করজালে মুহিতের স্বপ্নজাল বুনন

অনলাইনে পণ্য কেনাবেচা করলে ভ্যাট বা মূসক গুনতে হবে। সাজসজ্জার প্রশিক্ষণেও গাঁটের পয়সা ছাড়তে হবে বেশি। হাতের মুঠোয় আসা প্রযুক্তি মোবাইল ফোনের ব্যবহার করলে দিতে হবে বাড়তি ৫ শতাংশ শুল্ক।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 June 2015, 05:57 PM
Updated : 5 June 2015, 10:10 PM

এমন অনেক নতুন খাতকে করজালের আওতায় এনে এবং বিদ্যমান অনেক খাত বা সেবা থেকে বাড়তি কর আদায়ের লক্ষ্যকে সামনে রেখে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জন্য তিন লাখ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

বিপুল অংকের বাজেটের খরচ মেটাতে দুই লাখ ৮ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছেন অশীতিপর মুহিত।

এর মধ্যে এক লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকার বেশি আদায় করবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর; যার ৬০ শতাংশই আসবে ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর থেকে।

কঠিন এই লক্ষ্যকে চ্যালেঞ্জ মনে করছেন জ্যেষ্ঠ অর্থনীতি গবেষক জায়েদ বখত।

তিনি বলছেন, “এই বাজেটের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে- অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করা। একদিকে সরকারি বিনিয়োগ বাড়িয়ে, আর অন্যদিকে বেসরকারি বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করে। এইটাই হচ্ছে মূল উদ্দেশ্য।

“তবে বিশাল রাজস্ব আদায়ের যে টার্গেট ধরেছেন অর্থমন্ত্রী তা আদায় হলে বাহবা পাবেন তিনি।”

এই লক্ষ্য পূরণে তিন বছরের মধ্যে সক্রিয় করদাতার সংখ্যা ১২ লাখ থেকে ৩০ লাখ করার মধ্য দিয়ে ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের আগেই চরম দারিদ্র্যকে বিদায় করার প্রত্যাশা ‘অশোধনীয় আশাবাদী’ মুহিতের।

ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্তের মন জয়ের চেষ্টায় করমুক্ত আয়ের সীমা দুই লাখ ২০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে আড়াই লাখ টাকা করলেও উচ্চ মধ্যবিত্ত ও উচ্চ বিত্তদের করজালে আটকাতে চেয়েছেন অর্থমন্ত্রী।

মনোযোগী দৃষ্টি দেখা যায় পুঁজিবাজারের দিকে। বাজার সম্প্রসারণের পাশাপাশি বেসরকারি খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোরও চেষ্টা আছে অর্থমন্ত্রীর নবম বাজেট বক্তৃতায়।

বাজেটে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরেছেন গতবারের চেয়ে কম, সাত শতাংশ।

সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং জ্বালানি তেলের দাম খুব ওঠা-নামা করবে না, এমন আশায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরেছেন ৭ শতাংশ।

মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ২ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছেন।

“আমার বাজেটের মূল্য লক্ষ্য হচ্ছে- ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির ফাঁদ ভাঙা।”

শর্ত বলেছেন, ‘নির্বোধ রাজনীতি’ পরিহার।

আরেক গবেষক আহসান এইচ মনসুর বলছেন, “সরকার যে বাজেট প্রস্তাব করেছে তা বাস্তবায়নের জন্য বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ আকর্ষণে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে।

“বাজেটে যে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে, সেটা নিঃসন্দেহে উচ্চাভিলাষী। এই রাজস্ব ও ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ত্বরান্বিত করার কোনো বিকল্প নেই।”

“আর এটা করা সম্ভব হলেই সামাজিক ও অন্যান্য খাতে যে ব্যয়ের লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে, তা অর্জন হবে,” বলেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর।

অন্যদিকে সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদের আহমেদের চোখে, প্রস্তাবিত বাজেটের আয়-ব্যয়ের কোনো লক্ষ্যই বাস্তবমুখী নয়।

সংসদের বাইরে থাকা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে ‘অনির্বাচিত’ আখ্যায়িত করে এই বাজেট নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া জানাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে।   

তবে দলটির নেতা সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এই বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। এজন্য সরকারি খাতে ‘ব্যাপক দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও অপচয়’কে দায়ী করেছেন তিনি।

বৃহস্পতিবার মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে মুজিব কোট পরিহিত ‘ফুরফুরে মেজাজে’ অর্থমন্ত্রী মুহিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে জাতীয় সংসদে প্রবেশ করেন সোয়া ৩টার দিকে। প্রথা মেনে হাতে কালো ব্রিফকেস।

স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর অনুমতি নিয়ে চলতি অর্থবছরের সম্পূরক বাজেট এবং আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উত্থাপন শুরু করেন অর্থমন্ত্রী। আর তা ছিল সবুজ মলাটের বই থেকে, যা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার রং।

২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত আয় ও ব্যয়ের চিত্র তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী দেশের মানুষকে আশা দিয়েছেন বাংলাদেশকে নির্ধারিত সময়ের আগেই মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়ার।

অঙ্কের হিসাবে বাজেট

সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে মিল রেখে অর্থমন্ত্রী মোট ব্যয় প্রস্তাব করেছেন ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা। তবে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ৩ হাজার ৯’শ ৯৬ কোটি টাকা যোগ করলে আদতে বাজেটের আকার দাঁড়ায় ২ লাখ ৯৯ হাজার ৯৬ কোটি টাকা।

বিশাল ব্যয় পরিকল্পনায় আয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ১৪ হাজার ২৪৩ কোটি টাকা। এই হিসেবে বাজেট ঘাটতি দাড়ায় ৮৬ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা।

২ লাখ ৯৯ হাজার ৯৬ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেটে সরকার আয় ধরেছে ২ লাখ ১৪ হাজার ২৪৩ কোটি টাকা।

এতে রাজস্ব আয় ২ লাখ ৮ হাজার ৪৪৩ কোটি, বিদেশি অনুদান ৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।

রাজস্বের প্রায় সব ১ লাখ ৮২ হাজার ২৪৪ কোটি আসবে কর থেকে। কর ব্যতীত প্রাপ্তি ২৬ হাজার ১৯৯ কোটি। রাজস্ব আয়ের বড় অংশের জোগান আসবে আয়কর, শুল্ক ও মূসক থেকে। এনবিআর আয় করবে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। এনবিআর বহির্ভূত কর থেকে আসবে ৫ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা, আর কর ব্যতীত প্রাপ্তি ২৬ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা। রাজস্ব ও অনুদান মিলে সরকার আশা করছে ২ লাখ ১৪ হাজার ২৪৩ কোটি টাকা আয়ের।

স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের বরাদ্দ বাদে মোট ব্যয় ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকার ব্যয়ে অনুন্নয়ন ব্যয় ১ লাখ ৮৪ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা। আর উন্নয়ন ব্যয় ১ লাখ ২ হাজার কোটি ৫৫৯ কোটি টাকা।

অনুন্নয়ন ব্যয়ের মধ্যে অনুন্নয়ন রাজস্ব ব্যয় ১ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা। এতে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ মেটাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৩ হাজার ৩৯৬ কোটি, বিদেশি ঋণের সুদ মেটাতে ১ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা। আর অনুন্নয়ন মূলধনী ব্যয় ১৯ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা।

১ লাখ ২ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকার উন্নয়ন ব্যয়ে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি এডিপির আকার ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এডিপিবহির্ভূত প্রকল্পে আছে ৩ হাজার ৩৩৯ কোটি টাকা, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিতে ১ হাজার ৫৮৭ কোটি এবং রাজস্ব বাজেট হতে উন্নয়ন কাজে দেওয়া হয়েছে ৬৩৩ কোটি টাকা।

আয় ও ব্যয়ের বড় এই ফারাক, ঘাটতি মেটানো হবে কোত্থেকে?

৮৬ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকার ঘাটতি মেটাতে বরাবরের মতো এবারও অর্থমন্ত্রী ভর করেছেন অভ্যন্তরীণ এবং বিদেশি ঋণের উপর।

তার আশা, অভ্যন্তরীণ ঋণ থেকে পাওয়া যাবে ৫৬ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। আর বিদেশি ঋণ থেকে ২৪ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। যদি দরকার হয় তাহলে অর্থমন্ত্রী ব্যাংক থেকে ঋণ নেবেন ৩৮ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। আর ব্যাংকবহির্ভূত ঋণ ১৮ হাজার কোটি টাকা। এতে কেবল সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকেই তার আয়ের আশা ১৫ হাজার কোটি টাকা। এসব থেকে পাওয়া যাবে ৮০ হাজার ৮৫৭ কোটি। বাকি ৫ হাজার ৮০০ কোটি আসবে বিদেশি অনুদান থেকে। সব মিলে ঘাটতি অর্থায়ন ৮৬ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা।

প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ আগের বছরের তুলনায় না বাড়ার বিপরীতে খাদ্য ও সামাজিক নিরাপত্তায় খরচ বাড়িয়েছেন মুহিত। চলতি বাজেটে এ দুই খাতে বরাদ্দ ছিল ৮ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ৯ হাজার ১১২ কোটি টাকা করা হয়েছে।

সামাজিক সুরক্ষার আওতায় বয়স্ক ভাতাভোগীর সংখ্যা ২৭ লাখ ২৩ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৩০ লাখ করেছেন অর্থমন্ত্রী। একইসঙ্গে বিধবা ও স্বামী নিগৃহিতা মহিলা ভাতাভোগীর সংখ্যা ১০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ১১ লাখ ১৩ হাজার করেছেন। স্বচ্ছল প্রতিবন্ধীসহ সুবিধা বঞ্চিত অন্য ভাতাভোগীদের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে।

৩০ লাখ করদাতার সন্ধানে

করের উপর ভরসা করে ৩ লাখ কোটি টাকার বাজেট দেওয়া অর্থমন্ত্রী মুহিত আগামী তিন বছরে সক্রিয় করদাতার সংখ্যা আড়াই গুণ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন।

বর্তমানে বাংলাদেশে ১১ লাখের কিছু বেশি মানুষের কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) রয়েছে, তবে এদের সবার কাছ থেকে কর আদায় করতে পারে না সরকার।

মুহিত বলেন, “বাংলাদেশে আয়কর দেন সামান্য কতিপয় ব্যক্তি। ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে কমবেশি ১২ লাখ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।”

করজালে আরও আড়াই গুণ মানুষকে আনার লক্ষ্যটি বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিভাবে- তার উত্তর তিনি দিয়েছেন এভাবে- “কিছু দিন আগে রাজস্ব বোর্ড কয়েকটি এলাকায় জরিপ চালিয়ে অনেক স্বচ্ছল লোকের সন্ধান পেয়েছে। এদের সবার ওপর এই বছর আয় বা কর্পোরেট কর ধার্য করা হবে।”

এই রকম জরিপ চলতে থাকবে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের লক্ষ্য হল যে, আমাদের এই মেয়াদের শেষ বছর ২০১৮-১৯ সালে সক্রিয় করদাতার সংখ্যা ৩০ লাখে উন্নীত করতে হবে।”

বর্তমানে উৎসে আয়কর (টিডিএস) থেকেই আয়করের বেশিরভাগ আদায় হয়। উৎসে আয়কর কাটতে স্বতন্ত্র একটি কর অঞ্চল গঠনের চিন্তা-ভাবনা চলছে বলে জানান তিনি।

করজালের বাইরে থাকা সক্ষম খানাকে করের আওতায় এনেই এই লক্ষ্য পূরণে সব উপজেলায় আয়কর কার্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা জানিয়েছেন মুহিত।