্রুপদী পাশ্চাত্য সুরকারদের প্রচুর রেকর্ড ছিল। সেগুলো শুনেই সুরের প্রতি আকৃষ্ট হন তিনি। জ্ঞানেন্দ্রময় চৌধুরী শুধু চিকিৎসাই করতেন না, চা বাগানের কুলিদের অংশগ্রহণে নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনও করতেন। এসব অনুষ্ঠানেও গান গাইতেন সলিল চৌধুরী। চাচা নিখিল চৌধুরীর কাছে গান শেখেন তিনি। নিখিল চৌধুরীর গানের দল ‘মিলন পরিষদ’-এ শৈশবেই যোগ দেন  সলিল চৌধুরী। তিনি লেখাপড়া করেন মামাবাড়িতে থেকে। হরিনাভি বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। কলকাতায় বঙ্গবাসী কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন।

লেখাপড়ার জন্য ১৯৪৪ সালে কলকাতায় আসেন মেধাবী তরুণ সলিল। সে সময় তিনি কমিউনিস্ট পাটর্ির সাংস্কৃতিক সংগঠন ভারতীয় গণনাট্য সংঘ আইপিটিএতে যোগ দেন।  আজীবন তিনি সাম্যবাদী আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। আইপিটিএর সদস্য অকালপ্রয়াত কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ছিলেন সলিল চৌধুরীর বন্ধু। আইপিটিএর আরেক সদস্য হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও পরিচয় হয় তার। সুকান্তর লেখা ‘রানার’, ‘অবাক পৃথিবী’ কবিতায় সুর দিয়ে খ্যাতি পান তিনি। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় গান দুটি। ১৯৪৭ সালে ‘কোনো এক গাঁয়ের বধূ’র রেকর্ড প্রকাশিত হয়। গানটির কথা ও সুর ছিল সলিল চৌধুরীর আর গেয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। হেমন্ত-সলিল জুটির পথচলা শুরু হয়। আইপিটিএর জন্য প্রচুর সংখ্যক গণসংগীত লেখেন ও সুর করেন সলিল চৌধুরী।সলিল চৌধুরী তার কবিতা ও ছোট গল্পের জন্যও খ্যাতিমান।

দেশভাগের পর তিনি চলচ্চিত্রজগতে প্রবেশ করেন। সংগীত পরিচালক হিসেবে তার প্রথম ছবি ‘পরিবর্তন’ মুক্তি পায় ১৯৪৯ সালে।

বাঙালি পরিচালক বিমল রায় তাকে নিয়ে যান মুম্বাইয়ে। ১৯৫৩ সালে মুক্তি পায় বিমল রায়ের ‘দো বিঘা জমিন’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতা থেকে নামটি নেওয়া হয়। চিত্রনাট্য তৈরি হয়েছিল সলিল চৌধুরীর লেখা ‘রিকশাওয়ালা’ গল্পের ভিত্তিতে। ছবিটির সংগীত পরিচালকও ছিলেন তিনি। ‘দো বিঘা জমিন’ শুধু বাণিজ্যিক সাফল্যই পায়নি সেই সঙ্গে সমালোচকদের ব্যাপক প্রশংসাও কুড়ায়। ফিল্মফেয়ারে সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার এবং কান চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়। এর পর সংগীত পরিচালক হিসেবে একের পর এক হিন্দি ও বাংলা ছবিতে কাজ করেন তিনি। ‘মধুমতি’ ছবির সংগীত পরিচালক হিসেবে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পান।

‘নওক্রি’, ‘আমানত’, ‘জাগতে রাহো’, ‘টাঙাওয়ালি’, ‘পরিবার’, ‘আওয়াজ’, ‘মুসাফির’, ‘পরখ’, ‘কানুন’, ‘ছায়া’, ‘চার দিওয়ার’, ‘হাফ টিকেট’, ‘মৃগয়া’, ‘মেরে আপনে’, ‘অন্নদাতা’, ‘আনন্দ’-এর মতো সাড়া জাগানো হিন্দি ছবি এবং ‘এক দিন রাত্রে’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘সাগরিকা’র মতো বাংলা ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন তিনি।

১৯৬৪ সালে তিনি মালায়াম ছবির সংগীত পরিচালনা করা শুরু করেন। সলিল চৌধুরী ৭৫টির বেশি হিন্দি, ৪০টির বেশি বাংলা , ২৬টি মালায়াম ছবির সংগীত পরিচালনা করেন। তিনি কন্নাড়া, মারাঠি, তামিল, তেলেগু, অহমিয়া, গুজরাটি, ওড়িয়াসহ ভারতের বিভিন্ন ভাষায় বেশ কিছু চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করেন।

সলিল চৌধুরী তার গানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংগীত রীতির মিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন সাফল্যের সঙ্গে। ভারতীয় বিভিন্ন রাগরাগিনীর সঙ্গে মিশেছিল মোৎজার্ট, বেথোভেন, বাখ ও চাইকোভস্কির সুরের আদল।

বাংলা গণসংগীতের ক্ষেত্রেও তিনি রীতিমতো নতুন ধারার প্রবর্তন করেছিলেন। বাংলায় তার লেখা ও সুর করা বিখ্যাত গানের মধ্যে রয়েছে ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা’, ‘ও বাঁশি কেন গায়’, ‘ও মোর ময়না গো’, ‘যদি জানতে গো তুমি’, চৈতালি দিনে’, ‘যারে, যারে উড়ে যারে পাখি’, ‘যাক যা গেছে তা যাক’, ‘না যেওনা, রজনী এখনো বাকি’ ‘নিশিদিন’, ‘পথ হারাবো বলেই এবার’, ‘পথে এবার নামো সাথী’, ‘পল্লবিনী গো সঞ্চারিনী’, ‘মনমাতাল সাঁঝ সকাল’, ‘মনের জানালা ধরে’, ‘শ্যামল বরণী ওগো কন্যা, ‘শোনো শোনো একদিন’ ‘সেই মেয়ে’ ইত্যাদি।

তার গণসংগীতের মধ্যে বিখ্যাত হলো, ‘অন্তবিহীন,’, ‘আমার প্রতিবাদের ভাষা’, ‘আমি ঝড়ের কাছে’, ‘আহা ওই আঁকা বাঁকা পথ’, ‘উজ্জ্বল একঝাঁক পায়রা’, ‘এই রোকো পৃথিবীর গাড়িটা থামাও’, ‘ও আলোর পথযাত্রী’, ‘কোনো এক গাঁয়ের বধূ’, ‘চলো চলো মুক্তি সেনানী’, ‘ধিতাং ধিতাং বোলে’, ইত্যাদি।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, লতা মঙ্গেশকার, সুচিত্রা মিত্র, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র,  দেবব্রত বিশ্বাস, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, মুকেশ,মান্না দে, মানবেন্দ্র মখোপাধ্যায়সহ পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকের বিখ্যাত শিল্পীদের অধিকাংশই তার সুরে গান গেয়েছেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্যও গান লিখেছেন সলিল চৌধুরী।

বাংলা গানের এই যুগস্রষ্টা  ১৯৯৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মৃত্যু বরণ করেন। তার সৃষ্টির মধ্য দিয়ে বাংলা গানের জগতে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন সলিল চৌধুরী।