বাজেটের কর প্রস্তাব নিয়ে বস্ত্রখাতে আপত্তি

নতুন বাজেটে তৈরি পোশাক শিল্পের রপ্তানিতে উৎসে কর প্রায় আড়াই গুণ বাড়িয়ে ১ শতাংশ করার প্রস্তাব প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে এ খাতের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনগুলো।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 June 2015, 08:22 AM
Updated : 5 June 2015, 10:12 PM

শুক্রবার দুপুরে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের পোশাক প্রস্তুতকারী ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি আতিকুল ইসলাম বলেন, যেখানে মুনাফার পরিমাণ ২ থেকে ৩ শতাংশ, সেখানে ১ শতাংশ উৎসে কর দিলে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।

২০১৫-১৬ সালের বাজেট ‘বস্ত্র শিল্পবান্ধব বা ব্যবসাবান্ধব হয়নি’ বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

বিকেএমইএ, বিটিএমএ ও বিপিজিএমইএ’র শীর্ষ নেতারাও এ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।

পোশাক খাতের জন্য আমদানি করা মূলধনী যন্ত্রপাতির ওপর যে ১ শতাংশ শুল্ক প্রস্তাব করা হয়েছে তাও প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে সংগঠনগুলো।

আগের দিন জাতীয় সংসদে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের যে বাজেট প্রস্তাব অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তুলে ধরেছেন, তাতে তৈরি পোশাক পণ্যের রপ্তানি মূল্যের উপর আরোপিত বর্তমান দশমিক ৩০ শতাংশ উৎস কর বাড়ানোর কথা বলা হয়।

মুহিত বলেন, “আমাদের কাপড় এবং পোশাক শিল্প নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করে। এছাড়া আরো রপ্তানি দ্রব্যও এই সুযোগ পায়। এই সুযোগটি শুধু এক বছরের জন্য দেওয়া হয়েছিল।

“তাই এবার এই সুযোগ প্রত্যাহার করে তৈরি পোশাক, টেরি টাওয়েল, কার্টন ও এক্সেসরিজ, পাট ও পাটজাত পণ্য, হিমায়িত মাছসহ সকল রপ্তানি পণ্যের রপ্তানি মূল্যের উপর ১ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তনের প্রস্তাব করছি এবং একইসঙ্গে উক্ত কর সকল ক্ষেত্রে করদাতার চূড়ান্ত করদায় হিসেবে গণ্য করার প্রস্তাব করছি।”

এর আগে এই কর ছিল দশমিক ৮০ শতাংশ। কিন্তু ২০১৪ সালের এপ্রিলে রাজনৈতিক অস্থিরতার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকার তা কমিয়ে দশমিক ৩০ শতাংশ নির্ধারণ করে। এই উৎসে কর ছাড়ের সুবিধা ২০১৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত রপ্তানিকারকরা পাবেন বলে উল্লেখ করা হয়।

অর্থমন্ত্রী তৈরি পোশাক ছাড়াও আরও কয়েকটি রপ্তানি পণ্যে (হিমায়িত খাদ্য, পাট, চামড়া, সবজি ও প্যাকেটজাত খাদ্য) মোট রপ্তানির ওপর ১ শতাংশ হারে উৎসে কর আরোপের প্রস্তাব করেছেন।

এই বাজেট প্রস্তাবের ওপর প্রতিক্রিয়া জানাতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আতিকুল ইসলাম বলেন, “বর্তমানে গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল খাত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। এই পরিস্থিতিতে কোনো অনভিপ্রেত সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎসটি বিপর্যস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।”

এই বাজেটে রপ্তানিমুখী পোশাক ও বস্ত্র খাত ‘সবচেয়ে বেশি’ ক্ষতিগ্রস্ত হবে মন্তব্য করে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন,“বাজেট প্রস্তাবে সকল প্রকার রপ্তানি মূল্যের ওপরে উৎসে কর দশমিক ৩০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ করা হয়েছে, অর্থাৎ একধাপে ২৩৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে, যা বর্তমান পরিস্থিতিতে এই শিল্পের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যহত করবে।”

সরকারের এই প্রস্তাব জিডিপির ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন ও শ্রমঘন শিল্পায়নের লক্ষ্যের সঙ্গে ‘সাংঘর্ষিক’ বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

“এই অবস্থায় আমাদের বিনীত অনুরোধ, উৎসে আয়কর প্রস্তাব প্রত্যাহার করে চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের মত দশমিক ৩০ শতাংশ ধার্য করকে চূড়ান্ত কর হিসেবে গণ্য করা হোক”, বলেন আতিকুল ইসলাম।

একইসঙ্গে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে যে ১ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে, তাও প্রত্যাহার করে শূন্য শুল্কে আমদানির ব্যবস্থা করার দাবি জানান তিনি।

“কারণ মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে খরচ বাড়লে শিল্পের প্রসার হবে না, নতুন শিল্প স্থাপন আরও চ্যালেঞ্জিং হবে।”

বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ  তৈরি পোশাক খাত থেকেই আসে, যার আকার বর্তমানে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার।

আতিকুল ইসলাম বলেন, “আমরা ৪৪ লাখ শ্রমিক ভাইয়ের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছি, যার মধ্যে ৩২ লাখই নারী। উৎস কর কমিয়ে পূর্বের অবস্থায় নিলে আরও অনেক বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে পারব বলে কথা দিচ্ছি।”

কারওয়ানবাজারে বিজিএমইএ ভবনে আয়োজিত এ সংবাদ সম্মেলনে বিকেএমইএ সভাপতি এ কে এম সেলিম ওসমান, বিটিএমএ সভাপতি তপন চৌধুরী ও বিজিপিএমইএ সভাপতি রাফেজ আলম চৌধুরীও বক্তব্য দেন।

অন্যদের মধ্যে বিজিএমইএর সহ-সভাপতি এস এম মান্নান কচি, সাবেক সভাপতি আনোয়ারুল আলম চৌধুরী পারভেজ, সাবেক সহ-সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান ও বিকেএমইএর সহ-সভাপতি আসলাম সানি উপস্থিত ছিলেন।

তপন চৌধুরী বলেন, “সরকার আশির দশক থেকে বস্ত্র খাতে প্রণোদনা দিয়ে আসছে ঠিকই। কিন্তু তার বিনিময়ে এই খাত বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। দেশে কর্মসংস্থান তৈরি করেছে। আমরা কর দিতে চাই না- তা ঠিক নয়, তবে আমাদের টিকে থাকারও সুযোগ দিতে হবে।”

সেলিম ওসমান বলেন, “আমাদের বিক্রি কমে গেছে, আবার দামও কমেছে। এদিকে শ্রমিকদের জন্য একটি তহবিল গঠন করতে হয়েছে, যেখানে দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ হারে অর্থ জমা করতে হবে। অ্যাকর্ড, অ্যাল্যায়েন্সের কারণে খরচ বাড়ছে। সবগুলো একবারে চাপিয়ে দিলে পারব না।”

রাফেজ আলম চৌধুরী বলেন, “এই উৎসে কর দুইবার করে দিতে হচ্ছে। সুতা, কাপড় কেনা পর্যায়েও একবার দিতে হয়। সরকার বিষয়টি নিশ্চই বিবেচনা করতে পারে।”

বর্তমানে পোশাক শিল্পের জন্য যেসব সুবিধা রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হল রপ্তানির বিপরীতে ৭ শতাংশ ঋণ। দেশের অন্য কোনো খাত এই সুদে ঋণ পায় না, এমনকি এর দ্বিগুণ সুদ দিয়েও ঋণ পাওয়া কঠিন।

এছাড়া রয়েছে ইডিএফ থেকে বিদেশি মুদ্রায় ঋণ নেওয়ার সুবিধা। সরকার এই তহবিলটির পরিমাণ বাড়িয়ে এখন ২ বিলিয়র ডলার করেছে। নগদ সহায়তা রয়েছে ৫ শতাংশ। যদিও এই নগদ সহায়তা তৈরি পোশাক শিল্প সরাসরি পায় না; পায় তৈরি পোশাক শিল্পের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প (টেক্সটাইল, প্যাকেজিং, প্রিন্টিং ইত্যাদি)।

বাজেটে এই খাতের অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতি, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ও প্রি-ফেব্রিকেটেড বিল্ডিং উপকরণ আমদানিতে ভ্যাট প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু অন্য খাতের উদ্যোক্তারা এসব পণ্য আমদানি করলে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়।

সর্বশেষ সরকার তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের ‘এক্সপোর্টার রিটেনশন’ কোটা (ইআরকিউ) ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করে।