ইঙ্গলস পরিবারের মেজ মেয়ে লরা বড় হয়ে লিখতে শুরু করেন নিজের জীবনের কাহিনি। তার জীবনের গল্পে উঠে আসে আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলে বসতি স্থাপনকারীদের জীবন সংগ্রাম, তাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ বেদনার উপাখ্যান সরল উপাখ্যান। লরা এলিজাবেথ ইঙ্গলস ওয়াইল্ডার বেশ কটি বই লেখেন। ‘লিটল হাউজ’ সিরিজের এই বইগুলো আমেরিকায় বেস্ট সেলার হয়। তার লেখা অবলম্বনেই ১৯৭০-এ নির্মিত হয় টিভি সিরিজ ‘লিটল হাউজ অন দ্য প্রেইরি’।
এনবিসির কর্মকর্তা ও প্রোযোজক ইডি ফ্রেন্ডলি এই টিভি সিরিজ তৈরির পরিকল্পনা করেন। সে সময় তিনি যোগাযোগ করেন তরুণ অভিনেতা মাইকেল ল্যান্ডনের সঙ্গে। এর আগে ওয়েস্টার্ন টিভি সিরিজ ‘বোনানজা’তে এই অভিনেতার কাজ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। তিনি ল্যান্ডনকে অনুরোধ করেন পাইলট পর্বটি পরিচালনা করার জন্য। ল্যান্ডন রাজি হন তবে শর্ত দেন যে, চার্লস ইঙ্গলসের চরিত্রে তিনি অভিনয় করবেন। ১৯৭৪ সালের ৩০ মার্চ দু ঘণ্টার পাইলট পর্ব প্রথম সম্প্রচারিত হয়। আর একই বছর ১১ সেপ্টেম্বর থেকে সিরিজটি প্রচারিত হতে থাকে। আমেরিকায় তো বটেই বিশ্বজুড়েই দারুণ জনপ্রিয়তা পায় এটি।
১৯৭৪-১৯৮২ পর্যন্ত প্রচারিত ‘লিটল হাউজ অন দ্য প্রেইরি’ বাংলাদেশেও প্রচারিত হতো। সত্তর ও আশির দশকে বিটিভিতে প্রচারিত অন্যতম জনপ্রিয় টিভি সিরিজে পরিণত হয় এটি।
লরা ইঙ্গলস(১৮৬৭-১৯৫৭) তার লেখায় নিজের ও পরিবারের জীবন সংগ্রামের পাশাপাশি তুলে ধরেছিলেন সেই সময়ের মূল্যবোধ, আমেরিকার মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলের সমাজজীবন ও অর্থনৈতিক বিবর্তনের কথা।
টিভি সিরিজ ‘লিটল হাউজ অন দ্য প্রেইরি’ এই পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ দর্শকদের কাছে তুলে ধরেই জনপ্রিয়তা পায়। পারিবারিক বন্ধন, সততা, ভালোবাসা, হিংসা-বিদ্বেষ এবং তা থেকে উত্তরণের গল্প শোনায় সিরিজটি। অনেক ক্ষেত্রে মূল কাহিনিকে বিস্তৃত করে কিংবা বইতে নেই এমন অনেক বিষয় ও গল্প তুলে আনা হয় চিত্রনাট্যে। লরা ইঙ্গলসের কাহিনি উইসকনসিনের বিগ উডসে শুরু হলেও টিভি সিরিজের কাহিনি আবর্তিত হয় মিনেসোটার ওয়ালনাট গ্রোভকে ঘিরে।
সিরিজে মূল চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন মাইকেল ল্যান্ডন (চার্লস ইঙ্গলস), ক্যারেন গ্রেসেল (ক্যারোলিন ইঙ্গলস), মেলিসা গিলবার্ট (লরা ইঙ্গলস), মেলিসা স্যু অ্যান্ডারসন (মেরি ইঙ্গলস), যমজ বোন লিন্ডসে এবং সিডনি গ্রিনবুশ (কেরি ইঙ্গলস)। শেষ দিকের পর্বগুলোতে লরার প্রেমিক ও স্বামী আলমাঞ্জো ওয়াইল্ডারের ভূমিকায় ছিলেন ডিন বাটলার। ইঙ্গলস পরিবারের পাশাপাশি ওলেসন পরিবার, ডাক্তার হিরাম বেকার, শিক্ষক এলিজা জেইন ওয়াইল্ডারসহ বিভিন্ন চরিত্র সিরিজটিতে বিভিন্ন পর্বে দেখা গেছে।
সিরিজের মূল আবহ সংগীত তৈরি করেন ডেভিড রোজ। চিত্রনাট্য, পরিচালনা, অভিনয়, সংগীত বিভিন্ন বিভাগে অনেকবার এমি আ্যাওয়ার্ড জয় করে ‘লিটল হাউজ অন দ্য প্রেইরি’। ১৯৮২ সালে ‘লিটল হাউজ অন দ্য প্রেইরি’ প্রচার শেষ হয়। ১৯৮২-৮৩ সালে লরা ও আলমাঞ্জো ওয়াইল্ডার দম্পতির কাহিনি নিয়ে প্রচারিত হয় ‘লিটল হাউজ: আ নিউ বিগিনিং’।
সিরিজটির শুটিং হয়েছিল মিনেসোটাতে। এই সিরিজের শুটিংয়ের জন্য মিনেসোটায় রীতিমতো একটি শহর গড়ে তোলা হয় সেট হিসেবে। সিরিজে শিল্পী নির্বাচনের বেলায় বেশ অভিনবত্ব দেখা যায়। দুটি শিশু চরিত্রে দুজোড়া যমজ শিশুশিল্পী অভিনয় করে। মেলিসা গিলবার্টের ভাইও এই সিরিজে অভিনয় করতেন উইলি ওলেসন চরিত্রে।
উনবিংশ শতকে আমেরিকার সমাজ জীবনের গল্প, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংগ্রাম, পশ্চিমে বসতি স্থাপনের কষ্টকর প্রচেষ্টা, প্রেইরির উদার প্রকৃতি, ছোট্ট মফস্বল শহরের সরল জীবনযাত্রা, খামারের শ্রম, আনন্দ, বেদনা, প্রেমের পবিত্রতা ও পারিবারিক মূল্যবোধের উপাখ্যান ‘লিটল হাউজ অন দ্য প্রেইরি’ মার্কিন শত শীর্ষ টিভি সিরিজের মধ্যে ঠাঁই করে নিয়েছে।