সরকারি ক্রয়-সূচির ‘ফাঁদে’ কৃষক

চাষিকে ‘ন্যায্যমূল্য’ দিতে প্রতি বছর সরকারিভাবে ধান-চাল সংগ্রহের ঘোষণা এলেও কৃষকরা বলছেন, এতে ফড়িয়ারাই লাভবান হয়।

সুলাইমান নিলয় উত্তরাঞ্চল থেকে ফিরেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 May 2015, 12:06 PM
Updated : 24 May 2015, 11:27 AM

কৃষক থেকে সরাসরি শস্য না কেনা এবং ক্রয়ে দুর্নীতি ও কৃষকবান্ধব ক্রয়সূচি না হওয়াকে দুষছেন তারা।

খাদ্য অধিদপ্তরের সংগ্রহ বিভাগের পরিচালক ইলাহী দাদ খানের স্বাক্ষরে গত ৩০ এপ্রিল প্রকাশিত এক বিজ্ঞপ্তিতে ধান ও চাল কেনার ঘোষণা এসেছে। এতে বলা হয়, চলতি বছর ১ লাখ মেট্রিক টন ধান এবং ৯ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন চাল কিনবে সরকার।
 

১ মে থেকে ৩১ অগাস্ট পর্যন্ত চলবে এই সংগ্রহ কার্যক্রম। এছাড়া সেদ্ধ চালের জন্য মিলারদের সঙ্গে চুক্তি করতে ৩১ মে পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে।

প্রতিকেজি ধানের মূল্য ২২ টাকা এবং প্রতিকেজি চালের মূল্য ৩২ টাকা দরে এবার বোরো কিনবে সরকার।

এর আগে ১ এপ্রিল সংগ্রহ বিভাগের অপর এক প্রজ্ঞাপনে অভ্যন্তরীণ গম সংগ্রহের কথা বলা হয়। এতে বলা হয়, ওইদিন থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত এই গম সংগ্রহ করা হবে।

কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি এক লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন গম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রতি কেজি গমের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২৮ টাকা।

গত বছরের ১৮ নভেম্বর দেওয়া হয় গত মৌসুমের আমন সংগ্রহের প্রজ্ঞাপন। যেখানে ৩২ টাকা কেজি দরে ৩ লাখ টন আমন চাল সংগ্রহ করে সরকার। এর জন্য ১৮ নভেম্বর থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় নির্ধারিত ছিল।

এই সূচি নিয়েই যতো অভিযোগ কৃষকদের। তারা বলছেন, এভাবে কেনার সূচি নির্ধারণের ফল তারা পাচ্ছেন না।

ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ এলাকার ভাকুড়া গ্রামের কৃষক তফাজ্জল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত চৈত্র মাসে আমাদের এলাকায় গম আসছিল। আমি নিজেও গম চাষ করছি। গম আসার পর আমরা ১৫-১৮ টাকা কেজি দরে গম বিক্রি করে দিছি।

“সরকার এখন গম কিনতেছে। আমগো লাভ কী? কৃষকের গমের বেচাবিক্রি শেষ। গম বেচনের লাইগ্যা মেম্বর চেয়ারম্যান নেতাগোরে ধরা শুরু হইছে।”

ফসল ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সরকারিভাবে ধান-গম কেনা শুরু করার পরামর্শ দেন এই কৃষক।

তিনি বলেন, “ফসল উঠলে বাজার পড়তে থাকে। সরকার সেই সময় কিনলে বাজারটা ঠিক হয়। এখানে সময় যত দিবেন, ততই বাইরের লোক সুযোগ নিব।”

নিজেরে চাচাতো ভাইয়ের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার তথ্য তুলে ধরে তফাজ্জল বলেন, “আমার ভাই ১ বিঘায় ২৫ মন করে গম পাইছিল। ১৫ বিঘা জমিতে গম করছে। কিন্তু বাজার তো মার্ডার করে দিছে!”

পঞ্চগড়ে প্রতি ৫০ শতকে এক বিঘা ধরা হয়।

কৃষকের অভিযোগ শোনার পর যোগাযোগ করা হয় পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জের সরকারি খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাজেদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানালেন, বাজার অনুকূলে থাকলে তারা ধান-চাল কিনবেন।

মো. আশরাফুল আলম প্রতিবছরই ধান বিক্রি করেন। তার বাড়ি ওই গুদাম থেকে কয়েক শত গজ দূরে। তাও কোনোদিন তা সেখানে বিক্রি করতে পারেননি বলে জানান তিনি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমি প্রতিবছর ১৫-২০ মন ধান বিক্রি করি। এখানে একটা গুদাম আছে। কিন্তু কোনোদিন আমার নিজের ধান এখানে বিক্রি করতে পারি নাই।”

এক প্রশ্নের জবাবে আশরাফুল বলেন, “ধান বিক্রি করতে হলে কৃষকের কৃষি কার্ড লাগে। এইডা পাওয়াই অনেক কঠিন। আমি গেলেই ধান নিব না।

“চাল তো গুদামে বিক্রি করা যায় না। ধানে নানা ঝামেলা। সরকার ৩-৪ মাস ধরে ধান-চাল কিনার সময় দেয়। এরমধ্যে ইচ্ছামতো দাম কমাইয়া কৃষক থেকে মিল মালিক-ফড়িয়ারা কিনে ফেলে। এরপর তারা সরকারি দামে গুদামে চাল দেয়। লাভটা তাগো থাকে।”

দেবীগঞ্জ উপজেলার পূর্ব দেবীডুবার বর্গাচাষি মো. আতাউর রহমান বলছেন, কৃষক ধান ধরে রাখতে পারে না মূলত কয়েকটা কারণে। প্রথমত কাটা ও মাড়াই খরচ ধান বিক্রির টাকা থেকেই দিতে হয়। তা ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে পানির টাকাও বাকি থেকে যায়। সেটাও এখান থেকেই আসে।

“কৃষকরা তো ধানের দিকে চাইয়া থাকে। পোলায় জামা চাইলে কয়, ধান উঠলে দিমু। এ রকম সংসারের অনেক খরচ জমায়া রাখি ধানের জন্য। ধান ওঠার পর আর বিক্রিতে দেরি করা সম্ভব হয় না।”

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে কৃষকদের অভিযোগগুলোর সঙ্গে একমত পোষণ করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিব্যবসায় ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক অধ্যাপক শংকর ‍কুমার রাহা।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “যারা সরকারি ক্রয়ের এই ব্যবস্থা করেছেন, তাদের উদ্দেশ্যটা হয়ত ঠিকই আছে। কিন্তু কৃষক এর দ্বারা তেমন একটা উপকৃত হচ্ছে না। এখানে সব জায়গায় একটা প্যারালাল শ্রেণি গড়ে উঠেছে। যারা এই সুবিধা নিয়ে যায়।

“এর প্রতিবিধানে কৃষকদেরকে সংগঠিত হতে হবে। এই ব্যবস্থা থেকে কৃষক যেন উপকৃত হয়, সেটা নিশ্চিতে সরকারকেও ভূমিকা রাখতে হবে।”

“সরকার যে শস্য ক্রয় করতে চায়, সেটা দ্রুত ক্রয় করতে হবে। কর্মকর্তাদেরকে সততার সঙ্গে কাজ করতে হবে। যে ফসল নিয়ে যায়, তার চেহারা দেখেই বোঝা সম্ভব- সে কৃষক কিনা।”

নীলফামারী জেলার খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. শফিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কৃষি বিভাগ প্রতি ইউনিয়নে কৃষকের তালিকা করে। সেই তালিকা ধরে আমরা ফসল ক্রয় করি। এক কার্ডধারী দুই বার আসতে পারে না।

“তবে কার্ড প্রদানে অন্য সামাজিক প্রভাব যে নেই, সেটা বলব না। কিছু থাকতে পারে। তবে এটা মনে রাখতে হবে, ধরেন, আমি চাকরি করি। এখন আমার বাড়িতে যদি কৃষি থাকে, আমি কি কৃষি কার্ড নিয়ে ফসল বিক্রি করতে পারব না?”

তার মতে, সরকারের ধান-চাল সংগ্রহের কারণে কৃষকরা ‘কিছুটা’ হলেও উপকৃত হয়।

“সরকার যেভাবেই ধান-চাল সংগ্রহ করুক না কেন, কৃষকও তার ফল ভোগ করে।  সরকার ধান-চাল না কিনলে বোরো ধানের মন ২-৩ শ টাকা হয়ে যাওয়াও অসম্ভব না। দেখবেন সরকারি ক্রয়ের ঘোষণার পরই দাম বাড়ে।”