‘ভদ্র প্রেমিক’ ঋষি কাপুর

নায়িকাপ্রধান ছবিতে অভিনয় করতে সাধারণত প্রতিষ্ঠিত নায়কদের মধ্যে কিছুটা অনীহা কাজ করে। বিশেষ করে বলিউডের পুরুষ তারকাদের মধ্যে এই প্রবণতা রয়েছে জোরালোভাবেই। কিন্তু ক্যারিয়ারের শীর্ষেও কখনও এগুলো নিয়ে মাথা ঘামাননি ঋষি কাপুর। ‘ববি’, ‘চাঁদনি’, ‘নাগিনা’, ‘হেনা’, ‘সাহেবান’, ‘দামিনী’র মতো নারীপ্রধান সিনেমায় অভিনয় করেছেন অম্লানবদনে। সহানুভূতিশীল এবং ভদ্র প্রেমিকের ভূমিকায় সত্তর, আশি ও নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ঋষিকাপুরের কোনো বিকল্প খুঁজে পাওয়া যায়নি।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Sept 2015, 06:19 AM
Updated : 4 Sept 2015, 06:19 AM

ঋষি কাপুরের জন্ম ১৯৫২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর, মুম্বাইতে, বিখ্যাত কাপুর পরিবারে। রাজ কাপুরের মেজ ছেলে তিনি, ডাক নাম চিন্টু। ১৯৭০ সালে  বাবা রাজ কাপুরের ‘মেরা নাম জোকার’ ছবিতে শিশুশিল্পী হিসেবে প্রথম পর্দায় আসেন। প্রথম ছবিতেই কিশোর অভিনেতা হিসেবে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয় করেন তিনি। বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন দেয় বিশেষ পুরস্কার। ‘মেরা নাম জোকার’ ছবিটি সমালোচকদের প্রশংসা পেলেও বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়নি। সে কারণে প্রচুর ঋণ জমে যায় রাজ কাপুরের। ব্যবসায়িক ক্ষতি সামলাতে তিনি নতুন ছবি নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। মুম্বাইয়ে সফল বাণিজ্যিক ছবি তৈরির অব্যর্থ ফর্মুলা হলো প্রেম। সে সময় বলিউডের সুপার স্টার রাজেশ খান্না ছিলেন প্রেমের ছবির একচেটিয়া নায়ক। কিন্তু রাজ কাপুরের তখন বেশ টানাটানি চলছে। রাজেশ খান্নাকে ছবিতে নেওয়া মানেই বিপুল অর্থ ব্যয়। রাজ কাপুর তাই ভাবলেন আনকোড়া নতুন মুখ নিয়ে টিনএজ প্রেমের ছবি বানাবেন। বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে নায়িকা নেওয়া হলো পনের বছর বয়সী ডিম্পল কাপাডিয়াকে। শত শত মেয়ের মধ্য থেকে তাকে বেছে নেওয়া হয়েছে এমন প্রচার চালানো হলো। সব ফিল্মি পত্রিকার প্রচ্ছদে তখন ববিরূপী ডিম্পলের ছবি। ছবির নায়ক হিসেবে রাজ কাপুর নিলেন নিজের ছেলে ঋষিকে। এভাবেই নায়ক হিসেবে যাত্রা শুরু হলো ঋষি কাপুরের।  ‘ববি’র শুটিং চলার সময় ঋষির সঙ্গে ডিম্পল কাপাডিয়ার বেশ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। পরস্পরের প্রেমেও পড়েন তারা। কিন্তু এরই মধ্যে রাজেশ খান্না প্রবেশ করেন দৃশ্যপটে। সুপার স্টার রাজেশের দুর্দান্ত গ্ল্যামারের কাছে হেরে যান অনভিজ্ঞ লাজুক তরুণ ঋষি। ডিম্পল হয়ে যান মিসেস খান্না। এই পরাজয় বিনা প্রতিবাদেই মেনে নেন তিনি।

১৯৭৩ সালে মুক্তি পেল ‘ববি’। সুপার ডুপার হিট ‘ববি’র কল্যাণে ‘চকলেট হিরো’র তকমা জোটে ঋষির। সেরা অভিনেতার ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পান। এরপর টিনএজ প্রেমের ছবি মানেই ঋষি কাপুর, এমন একটি ধারা শুরু হয়। ১৯৭৩ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে ৯২টি ছবিতে প্রেমিক নায়কের ভূমিকায় দেখা গেছে তাকে। অবশ্য পরে অভিনয় প্রতিভায় এই ইমেজকে অতিক্রম করেছেন তিনি। ‘খোঁজ’, ‘তাওয়ায়েফ’, ‘প্রেমরোগ’, 'কর্জ', ‘হেনা’র মতো ছবি দিয়ে ঋষি কাপুর প্রমাণ করেছিলেন তিনি কাপুর পরিবারের অন্যতম সেরা অভিনেতা।

‘ববি’র পর ‘রাজা’, ‘রাফু চক্কর’, ‘খেল খেল মে’, ‘লায়লা মজনু’সহ একের পর এক হিট ছবিতে নায়ক হন ঋষি।  ‘জাহরিলা ইনসান’ ছবিতে তার বিপরীতে নায়িকা হন নিতু সিং। ‘খেল খেল মে’ ছবিতে অভিনয়ের সময় একে অন্যের প্রেমে পড়েন তারা। ১৯৮০ সালে তারা বিয়ে করেন। তাদের দাম্পত্য জীবনে এক সময় অশান্তির কালো মেঘ জমে উঠলেও বিচ্ছেদ পর্যন্ত তা গড়ায়নি। এখন বলিউডে সুখি দম্পতি হিসেবেই পরিচিত তারা। নিতু-ঋষি জুটি সত্তর ও আশির দশকে বেশ জনপ্রিয়তা পায়। ‘কাভি-কাভি’, ‘অমর আকবর অ্যান্টনি’, ‘রাফু চক্কর’সহ ১২টি ছবিতে অভিনয় করেন তারা। ‘দো দুনি চা ‘(২০১০), ‘যাব তক হ্যায় জান’ (২০১৩) ছবিতেও দেখা গেছে ঋষি-নিতু জুটিকে। ২০১১ সালে জি সিনে অ্যাওয়ার্ড আসরে ‘লাইফটাইম জোড়ি’ পুরস্কার পেয়েছে এই জুটি।

প্রায় ৫১টি ছবিতে একক নায়ক এবং ৪২টি ছবিতে যুগ্ম নায়ক হয়েছেন ঋষি। অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে অনেক ছবিতে দেখা গেছে তাকে। ‘কাভি-কাভি’, ‘অমর আকবর অ্যান্টনি’, ‘নসিব’, ‘কুলি’র মতো হিট ছবিতে অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে তার অভিনয় দর্শকদের মন জয় করে।

‘হেনা’ ছবিতে পাকিস্তানি অভিনেত্রী জেবা বখতিয়ারের বিপরীতে অনবদ্য অভিনয় করেন তিনি। শ্রীদেবীর সঙ্গে তার জুটিও ছিল দর্শকপ্রিয়। ‘বানজারান’, ‘চাঁদনি’, ‘নাগিনা’ ছবিতে দুজনের পর্দা-রসায়ন ছিল চমৎকার।

 মাধুরী দিক্ষিতের বিপরীতে ‘সাহেবান’, ‘প্রেমগ্রন্থ’, জুহি চাওলার বিপরীতে ‘বোল রাধা বোল’, ডিম্পল কাপাডিয়ার বিপরীতে ‘ববি’, ‘সাগর’, দিব্যা ভারতীর বিপরীতে ‘দিওয়ানা’, পদ্মিনী কোলাপুরীর বিপরীতে ‘প্রেম রোগ’ তার ‘ভদ্র প্রেমিকে’র ইমেজকে প্রতিষ্ঠিত করে।

ঋষি কাপুর অভিনীত ছবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ‘হাম কিসিসে কম নেহি’, ‘দুসরা আদমি’, ‘ফুল খিলে হায় গুলশান গুলশান’, ‘বদলতে রিশতে’, ‘সারগাম’, ‘দো প্রেমী’, ‘কর্জ’, ‘ইয়ে ওয়াদা রাহা’, ‘বাড়ে দিলওয়ালা’, ‘হাওয়ালাত’, ‘ঘর ঘর কি কাহানি’, ‘আজাদ দেশ কি গুলাম’, ‘আমিরি গরিবি ইত্যাদি।

‘খোঁজ’ ছবিতে নেতিবাচক চরিত্রে তার অভিনয় ছিল দুর্দান্ত।

নতুন শতকে  চরিত্রাভিনেতা হিসেবে বেশ কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেন ঋষি কাপুর। ‘ইয়ে হ্যায় জালওয়া’, ‘তেহজিব’, ‘হামতুম’, ‘ফানা’, ‘নামাস্তে লন্ডন’, ‘লাভ আজকাল’, ‘পাতিয়ালা হাউজ’, ‘শুদ্ধ দেশি রোমান্স’ ছবিতে চরিত্রাভিনেতা হিসেবে প্রশংসিত হন তিনি। ‘অগ্নিপথ’ ছবির রিমেইকে খলচরিত্রে তার অভিনয় ছিল দুদর্ান্ত।   ‘বেশরম’ ছবিতে ছেলে রানবির কাপুরের সঙ্গেও অভিনয় করেছেন তিনি। ব্রিটিশ ছবি ‘ডোন্ট স্টপ ড্রিমিং’(২০০৭) এবং ‘সামবার সালসা’তে(২০০৮)অভিনয় করেন।

এক সাক্ষাৎকারে ঋষি কাপুর বলেন, নায়ক চরিত্র থেকে পার্শ্ব-চরিত্রে সরে যাওয়ার পর দারুণ স্বস্তি বোধ করেন তিনি। কারণ নায়ক না হওয়ায় মুটিয়ে যাওয়ার দুঃশ্চিন্তা থেকে তিনি রেহাই পান। ভোজনরসিক ঋষি ফিল্মফেয়ার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকারে বলেন মানুষের হৃদয়ে পৌঁছানোর সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত পথ হলো পাকস্থলীর ভিতর দিয়ে। নিতু কাপুরের রান্নার হাত খুবই ভালো। সেই গুণেই নাকি চিরদিন তিনি মুগ্ধ হয়ে আছেন।

ঋষি কাপুর ২০০৮ সালে ফিল্মফেয়ার আসরে লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।

ঋষি কাপুর শুধু কাপুর পরিবারের রত্নই নন, বলিউডের অন্যতম সেরা অভিনেতাও। ৬৩ বছরে পৌঁছে এখনও ক্যারিয়ারের ব্যস্ত সময় পার করছেন ‘চিন্টুজি’ ঋষি কাপুর।