'গুরুকে একদম বিশ্বাস করতে নেই'

পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী - শাস্ত্রীয় সংগীতে গুরুস্থানীয়। অর্ধ শতাব্দী ধরে গাইছেন, শেখাচ্ছেন। উচ্চাঙ্গসংগীত থেকে শুরু করে লঘুসংগীতেও সমান জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। উপমহাদেশের প্রথিতযশা সংগীত গুণীদের কাছে শিক্ষা নিয়ে নিজেই গড়েছেন উচ্চাঙ্গসংগীত শিক্ষার বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘শ্রুতিনন্দন’ স্কুলের মাধ্যমে এত দিন সেই শিক্ষা চলছিলো কলকাতাকে কেন্দ্র করেই। এবার বিশ্বজুড়ে প্রসার ঘটাতে স্কুল খুলেছেন অনলাইনে।

চিন্তামন তুষারচিন্তামন তুষারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 July 2015, 01:56 PM
Updated : 30 July 2015, 05:27 PM

কয়েক বছর ধরে নিয়মিতই ঢাকা আসছেন উচ্চাঙ্গসংগীত শোনাতে এবং উচ্চাঙ্গ সংগীতের প্রসার ঘটাতে। তবে এবারের উদ্দেশ্য ভিন্ন, প্রথমবারের মতো ঢাকার কোনো টিভি চ্যানেলে লাইভ গাইতে ১৮ জুলাই ঢাকা আসেন তিনি। দেশ টিভির উদ্যোগে সাংবাদিকদের সঙ্গে মত বিনিময় করেন পরদিন দুপুরে। ঢাকা ক্লাবের অতিথিশালায় সেই মত বিনিময়ের উল্লেখযোগ্য অংশ গ্লিটজের পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন চিন্তামন তুষার।

গ্লিটজ: ঢাকা কখন পৌছালেন?

অজয় চক্রবর্তী: গতকাল রাতে।

গ্লিটজ: আসার পর কোনও অসুবিধাবোধ করছেন?

অজয় চক্রবর্তী: সমস্যা একটাই, বৃষ্টির জন্য সবার সঙ্গে দেখা হচ্ছে না।

গ্লিটজ: এরমধ্যে কি ঢাকা এসেছিলেন?

অজয় চক্রবর্তী: শেষবার এসেছিলাম গত বছরের নভেম্বরে।

গ্লিটজ: নভেম্বর-ডিসেম্বরে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের চতুর্থ দিন আগের দুবারের চেয়ে রেকর্ড সংখ্যক দর্শক হয়েছিল…

অজয় চক্রবর্তী: আমি সেদিন মঞ্চে ছিলাম না। আসলে ৪০, ৫০ বা ৫৫ হাজার সংখ্যায় উপস্থিতি বড় কথা নয়। বড় কথা হলো রাগসংগীত শোনার জন্য এত মানুষের উপস্থিতি। এটি এক ইতিহাস, কারণ আমি জানি, পৃথিবীর আর কোনো সম্মেলনে, এই মুহূর্তের কোনো লাইভ শোতে এত মানুষ হয় না। দিস ওয়াজ দ্য বিগেস্ট অ্যাটেনডেন্ট নাম্বার অফ লিসনারস ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। সেদিক থেকে বড় কথা হলো, ঢাকায় নানা ধরনের এন্টারটেইমেন্টের সুযোগ কম। বিশেষ করে রাগ সংগীতে। সেদিক থেকে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে এটি। তবে ভবিষ্যত নির্ভর করবে শিল্পীদের পার্ফর্ম্যান্সের উপর। যখনই শিল্পীদের পার্ফর্ম্যান্স এই লেভেলের হবে, তখনই এত লোক হবে। যখনই এই লেভেলের হবে না, তখন কি হবে সেটা দেখার বিষয়।

গ্লিটজ: রাগ সংগীতের সম্মেলন হচ্ছে, অনেক দর্শক হচ্ছে। সাধারণের দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের ভালো লাগছে। আপনার বিশেষজ্ঞ চোখ এর ভবিষ্যত ইমপ্যাক্ট কেমন দেখছে?

অজয় চক্রবর্তী: বেঙ্গল ফাউন্ডেশন ইতোমধ্যে একটি শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছে। বাংলাদেশ হচ্ছে কণ্ঠগুণসম্পন্ন ওয়ান অফ দ্য বেস্ট প্লেস ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। কারণ জলহাওয়া। এই যে নদীর ভেজা ভাব, মাটি নরম, মানুষের মনটা নরম, খায় ভাত, সেটাও মানুষকে নমনীয়তা দেয়। একজন কণ্ঠশিল্পীর জন্য এসব প্রয়োজন। ছোলা রুটি আর শুষ্ক আবহাওয়া মানুষের মন, চরিত্র সার্বিকভাবেই পরিবর্তন করে। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান হিসেবে বলছি, এই অঞ্চলের পূর্বে যে দেশগুলোতে সূর্য আগে আসে সেখানকার মানুষের অতিথিসেবার উৎকৃষ্ট মন আছে। কলকাতা থেকে বাংলাদেশের এই মানসিকতা আরও বেশি, সন্দেহ নেই। কলকাতাকে এদিক থেকে আমরা মিস করছি। সেই মনেরই একটি অংশ সংগীত। রাগ সংগীত সৃষ্টি হয় মন থেকে। তালিম, শিক্ষা সবকিছুর উর্দ্ধে আমি কি দেখছি, আমি কি দেখতে চাইছি, আমি কি দেখাতে চাইছি— সুরের মাধ্যমে, সেটাই রাগ সংগীত। কি দেখছি জিজ্ঞেস করলেন আপনি, বাজারে কোন ফুলটি সবচেয়ে সুন্দর বা বাগানের কোন ফুলটি— বিচার করতে হয় না। আমি বুঝি না, বলার দরকার নেই। আর্ট-কালচারের প্রতি মানুষের যে দৃষ্টি, তা কিন্তু শুধু জ্ঞান, বিদ্যা বা বহু শোনার ওপর নির্ভর করে না। যা সত্যিকারের সুন্দর সেটা সবার কাছেই সুন্দর। এই সুন্দর রূপটি দেখা… এই দেখার ওপরই আমি কাজ করছি। দেখার অর্থ, কি করে মানুষকে দেখাতে পারি। দেখার অর্থ, যে জিনিস বা বস্তু নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সেটিকে মনের ভিতর নিয়ে গিয়ে রান্না করা— ‘কানের ভেতর দিয়া মরমে পশিল’— রান্না করে কি দাড়ায়, চিন্তা করা। সংগীতও দেখার জিনিস। সংগীতের শব্দগুলো কান দিয়ে ঢুকে স্থান করে মনে। যদি না করে, তাহলে তা সংগীত হয়ে ওঠে না।

পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী। ছবি: আসাদুজ্জামন প্রামাণিক

পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী। ছবি: আসাদুজ্জামন প্রামাণিক

 

গ্লিটজ: সংগীতে গুরুশিষ্য পরম্পরার কথা বলা হয, তার প্রতি প্রচণ্ড গুরুত্ব দেওয়া হয়। আপনি অনলাইন স্কুল খুলেছেন সম্প্রতি। অনলাইন মাধ্যমে হওয়ায়, গুরুকে আমি সামনা সামনি পাচ্ছি না এনিয়ে প্রশ্ন ওঠে, কতোটুকু পাবো আপনাকে? আর বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা পদ্ধতিই বা কি?

অজয় চক্রবর্তী: অনলাইনের মাধ্যমে শারীরিকভাবে সামনা সামনি শিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে না। একটা সময়, আমার গুরু ছিলেন আগ্রায়, আমার জন্ম আগ্রায়, আমি গুরুর বাড়িতে প্রতিদিন যাই, গুরুর জুতো সাফ করি, এভাবে তিন-পাঁচ বছর পার হয়। তারপর গুরুর ইচ্ছা হলে একদিন বসেন, আস্তে আস্তে যতটা সম্ভব শেখান। গুরুর মৃত্যুর পর তার পুত্রের কাছে কিছুদিন শিখলাম। একদিন গুরু-পুত্রও আর গাইলেন না এবং আমাকে গানবাজনা ছেড়ে দিতে হয়। যখন কোনো জিনিস আপনি খুব সহজে পাবেন, তখন তার মূল্য বুঝবেন না; প্রথমত। দ্বিতীয়ত, বাবা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। বাবা কিন্তু সব সময় সন্তানের সঙ্গে বসে থাকেন না। বাবা একদিন মারাও গেলেন। আমি কিন্তু বাবাকে একদিনও মিস করি না। গুরু-শিষ্য পরম্পরায় এ দুজনের সম্পর্ক কী? গুরুর সঙ্গে শিষ্যের আত্মীক মিলন কখনও বন্ধ হবে না। শারীরিক নয়, বিষয়টি আত্মীক। আত্মার সম্পর্ক এখানে অর্থপূর্ণ, জরুরী নয় একমাত্র বিবেচ্য বিষয়। গুরুর সঙ্গে যদি শিষ্যের আত্মার যোগাযোগ না থাকে… একসঙ্গে দুজন থাকলেই কি শিক্ষা হয়? কখনই হয় না।

গ্লিটজ: দূরে থেকে আত্মার সম্পর্ক হতে পারে, সেখানে কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়…

অজয় চক্রবর্তী: দূর কথাটাই ভুল। আজ থেকে ৫০ বছর আগে আমেরিকা দূর ছিল, এখন নিকটতম। ফোন কলের মাধ্যমে আমি এক মিনিটেই আমেরিকায় কথা বলছি। একটা সুইচ টিপে স্কাইপে কথা বলা যায়… এখন যোগাযোগের যে সুবিধা হয়েছে সেই সুবিধা কি আমার বাবা পেয়েছেন? তাহলে সেটাকে দূর বলছেন কেন? যদি আমেরিকায় যেতে হয়, গেলাম। সামনে বসিয়ে দুতিনদিন শেখালাম। তারপর? প্রতিদিনের শিক্ষার আশিভাগ সেই দিনই ভুলে যায় মানুষ। এটা কিন্তু বিজ্ঞান বলছে। অনলাইনে গুরুর ছবি দিয়ে যদি বসেই থাকতাম তাতে কিন্তু এত গাইয়ে-বাজিয়ে এই যুগে হতো না। আর এই যুগে যারা গানবাজনা করছেন তারা কী করে করছেন? আমি যাদের গুরু হিসেবে দেখেছি, তাদেরকে অনেক সঙ্গ করতে পেরেছি তাতো না। অথচ এখনও একদিনও গুরুজির অভাববোধ করি না আমি, কারণ প্রতিদিন কিছু না কিছু তাঁর থেকে শিখি। তিনি এই পৃথিবীতে নেই কিন্তু তাঁর আদর্শ থেকে গেছে। আমাকে জানতে হবে আমি কি শিখবো, সেটাই বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা। বিজ্ঞান একটি জিনিসকে দেখাতে পারে। তবে মানুষের মনকে বিজ্ঞান দেখাতে পারে না। যেমন- আমি তোমাকে কতোটুকু ভালোবাসি তা দেখানোর ক্ষমতা বিজ্ঞানের নেই। আবার বিজ্ঞান মানেই যা দেখা যায়। যা আমি প্রমাণ করতে পারি, যা বিশ্বাস করবে সবাই এবং যা সত্য। সত্যকে বিজ্ঞান দেখায় ঠিকই, তবে বিজ্ঞান কোনো কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। বিজ্ঞান ডিসকভার করতে পারে। সৃষ্টির ক্ষমতা বিজ্ঞানের হাতে দেওয়া হয়নি। এক বাক্যে যাকে আমরা ঈশ্বর বলি, সেই আসল ঈশ্বর আপনি নিজে। বিজ্ঞান যতোটুকু দেখাতে পারে একটি বিষয়কে সে পর্যন্ত সংগীতকে বিজ্ঞানভিত্তিক দেখানো হয়েছে। সেটাই বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা। সংগীত কথা দিয়ে হয় না। গান গেয়ে দেখাতে হয়। সেসব আপনি লিখতে পারবেন না। গুরু-শিষ্য পরম্পরার মূল কথা হচ্ছে, যা লিখে দেখানো যায় না। যা মন দিয়ে দেখতে হয়। আমি সেই শিক্ষার কথা বলছি, যেখানে স্বর কিভাবে ধীরে ধীরে সুর সৃষ্টি করছে। সেসব নিয়ে আমি নানা পরীক্ষা-নিরিক্ষা করলাম, চিকিৎসা বিজ্ঞানের সহায়তা নিয়ে দেখলাম স্বর উচ্চারণের সময় কণ্ঠের কেমন অবস্থা হয়। কোন স্বর কতোটুকু এবং কীভাবে উচ্চারিত হওয়া উচিত। সেসব আমি ছাত্রের সঙ্গে শেয়ার করলাম। সেটাই হলো বিজ্ঞানভিত্তিক।

পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী। ছবি: আসাদুজ্জামন প্রামাণিক

পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী। ছবি: আসাদুজ্জামন প্রামাণিক

 

গ্লিটজ: সংগীত, শিল্প যেখানে অনুভবের বিষয়, অনুভুতির বিষয়, সেখানে বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতির খুব বেশি প্রয়োজন আছে কী?

অজয় চক্রবর্তী: বিজ্ঞানভিত্তিকই একমাত্র ভেতরকে দেখাতে পারে। মনুষ্যত্বকে প্রকাশ করা যায় বিজ্ঞানের ভিত্তি দিয়ে। যা মন থেকে সৃষ্ট, মন পর্যন্ত প্রক্রিয়া হচ্ছে বিজ্ঞান। পায়ে ধরে প্রণাম করলেই সম্মান জানানো হয় না, আবার আমার পা না ছুঁয়েও শ্রদ্ধা করতে পারেন আপনি। যেমন— তানপুরা পায়ের উপর রেখেই বাজাতে হয়। পা আমার শরীরের অংশ, এটা বিজ্ঞান। যদি আমি তানপুরায় লাথি দেই তবে অন্যায়।

গ্লিটজ: তারমানে আমি সংগীতকে ভালোবাসার সেই পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত এবং বিষয়গুলোই বিজ্ঞান…

অজয় চক্রবর্তী: সেটি হচ্ছে শিক্ষা…

গ্লিটজ: আমাদের প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতিতে গুরুরা শেখান— ওম ধরো, ব্রহ্মাকে ধারণ করো নিজের ভেতর…

অজয় চক্রবর্তী: সম্পূর্ণ বিশ্বাসমূলক। আর যে গুরুকে ষোলো আনা বিশ্বাস করেছে সে মরেছে। গুরুকে একদম বিশ্বাস করতে নেই। সবসময় সংশয়ে থাকা দরকার। স্বামী বিবেকানন্দের যেমন সংশয় ছিলো গুরু শ্রী রামকৃষ্ণের প্রতি। নাছোরবান্দা শিষ্যের মতো গুরুকে শেষদিন পর্যন্ত তাচ্ছিল্য করেছেন, চ্যালেঞ্জ করেছেন। যে গুরুকে প্রশ্নবাণে জজর্রিত করতে না পারে, সে শিষ্য হওয়ারই যোগ্য না, আমার মতে। শিক্ষা হওয়ার জন্য চাই কোটি কোটি প্রশ্ন।

গ্লিটজ: আপনি মঞ্চে প্রায়ই বলেন, রাগসংগীতে অবদান আছে বাংলা লোকসংগীতের। প্রচুর উদাহরণ দেন, সেদিক থেকে আমরা অনেক সমৃদ্ধ… কিন্তু কণ্ঠসংগীতে আমাদের অবদান নেই কেন?

অজয় চক্রবর্তী: নিজেকে না দেখার জন্য।

গ্লিটজ: কিভাবে দেখবো?

অজয় চক্রবর্তী: একজন মানুষকে দেখাতে হবে প্রথমে।

গ্লিটজ: সেদিক থেকে আপনি দায়িত্ব নিয়েছেন…

অজয় চক্রবর্তী: আমি অত্যন্ত ক্ষুদ্র মানুষ। একজন মানুষ প্রথমে জগতের ধারণা দেয়। জগৎ কিন্তু জগতের জায়গায় আছে, মানুষও নিজের জায়গায়। রামচন্দ্রর সেতুবন্ধন উদ্যোগে হনুমান, বানরের অবদান ছিলো। হাজার হাজার বানর মিলে একটি সেতু তৈরি করেছিলো। সেই হাজারের মধ্যে একটি বানর যদি আমি হতে পারি তবে ক্ষতি কী। সেটাই আমার উদ্দেশ্য। অন্তত ধারণা দিতে পারি, সব বানর এক হলে ফ্যান্টাসটিক কিছু হতে পারে।

গ্লিটজ: শাস্ত্রীয় সংগীতে ঘরানার কথা বলা হয়। আপনি কী ঘরানা রীতি-পদ্ধতি সম্পূর্ণ মানেন?

অজয় চক্রবর্তী: একেবারেই না। ঘরানা হচ্ছে নির্দিষ্ট একটি স্টাইলের পরিচায়ক। এক স্টাইলের মধ্যে থেকেও আবার পাঁচজন মানুষের স্টাইল আলাদা হয়ে যায়। আমি কিন্তু আমার ভাই না। ঘর আমাদের দুজনেরই এক, কিন্তু এক না। আপনার সঙ্গে আপনার ভাইয়ের অমিল আছে। থাকতে বাধ্য। একজনের কিছু ভালো আছে, কিছু মন্দ আছে। কেউ শতভাগ ভালো না। এটিই নেচার। আমি সেখানে ছাকনির কাজ করি। যেমন— স্বরস্বতীর বাহক হাঁস, চ্যাপ্টা ঠোঁট দিযে দুধ খাওয়া শেষে শুধু জল রেখে যায়। এই সব ভালো জিনিস পেতে পারি অন্যের কাছ থেকে। আমার বাবার সবদিক ভালো না, আমার গুরুরও সবদিক ভালো হতে পারে না। তাই অন্যের গুরুর মধ্যে শেখার আছে।

গ্লিটজ: আমাদের লোকসংগীতের সঙ্গে উচ্চঙ্গসংগীতের যোগাযোগ ঠিক কিভাবে তৈরি হয়েছে?

পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী। ছবি: আসাদুজ্জামন প্রামাণিক

অজয় চক্রবর্তী: নদীপথে বা নদীর পাড় ধরে যেতে মানুষ একটা উদাত্ত ব্যাপার দেখেছে। সেখানে তাই সফিসটিকেটেড গজল জন্মায়নি। সেখানে— ‘পদ্মার ঢেউরে’ বলে গলা ছেড়ে গান গাওয়া শুরু করেছে। গান হচ্ছে মানুষের মনের ছবি, মন যা দেখেছে তাই গেয়েছে। ধান কাঁটার সময় ছন্দবদ্ধ ছড়া বেঁধেছে— ‘ধান কাটি কাটি ধান, ধান কাটি কাটি ধান’। এটি অসংস্কৃত কিন্তু সৎ মানুষের আপন মনের ছবি। এটিই পল্লীর গান, লোকসংগীত। মানুষ যখন যা কিছুরই অভাববোধ করেছে, তখনই আর্টিফিশিয়াল কিছু তৈরি করার চেষ্টা করেছে। আজ থেকে দুহাজার বছর আগে হয়তো, যখন বসরায় মুক্তা পাওয়া যেতো, তখন মুক্তার দাম কম ছিলো। দেখা গেলো ধীরে ধীরে বসরার মুক্তা ফুরিয়ে যাচ্ছে। তখনই মানুষ কালচার করতে শুরু করলো। তেমনি কালচার করে মানুষ তার স্বরকে সফিসটিকেশন দিতে শুরু করলো। এক প্রকারের শিক্ষা পদ্ধতিতে রূপ দিতে শুরু করলো। তখন বিনম্র এবং আদ্র কণ্ঠে মানুষ বলল, কেমন আছেন? এটি কিন্তু সফিসটিকেটেড ব্যাপার। আমি মুখে বললাম, কেমন আছেন? (গম্ভীর এবং শান্ত কণ্ঠে) আমি ভেতরেও একই কথা বললাম বা মনে মনে বললাম না আপনি খারাপ থাকলে আমি খুশি হই, আপনি বুঝতে পারবেন না। সেরকম করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যেতে হয়েছে নিজেকে, নিজের তাগিদে। যেমন— রবীন্দ্রনাথ ভাষা কালচার করে তৈরি করেছেন। আগে খিস্তিখেউড় দিয়ে গান হতো, সেসব গান রবীন্দ্রনাথ রাখতে পারেননি। আমি তোমাকে ভালোবাসি, বলতে পারেননি। ফেইলিওর। আমি তোমার সঙ্গে প্রেম করবো— হাম তুমসে পেয়ার কারতে হ্যায়— হিন্দিতে বলা যায়। এক দো তিন চার পাচ ছে সাত আট ন দশ গেয়ারা বারা তেরা— দিয়ে হিন্দিতে গান করা যায়। রবীন্দ্রনাথ আসার পরে, বাংলা গানে এই রীতিটা চলবে না। তিনি কালচার্ড করেছেন ভাষা, সংস্কৃত করেছেন। সংগীত সেভাবে সংস্কৃত হয়েছে রাগের মাধ্যম। কোনো শাস্ত্র থেকে উদ্ভুত হয়নি, মানুষের মন থেকে উদ্ভুত হয়েছে। আমরা শাস্ত্র দেখিয়ে প্রথমেই ভয় দেখাই, ভয় পাবেন কেন? ভয় পাওয়ার কোনো কিছুই রাগ সংগীতে নেই। রাগ সংগীত হলো ভালোবাসার সংগীত। তবে কালচার্ড, ডেভেলপ্ড এবং উন্নত। সেসব কিভাবে করতে হয়? তার যে শিক্ষা, রুচি, এগুলো বেঁধেছি। কাজেই, পল্লীগীতি হচ্ছে রুট। রুট থেকে গাছ হলো। গাছে যে ফল হলো, সেটি হচ্ছে তার বেড়ে ওঠার প্রমাণ। রাগসংগীতও তাই। মাটি থেকে জন্মেছে, নদী থেকে জন্মেছে, পাহাড় থেকে জন্মেছে।

পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী। ছবি: আসাদুজ্জামন প্রামাণিক

পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী। ছবি: আসাদুজ্জামন প্রামাণিক

 

গ্লিটজ: সবশেষে জানতে চাই, আপনার মেয়ে কৌশিকী চক্রবর্তী সম্প্রতি ব্যান্ড করেছেন ‘সাখী’ নামে। ব্যান্ডের প্রত্যেকেই রাগসংগীতের বংশ পরম্পরা শিক্ষায় অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ইতোমধ্যে নিজেদের ক্ষেত্রে তারা প্রতিভার প্রমাণ দিয়েছেন। রাগ সংগীতের দল গঠন করাকে আপনি কি মনে করছেন?

অজয় চক্রবর্তী: খুব ভালো বলছি, কারণ এটি গিটারের ব্যান্ড নয়। ব্যান্ড বলতে যা বোঝায়, এককভাবে সফল হতে পারলে ছজনের সাহায্য নিতে হয়। কিন্তু যখন জাকির হুসেন ব্যান্ড বা দল করেন— প্রত্যেকেই এককভাবে শ্রেষ্ঠদের নিয়ে— তখন ব্যান্ডের অর্থ অন্যরকম হয়। সাখীও একইরকম এবং এর জন্য জাকির হুসেনের ব্যাপক অনুপ্রেরণা পেয়েছে কৌশিকী। তিনিই বেশি খোঁচাখুঁচি করেছেন কৌশিকীকে। আমি কোনো আপত্তি করিনি। কারণ, তার দলে যারা আছেন তারা প্রত্যেকেই এককভাবে নিজেকে প্রেজেন্ট করার ক্ষমতা রাখেন এবং বিখ্যাত শিল্পীর সন্তান তারা। কৌশিকীর সাহায্য নিয়ে তাদের চলতে হয় না। হয়তো অভিজ্ঞতা কম, কৌশিকী এদিক থেকে এগিয়ে। কৌশিকীকে ওরা বড় দিদি হিসেবে মানে, ভালোবাসার ভাইব্রেশন কাজ করে তাদের ভেতর। তবে সাখী এখনও তৈরির পথে এবং সফলভাবে তৈরি হলে ফল খুবই ভালো হওয়ার কথা। এরজন্য তাদের ভালো এবং সঠিকটি গ্রহণ করতে হবে। ইট ডিপেন্ডস। কোনো জিনিসই কিন্তু আলটিমেট না। বারবার পরখ করে নিতে হবে। আর ভারতের ইতিহাসে এরকমটি হয়নি আগে।

গ্লিটজ: রবীশঙ্কর করেছিলেন…

অজয় চক্রবর্তী: রবীশঙ্কর অর্কেস্ট্রা করেছিলেন। সাখী অর্কেস্ট্রা দল নয়। আমি যদিও কৌশিকীর প্রতিদিন নানা ভুলভ্রান্তি ধরিয়ে দেই। ভ্রান্তি থেকে ওঠার চেষ্টা করতে হয়। সেই জায়গায়, আই অলওয়েজ ট্রাই টু ইন্সপায়ার হার।