সংসারের স্বচ্ছলতা আনতে, স্ত্রী-সন্তানদের মুখে একটু হাসি ফুটাতে ধার-দেনা করে দেশের বাইরেও পাড়ি জমিয়েছিলেন মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ের স্থায়ী বাসিন্দা রফিক। কিন্তু মালয়েশিয়া ও লিবিয়ায় সাত বছর প্রবাসে কাটিয়ে পরিবারে স্বচ্ছলতা আনাতো দূরের কথা বিদেশ যাওয়ার খরচের টাকাও উঠেনি তার।
তাই দেশে ফিরে উপর্জনের একটা পথ খুঁজছিলেন রফিক; ব্যবসায়ী এক আত্মীয়ের পরামর্শে তা পেয়েও গেলেন। সেটা ১৯৯৮ সালের কথা; ঝুট কাপড় থেকে ক্যাপ তৈরি করে দেশ-বিদেশে বিক্রি করে প্রায় ১৭ বছরে সফল উদ্যোক্তায় পরিণত হয়েছেন রফিক।
কিন্তু প্রায় দেড় যুগের এই সফলতার যাত্রা যতটা সহজে বলা হলো, ততটা সহজ ছিল না; নানা চাড়াই উৎড়াই পেরিয়ে আসতে হয়েছে রফিককে। ব্যবসা বাড়াতে কারো কাছ থেকে ঋণ পাননি তিনি; এমনকি কোনো ব্যাংকও তাকে ঋণ দিতে রাজি হয়নি। শেষ পর্যন্ত গ্রামের বাড়ি বিক্রি করে কারখানা তৈরি করেছেন, যেখানে এখন ১৪-১৫টি মেশিনে প্রায় ৪০ জন শ্রমিক কাজ করছেন।
ক্যাপ ব্যবসায়ী ভাগ্নে আব্দুর রহমান পিন্টুর পরামর্শে তার কারখানায় প্রশিক্ষণ নিয়ে গাজীপুরের টঙ্গীতে একটি ভাড়া বাড়িতে ‘শাওন-রিপা ক্যাপ হাউজ’ নামে কারখানা বসিয়ে ক্যাপ তৈরির কাজ শুরু করেন রফিক। মূলধন না থাকায় গহনা বিক্রি করে ১৬ হাজার টাকা দিয়ে একটি সেলাই মেশিন দিয়ে শুরু করেন, যাতে দুজন দক্ষ কারিগর নিয়োগ করেন।
রফিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ছয় মাসে এ কাজে ভালো প্রফিট আসার পর ব্যবসা বাড়ানোর চিন্তা করতে থাকি। লোনের জন্য স্থানীয় বিভিন্ন ব্যাংকের দ্বারস্থ হলেও কোথাও লোন পাইনি। পরে এক লাখ ২০ হাজার টাকায় গ্রামের বাড়ির একটি ঘর বিক্রি করে লেদু রোড এলাকায় এক টুকরা জমি কিনে সেখানে বর্তমান কারখানা বসাই।
“এখন আমার কারখানায় ১৫টি মেশিন আছে। এখানে প্রায় চল্লিশ জন বেকারের কর্মসংস্থান হয়েছে। সিজনে প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছয়শ পিস এবং অফসিজনে প্রতিদিন আড়াইশ থেকে তিনশ ক্যাপ তৈরি হচ্ছে কারখানায়।”
এই দম্পতির সঙ্গে এখন মাঝে মাঝে কাজে যোগ দেন স্থানীয় ভাওয়াল বদরে আলম কলেজে পদার্থবিজ্ঞান পড়ুয়া ছেলে শাওন শেখও।
কারখানার জন্য প্রতি মাসে রফিককে দুই টন ঝুট ও দুই হাজার গজ থান কাপড় কিনতে হয়। প্রথমে নিজেই তৈরি করা ক্যাপ ঢাকার বঙ্গবাজার, বগুড়া, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি করতেন। পরে ক্যাপের পরিচিতি ও চাহিদা বাড়লে পাইকাররা এবং ভারতের ক্রেতারাও তার কারখানায় টুপি কিনতে চলে আসেন।
রফিক বলেন, “এলসি খুলতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। ভারতে ব্যবসায়ীদের বকেয়াতেও মাল দিতে হয়। পরে ওই বকেয়া টাকা উঠানো অনেক সমস্যা হয়। তাই অন্যের এলসিতেই মাল বিক্রি করি।”
তার কারখানায় বিভিন্ন ধরনের ক্যাপ তৈরি হচ্ছে; জনসন ক্যাপ, সুন্দরীতম ক্যাপ, আইয়ুব বাচ্চু ক্যাপ, নেট ক্যাপ, অক্ষর ক্যাপ ও প্যারাসুট ক্যাপ।
রফিক বলেন, “সরকার যদি আর্থিকভাবে আমাদের সহায়তা করতো তবে এ ব্যবসা আরো সফলভাবে করতে পারতাম। এলাকায় বেকারদেরও কর্মসংস্থান হতো। বেকার যুবক-যুবতীদের সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি ও বিপথগামী হওয়া থেকে রক্ষা করা সম্ভব হতো।”
১৬ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করা এই ব্যবসার আয় থেকে দত্তপাড়া এলাকায় চার কাঠা জমি কিনেছেন রফিক; কারখানার পাশে কেনা জমিতে ছোট দ্বিতল বাড়িও করেছেন।
“আমি এখন কোটিপতি। এ ব্যবসা করে অনেকেই কোটিপতি হতে পারেন।”
মাসে নয় হাজার টাকা বেতনে তার কারখানায় কাজ করেন ফাতেমা। তিনি বললেন, গার্মেন্ট কারখানায় চাকুরি না পেয়ে টুপি কারখানার কাজ নেন। এ আয় দিয়ে তার সংসার চলছে।
আরেক শ্রমিক মামুন বলেন, “পাঁচ বছর ধরে ওই কারখানায় চাকুরি করছি। মাস শেষে ছয় হাজার টাকা বেতন পাই।”
“স্থানীয় সুমন ও কামু গ্রুপের মাস্তান ও চাঁদাবাজরা মাঝে মাঝেই চাপাতি-রামদা-হকিস্টিক নিয়ে মহড়া দেয় ও মোটা অংকের টাকা দাবি করে। এসব দেখে পাইকারা ও বায়াররা ভয় পান। এ ব্যাপারে পুলিশকে জানালেও কোনো কাজ হয়নি।”
রফিক শেখের ছেলে শাওন জানান, ঘনবসতিপূর্ণ এ এলাকাটিতে শখানেক ছোট-বড় ক্যাপ তৈরির কারখানা রয়েছে। এ ক্যাপ পল্লীতে অনেক বেকার যুবক-যুবতি বেকারত্ব ঘুচানোর সুযোগ পেয়েছেন। ব্যবসায়ীরা উপযুক্ত সরকারি আর্থিক সহায়তা পেলে এ ব্যবসার প্রসার ঘটবে।
টঙ্গী থানার ওসি মোহাম্মদ আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “লেদু মেল্লা রোড এলাকায় চাঁদাবাজির খবরটি আমার নলেজে নাই। আর এ ব্যাপারে আমি কোনও অভিযোগও পাইনি।”