'দ্বিতীয় আবদুল আলীম হওয়া সম্ভব নয়'

বাংলা পল্লীগীতির অসম্ভব জনপ্রিয় একজন শিল্পী আবদুল আলীম। প্রবাদপ্রতিম এই শিল্পী মৃত্যুর ৪০ বছর পরেও পুজনীয়, স্মরণীয় হয়ে আছেন। জন্মের ৮৪তম বছরে ব্যক্তি আবদুল আলীম এবং শিল্পী আবদুল আলীমকে স্মৃতির কুঠুরি থেকে তুলে আনলেন তার জৈষ্ঠ্য সন্তান জহির আলীম।

জহির আলীমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 July 2015, 03:16 AM
Updated : 29 July 2015, 03:34 AM

‘হলুদিয়া পাখি’, ‘ও পদ্মা নদীরে’, ‘আমারে সাজাইয়া দিও’, ‘সে পারে তোর বসত বাড়ি’, ‘নবী মোর পরশ মনি’, ‘আল্লাহু আল্লাহু তুমি জাল্লে জালালু’, ‘দুঃখ সুখের দোলায় দোলে’, ‘থাকবো না আর এই আবেশে’, ‘ও যার আপন খবর’, ‘ঢেউ উঠেছে সাগরে রে’- এমন অংসখ্য গান কিংবা বর্ষীয়ান কণ্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিনের সঙ্গে গাওয়া ‘সুজনসখী' চলচ্চিত্রের গান ‘সব সখিরে পার করিতে নেবো আনা আনা’- চিনিয়ে দেয় আবদুল আলীমকে।

গানগুলো যখন কারো কানে পৌছায় সে এমনিতেই বুঝতে পারে, গানগুলো আবদুল আলীমের গাওয়া। গানগুলোর সুরের সঙ্গে মানুষ যেমন পরিচিত হয়ে ওঠেন সহজে, তেমনি কণ্ঠের স্বাতন্ত্র্যের কারণে। আরেকটি কারণ, সে সময় শিল্পী সংখ্যা বেশ কম। এখনকার মতো এতো মিডিয়া বা আয়োজন ছিল না, অত্যাধুনিক সাউন্ড সিস্টেম ছিল না। মূলত গ্রামোফোন রেকর্ড আর রেডিওর মাধ্যমেই আবদুল আলীম ও তাঁর সমসাময়িক শিল্পীদের উত্থান, প্রচার ও প্রসার হয়েছে। একজন শিল্পীকে সপ্তাহে তিন থেকে চারদিন গান গাইতে হতো। এখন আমরা মাসে একবার গাই।

আবদুল আলীম অথ্যাৎ আমার আব্বা নানা সাক্ষাৎকারে তার সময়ের কথা বলেছেন। তখন পারিশ্রমিকও ছিল কম। তবে আমার মনে হয়েছে, শিল্পীদের কাছে পারিশ্রমিকের ব্যাপারটা মুখ্য ছিল না। তাদের কাছে মুখ্য ছিল, গানটা কিভাবে ভালো বা সুন্দর করা যায়। এই সৌন্দর্য্য ফুটিয়ে তোলা হতো - দোতরা, বাঁশি, তবলার মাধ্যমে। কিছু কিছু গানে বেহালা। আমার মতে, এতো অল্প যন্ত্র সহায়তা নিয়ে একেকটা গানকে জনপ্রিয় করে তোলার পেছনে আব্বার কৃতিত্ব আছে।

তাঁর কণ্ঠ ছিল খোদা প্রদত্ত। সেই কণ্ঠে যে কোন গান তুলে নিতে পারতেন সাবলীলভাবে। কোনো গানই কঠিন বলে কিছু মনে হতো না। আমরা এখন গান করি, অনেক কঠিন গান তিনি কী অবলীলায় গেয়েছেন, গাইতে গিয়ে বিস্মিত হই। কণ্ঠের প্রতি তাঁর নিয়ন্ত্রণ ছিল প্রচণ্ড, তেমনি ছিল গলার রেঞ্জ। এসব দিক থেকে আমি মনে করি, তাঁর মতো কণ্ঠশিল্পীর অবস্থান এখনও কেউ নিতে পারেনি বা ভাঙ্গতে পারেনি।

আব্বাসউদ্দিনকে ভেঙ্গে আবদুল আলীম প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন ঠিকই। কিন্তু আবদুল আলীমকে বিচ্যুত করতে পারেনি কেউ। আর হবে কী না ভবিষ্যতে জানি না।

আবদুল আলীম জন্ম নেন ১৯৩১ সালের ২৭ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার তালিবপুর গ্রামে। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ১৯৭৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মাত্র ৪৩ বছর বয়সে ঢাকায়। আমার দাদা প্রয়াত শেখ ইউসুফ, দাদী প্রয়াত খোদেজা বিবি।

আব্বার স্কুলের বন্ধু ছিলেন ভাষা আন্দোলনে শহীদ বরকত। তারা একই গ্রামে বড় হয়েছেন, বাবলা গ্রামের একই স্কুলে পড়েছেন। সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন শহীদ বরকতের বাবা। তারা স্কুলে যেতেন ঠিকই। তবে ক্লাসের মাঝ সময়ে পালাতেন। তাদের নিয়মিত কাজ ছিল বাঁশ বাগানের ঝোপে পাখির ডিম সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে নানা দুষ্টুমি। কোনো একভাবে তার হাতও ভেঙ্গেছিল বাঁশ বাগানে। আর খোলা প্রান্তরে গিয়েই গলা ছেড়ে গান গাইতেন। যদিও খুব লাজুক প্রকৃতির ছিলেন তিনি।

আব্বা গান গাইতে অনুপ্রাণীত হন পাশের বাড়ির চাচা সম্পর্কিত এক জনের বাজানো কলের গানে (গ্রামোফোন প্লেয়ার) বাজনা ‍শুনে। আব্বা কে. মল্লিকের বেশ কিছু গান সে সময় গাইতে পারতেন। এই গাওয়াটা এক পর্যায়ে অনুরোধের আসরে গিয়ে দাড়ায়। সবাই জানতো তিনি গান গাইতে পারেন। তাই তাকে গান গাওয়ার অনুরোধ করা হতো। কিন্তু লজ্জায় গাইতে পারতেন না। এক সময় এইভাবেই তিনি নানা অনুষ্ঠানেও গাইতে শুরু করলেন। কিছুদিন লেটো দলেও কাজ করেছেন।

আমার চাচা আব্বাকে ১১ বছর বয়সে গ্রামেই বসবাসকারী ওস্তাদ গোলাম আলীর কাছে নিয়ে যান। প্রায় একই সময়ে চাচা কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসার অনুষ্ঠানে গান গাইবার জন্য তার নাম লিখিয়ে আসেন। সেই ঘটনা শুনেছিলাম - নাম ঘোষণার পর দুরুদুরু বুকে মাইক্রোফোনে গান শুরু করলেন - ‘সদা মন চাহে মদিনা যাবে’- ধর্মীয় গানটি। অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে এসেছিলেন শের-এ-বাংলা একে ফজলুল হক। তিনি গান শুনে খানিকক্ষণ কেঁদেছিলেন। আব্বাকে কাছে ডেকে নাম-পরিচয় জেনে নিয়ে তখনই তাকে মার্কেটে নিয়ে পাঞ্জাবী, পায়জামা, শেরোয়ানি, টুপিসহ আরও অনেক কিছু কিনে দিয়েছিলেন।

আলিয়া মাদ্রাসায় গান গেয়ে গ্রামের ফেরার কিছুদিন পরে কলকাতা থেকে আব্বার ডাক আসে। গীতিকার মোহম্মদ সুলতান তাকে কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাছে নিয়ে যান। কাজী নজরুল ইসলাম তখন মেগাফোন কোম্পানিতে দিনরাত কাজ করতেন।

কাজী নজরুল ইসলাম আব্বার নাম শুনেই গাইতে বলেন। আব্বা গেয়েছিলেন - ‘উঠুক তুফান পাপ দরিয়ায়’। কবি আব্বার গান শুনেই মেগাফোন কোম্পানির ধীরেন দাসকে দুটি গান রেকর্ড করার আদেশ দেন। তখন মোহম্মদ সুলতানেরই লেখা - ‘আফতাব ওই বসলো পাটে’ এবং ‘তোর মোস্তফাকে দে না মাগো’ - গান দুটি রেকর্ড করা হয়। এরপরে আবার গ্রামে চলে যান আব্বা। তবে গ্রামে আর মন বসে না তার।

প্রথম গান রেকর্ডের কিছুদিন পরই - ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হলে আব্বা দশ-পনেরো দিন পরেই ঢাকা চলে আসেন। ঢাকায় কোনো আত্মীয়-স্বজন ছিল না আমাদের। বয়স তখন ১৬ কি ১৭, বিয়েও করেননি। আজিমপুরে বাসা ভাড়া নেন। কিছু দিন যেতেই আব্বা মনে করলেন, গান-বাজনা করতে হলে তাকে আলাদা থাকতে হবে। সে সময়ে জিন্দাবাহার দ্বিতীয় লেনে এক আখড়া ছিল। আখড়া বলতে ভারত থেকে আসা শিল্পীদের মেসবাড়ি। ভারত থেকে আসা সব শিল্পীদের দেখা পাওয়া যেতো সেই মেসে।

প্রথমদিনেই আব্বা ওস্তাদ মমতাজ আলী খানের সঙ্গে দেখা করে তার কাছে গান গাওয়া শিখতে চাইলেন। মমতাজ আলী খান রাজী হলেন। যে ঘরটিতে বসে তারা কথা বলেছিলেন সেই ঘরের এক বিছানায় ঘুমাচ্ছিলেন গণসংগীতের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী আবদুল লতিফ। আবদুল লতিফ নাকী ঘুমের মধ্যে মিষ্টি কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছিলেন এবং মনে করেছিলেন স্বপ্নেই শুনতে পাচ্ছেন সেই কণ্ঠস্বর। ঘুম ভেঙ্গে গেলেই সেই কণ্ঠ আর শুনতে পাবেন না, ভয়ে তিনি চোখও খুলছিলেন না। গান গাওযা শেষ হতেই আবদুল লতিফ চোখ খুলে দেখেন তার পাশেই বসে আছেন আমার আব্বা। আবদুল লতিফ উঠে বসলেন, মমতাজ আলীকে বললেন, এই ছেলের এতো মিষ্টি গলা আর আমি আবদুল লতিফ কী গান করি? লতিফ চাচার গলা খারাপ সেকথা কেউ বলতে পারবেন না। তবু তিনি এই তূলনা করলেন। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হলো আব্বার।

মমতাজ আলী খান থাকতেন হাতিরপুল। তার কাছে আব্বার গান শেখা চলতে থাকলো। এদিকে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী হিসাবে নির্বাচিত হলেন। রেডিওতে তিনি প্রথম গাইলেন -‘ও মুর্শিদ পথ দেখায়া দাও’। প্রথম গানেই বাজিমাৎ, সারাদেশে তোলপাড় উঠল তার গান শুনে। তখন অবশ্য সারা বাংলাদেশে মিলিয়ে খুব বেশি রেডিও ছিল না। রেডিওতে তার গান শুনেই অনুরোধের চিঠি আসা শুরু করলো। আব্বাও প্রোগ্রাম পেতে শুরু  করলেন। এর মধ্যেই পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের সঙ্গে পরিচিত হলেন।

এরপর মোহম্মদ হোসেন খসরুর কাছে উচ্চাঙ্গসংগীতের তালিম নিতে শুরু করলেন আব্বা। ঠুমরির জন্য দারুণ জনপ্রিয় ছিলেন মোহম্মদ হোসেন খসরু। তাঁর কাছে আব্বা তিন বছর শিখতে পেরেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর আব্বা আর কারো কাছে শিখতে গেলেন না। আব্বা এর মধ্যেই অনেক রাগ-রাগিনী রপ্ত করেছিলেন। ‘ক্যায়া কারু সাজনি’ বন্দিশটা দারুণ গাইতেন। একদিন আবু হেনা মোস্তফা কামাল চাচা ঘরে না ঢুকে জানালার পাশে দাড়িয়ে আব্বার উচ্চাঙ্গ সংগীতের চর্চা শুনছিলেন। তাঁকে দেখে আব্বা আর গাইবেন না মনে করে গান শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি ঘরে ঢোকেননি সেদিন।

ঢাকায় রেকর্ড কোম্পানি এলো, নাম এইচএমভি। সেখান থেকেই আব্বার প্রথম রের্কড বের হয় ১৯৬০ সালে। গানটির প্রথম কলি, ‘প্রেমের মরা জলে ডোবে না’। এই গান আব্বা শিখেছিলেন আমার মা শ্রদ্ধেয় জমিলা খাতুনের কাছে। আরেকটি ছিল কানাই লাল শীলের, ‘অসময়ে বাঁশি’।

আমার মা এক সময় গান গাইতেন। বিয়ের আগে কিছুদিন কবি জসীমউদ্দীনের বাসায় যেতেন। কবি তসের আলীর দলে গাইতেন। পরে গান গাওয়া একেবারেই ছেড়ে দেন। অনেক গানের সুর জানতেন আমার মা। আব্বার গাওয়া - ‘প্রেমের মরা জলে ডোবে না’ থেকে শুরু করে ‘দয়া করে এসো দয়াল’- আমার মায়ের সংগ্রহের গান। চারিত্রিক দিক থেকে দেখেছি আমার আব্বা-মা দুজনেই ছিলেন সরল প্রকৃতির।

অনেক বয়স হলো মায়ের, ৮০ পার করেছেন। বয়সের ভারে ন্যুজ, দুর্বল। তবু আমাদের মা আছেন বলেই কিন্তু আমরা সব ভাইবোন কিছুটা স্বস্তি পাই। মা আছে, ছায়া তো আছে। আব্বা মারা যাওয়ার সময় আমরা ছোট ছিলাম। তখন মা ছিলেন আমাদের সব, এখনও। আমার মায়ের জন্য দোয়া চাই। মাঝে মাঝে মনে হয় আমার বাবার এতো বড় শিল্পী হওয়ার পেছনে আমার মায়ের অবদান সবচেয়ে বেশি।

২.

আব্বা মানুষকে খুব সম্মান করতেন। বিনয়ী ছিলেন, অহংকারের ছিটেফোঁটাও দেখিনি। তার ব্যাক্তিত্বটাই ছিল এমন - কাউকে বাড়তি খাতির করতেন না কিন্তু সম্মান দিতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না। আর সাধারণ কথার মাধ্যমেই মানুষকে হাসানোর ক্ষমতা ছিল।

আব্বাকে এক দিক থেকে ব্যতিক্রম দেখেছি, কোথাও গান গেয়ে বাসায় ফিরে তিনি কখনও বলতেন না। খুব নীরব থাকতেন বাসায়। আমরা যেমন আজ কোথায় গান গাইলাম, কাল কোথায় যাবো - বলি সবাইকে। তিনি কিছুই বলতেন না। যেন এটা তার নিত্যদিনের কাজ। তার কণ্ঠ ছিল, তিনি মনে করতেন তার সদ্বব্যবহার করাই তার কাজ। কোনো অহংবোধ না থাকায় কোনো কোনো অনুষ্ঠানে খালি গলায় গাইতেও দ্বিধাবোধ করতেন না। শুনেছি, অন্তত দুবার মাইক্রোফোনে নষ্ঠ হওয়ায় তিনি খালি গলায় গেয়ে অনুষ্ঠান শেষ করেছেন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তিনি ইসলামী গানের প্রতি ঝুঁকে পরেন। সে সময় অনেক ইসলামী গান গেয়েছেন, একটি লংপ্লে রেকর্ড করেছিলেন।

একদিন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পরেন আব্বা। অসুখ তার শরীরে অনেক আগেই বাসা বেঁধেছে যদিও, তিনি টের পাননি অথবা কাউকে জানাননি। আমরা অসুস্থ হলেই অস্থির হয়ে পরতেন অথচ নিজের অসুখের সময় নির্বিকার থাকতেন। কোনো অসুখের পরোয়া করতেন না। তাঁর দুজন চিকিৎসক ছিলেন, একজন হোমিওপ্যাথিক, একজন অ্যালোপ্যাথিক। আব্বার সঙ্গে তাঁদের বিগলিত আচরণ দেখেছি।

আমাদের বাসায় প্রতিদিন চিঠি আসতো। চিঠিগুলো খুলে একবার দেখেই রেখে দিতেন। আমি চিঠিগুলো চুরি করে পড়তাম। চিঠি পড়ে আমার চোখ বেয়ে পানি নামতো। ভক্তির কী নমুনা! গাইবান্ধার এক ভক্ত একবার লিখলেন-- “গুরুদেব, আপনার অসুখের কথা শুনিয়া আমার খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হইয়া গিয়াছে। যেদিন শুনলাম আপনি অসুস্থ সেদিন থেকে অনেক খারাপ লাগিতেছে।”

আব্বা কিছুটা ভীতু প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। যুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের ভয়ে আব্বা জরুরী কাগজ-পত্রের সঙ্গে অনেক চিঠি পুড়িয়েছেন। তার মতে, এসব রাখলে সমস্যা হতে পারে।

‘দস্যুরাণী’ চলচ্চিত্রের জন্য গান রেকর্ডিংয়ে আমাকে নিয়ে গেলেন ঢাকা রেকর্ডে। প্রয়াত ধীর আলী মিয়া গান তুলে দিচ্ছিলেন। রাত প্রায় ৯টা পর্যন্ত রেকর্ডিং হলো। জীবনে প্রথমবার সরাসরি রের্কডিং দেখা হয় আমার। এখন মনে হয়, তখন কী কঠিন ছিল গান গাওয়া! তিন ঘণ্টা রিহার্সাল করে আবার দু ঘণ্টা টানা রেকর্ডিং। রেকর্ডিংয়ের সময় কোরাস শিল্পীদের মধ্যে একজন বারেবারে ভুল করছিলেন, সময় বেশী লেগেছিল।

সাংস্কৃতিক দলের সদস্য হয়ে ১৯৬৬ সালে চীন সফর করেন আবদুল আলীম।

আব্বা গানের কথা দেখলেই বুঝতে পারতেন গানটা কেমন হবে। ‘হলুদিয়া পাখি’ গানটি তিনি পেয়েছিলেন সিরাজুল ইসলাসের কাছ থেকে। সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে তার পরিচয় হয় ব্যাংকে। সিরাজুল ইসলাম গান লেখেন বলে জানান আব্বাকে। আব্বা তখনই তার লেখা দেখতে চান। অল্প সময়ের মধ্যে দেখে আব্বা ‘হলুদিয়া পাখি’ গানটি পছন্দ করেন। গানটির রেকর্ড প্রকাশের পরেই খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

আব্বা যা গাইতেন তাই জনপ্রিয়তা পেত। এরমধ্যে আমার কাছে ভালো লাগে-- ‘হলুদিয়া পাখি’, ‘আমারে সাজাইয়া দিও’, ‘স্বরূপ তুই বিনে’, ‘সর্বনাশা পদ্মা নদী’, ‘রূপালী নদী’, ‘আমার হীরামন পাখি’ ইত্যাদি। চলচ্চিত্রের মধ্যে ভালো লাগে ‘দস্যুরাণী’ ইত্যাদির গান। তাঁর কোনো গানকেই আমি ছোট করে দেখতে পারি না। আজকে উন্নত প্রযুক্তি যদি তিনি পেতেন। আমার মনে হয়, আরও বেশি ভালো গান হতো তাকে দিয়ে। তাঁর সময়ে প্রযুক্তি বলতে, তিন-চারটা মাইক্রোফোন।

অনুষ্ঠানে গাইতে গেলে আব্বার একটা রীতি ছিল, শেষে গাইতে দিলে তিনি খুব রাগ করতেন। কিন্তু তিনি গাইলে যে আর কেউ থাকবে না, একথা তাকে বোঝানো যেতো না।

প্লেনে চড়তে ভয় পেতেন আব্বা। একবার উত্তরবঙ্গে গাইতে যাওয়ার কথা। সবাইকে প্লেনে করে নিযে যাবেন আয়োজকরা। সবার নামে টিকেট করা হয়েছে। তিনি এয়ারপোর্ট থেকে ফেরত চলে আসেন। আবহাওয়ার ভয়ে আর গেলেন না। কয়েকদিন পরে আয়োজক এসে কাঁদো কাঁদো অবস্থায় জানালেন, তিনি না যাওয়ায় খুব হাঙ্গামা হয়েছে। আব্বা তাকে অগ্রীম ফেরত নিয়ে যেতে বলেন। কিন্তু লোকটা টাকা ফেরত নিতে চান না। বলেন প্রয়োজনে আরও টাকা দেবেন, তবু একবার তাকে যেতেই হবে। পরে আব্বা রাজী হলেন এবং বাসে চড়েই গাইতে গেলেন।

আরেকবার গাইতে গিয়ে দেখলেন আব্বাকে যারা নিয়ে এসেছেন তাদের কেউ নেই। এদিকে স্টেশনে এসে দেখেন ঢাকা যাওয়ার ট্রেনও নেই। পরের দিন সকালে আব্বাকে রেডিওতে লাইভ গাইতে হবে। স্টেশনে বসে আছেন, এমন সময় এলো একটি কয়লার ইঞ্জিন। মাস্টার-ড্রাইভারের কথোপকথন শুনে জানতে পারলেন ইঞ্জিনটি ঢাকা যাবে। তিনি ড্রাইভারের সঙ্গে খাতির জমানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু ড্রাইভার কিছুতেই গলে না। শেষে আব্বা নিজের পরিচয় দিলেন। ড্রাইভার তবুও বিশ্বাস করে না। ড্রাইভার চ্যালেঞ্জ করে, যদি তিনি প্রকৃতই আবদুল আলীম হয়ে থাকেন, তবে গান শোনান। যদি গান শুনে মনে হয় তিনি সত্যিই আবদুল আলীম, তবেই জায়গা হবে ইঞ্জিনে। আব্বা সে পরীক্ষায় পাশ করলেন, তবে ঢাকা পৌছান পর্যন্ত সারারাত ড্রাইভারকে গান শোনাতে হয়েছিল।

আমাদের গান শেখার ব্যাপারে সচেতন ছিলেন আব্বা। তিনি প্রাধান্য দিতেন লেখাপড়ার প্রতি। সবাই ঠিকমতো লেখাপড়া করছে কি না, পরীক্ষায় কে কেমন ফল করছে - সব কিছুর খোঁজ রাখতেন তিনি। মাঝেমধ্যে তিনি আমাদের নিয়ে বসতেন, গান গাওয়া শেখাতেন।

আমি স্কুল জীবন থেকে গান গাওয়া শুরু করি। স্কুলের বিভিন্ন নাটকে বিবেকের চরিত্রে গান গাইতাম। শিক্ষকরা আমাকে খুব পছন্দ করতেন, স্নেহ করতেন।

৩.

ভাষা আন্দোলনের সময় - ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়’, ‘এদেশ তোমার এদেশ আমার’- এরকম আরও কিছু কোরাস গানে কণ্ঠ দিয়েছেন আব্বা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘বাংলাদেশের জয়গান’ শীর্ষক রেকর্ড বের হয় ঢাকা রেকর্ড থেকে।

দেশের প্রথম চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’-এ গান গেয়েছেন আব্বা। একটা সময়ে পরিচালকরা ভাবতে বাধ্য হতেন আবদুল আলীমের জন্য অন্তত একটি গান রাখার। তারা ভাবতেন, রাখলে অবশ্যই সেটা ভালো হবে। জীবিতকালে আব্বাকে ছাড়া চলচ্চিত্রের গান হতো না। তার গলাটা ফিল্মি গানের জন্য অত্যন্ত মানানসই ছিল। স্বভাবত কারণেই তাকে দিয়ে গাওয়াতেন পরিচালকরা। সে সময়ে কিন্তু অনেক ভালো শিল্পী ছিল, প্রত্যেকেই দারুণ গাইতেন। কিন্তু ফিল্মে গাইলে দেখা গেছে, গানের ভাব ঠিকমতো ফুটে ওঠেনি। ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ চলচ্চিত্রে আব্বা গেয়েছেন ‘একূল ভাঙ্গে কূল গড়ে’, ‘দুঃখ সুখের দোলায় দোলে’ ইত্যাদি। তিনি আনুমানিক ৫০০ গান গেয়েছেন, যা মধ্যে রয়েছে ১০০টি চলচ্চিত্রের গান।

আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন এমন ব্যাক্তিত্ব্যদের মধ্যে লালন শাহ, হাসন রাজা, মনমোহন দত্ত, আবদুল লতিফ, সিরাজুল ইসলাম, মমতাজ আলী খান, কানাই লাল শীল, শমশের আলী, ধীর আলী মিয়া, একেএম আবদুল আজিজ, রওশন ইজদানি প্রমুখের লেখা অনেক গান গেয়েছেন শিল্পী আবদুল আলীম।

৪.

আবদুল আলীমের গান গাওয়া সহজ কাজ না। অনেকে ঠিকমতো তুলতে পারেন না, অনেকে ভুল সুরে গান। গানগুলো গাওয়ার জন্য আরও বেশি পরিশ্রম করা এবং মনোযোগ দেওয়া উচিত সবার। একই কারণে নতুন করে গাওয়া গানগুলোতে প্রাণ নেই। আদি সুরকে বিকৃত করে গাওয়া হচ্ছে। এটাকে আমি ভালো মনে করি না।

২০১৩ সালে একটা ফাউন্ডেশন করেছি আব্বার নামে, ফাউন্ডেশনের সভাপতি হয়েছি আমি। তার গানগুলো গাওয়ার প্রশিক্ষণ দেওয়াই মুখ্য কাজ। একইসঙ্গে বাবার গাওয়া গানগুলো পাকিস্তান থেকে সংগ্রহ করার চেষ্টা করবো। গানগুলো মূল্যবান সম্পদ।

ফাউন্ডেশনের আরও কাজের মধ্যে থাকবে তার জন্ম, মৃত্যুবাষির্কী পালন করা। আমার সঙ্গে আমার চার ভাইবোন থাকবেন। আর যাদের তৈরি করতে পারবো তারাও আমাদের ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম পরিচালনার কাজে সহায়তা করবেন।

ইতোমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে - ‘প্রিজারভেশন অ্যান্ড প্রোমোশন অফ দ্য সংস অফ আবদুল আলীম, দ্য লিজেন্ডারি সিংগার অফ বাংলাদেশ’ - শীর্ষক ইউনেস্কোর অর্থায়নে এক প্রকল্পের মাধ্যমে। বাংলাদেশি এক গবেষককে নিয়ে আব্বার জন্মভিটা পরিদর্শনে যাবো কিছুদিনের মধ্যেই।

আমি মনে করি, তাঁর গাওয়া গানগুলোর প্রচার হওয়া দরকার। না হলে গানগুলো একদিন হারিয়ে যাবে। এক্ষেত্রে মিডিয়াকে একটা ভূমিকা রাখতে হবে। গানগুলো প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে তাদের।

আজকে আকাশ সংস্কৃতিতে ছেয়ে গেছে পুরো বিশ্ব। এই সময়েই আমার বাবার গানগুলো বেশি প্রচার হওয়া প্রয়োজন। তাঁর গানই পারবে সত্যিকারের সুস্থ সংস্কৃতি বিকাশে অবদান রাখতে।

সবশেষে বলতে চাই, কাউকে অনুকরণ করে শিল্পী হওয়া যায় না। কারণ অনুরকরণ করলে তা স্থায়ী কিছু হয় না। বরং অনুসরণ করা উচিত। কারণ দ্বিতীয় আবদুল আলীম হওয়া সম্ভব না।