যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিটেন্স বাড়ছে

চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৭৪ কোটি ডলারের রেমিটেন্স দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা।

আবদুর রহিম হারমাছি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 May 2015, 04:23 AM
Updated : 1 May 2015, 07:38 AM

যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসীদের পাঠানো এই অর্থের পরিমাণ জুলাই-মার্চ সময়ে দেশে আসা মোট রেমিটেন্সের ১৫ শতাংশের বেশি।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েতসহ অন্যান্য দেশ থেকে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ কমলেও যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমানের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি মন্দার ধকল থেকে ‘ঘুরে দাঁড়ানোয় সেখান থেকে বাংলাদেশে রেমিটেন্স প্রবাহও বাড়ছে।

সম্প্রতি ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশ্ব ব্যাংক-আইএমএফের বসন্তকালীন বৈঠক শেষে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমেরিকার অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর প্রভাব আমাদের অর্থনীতিতেও পড়েছে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা এখন বেশি আয় করছেন। ফলে বেশি অর্থ দেশে পাঠাতে পারছেন।”

এছাড়া প্রবাসীদের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং ব্যাংকিং চ্যানেলে দ্রুত অর্থ স্থানান্তরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন পদক্ষেপে এই সুফল পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে করেন আতিউর রহমান।

বিশ্ব ব্যাংক-আইএমএফের  বৈঠকে রেমিটেন্স বিষয়ে এক সেমিনারে প্যানেল আলোচক হিসেবেও অংশ নেন বাংলাদেশের গভর্নর।

যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথা বলেও ‘পরিস্থিতি বদলানোর’ ইংগিত পাওয়া গেল। 

গত ১৫ বছর ধরে ওয়াশিংটন ডিসিতে আছেন ফারুক আহমেদ। প্রথম দিকে ট্যাক্সি চালাতেন, এখন নিজেই একটি গাড়ি কিনে ভাড়ায় চালান।

ফারুক বলেন, “ভালই আছি ভাই…। নিজের ইচ্ছামতো কাজ করি। বাংলাদেশ দূতাবাসসহ বাঁধা কিছু কাস্টমার আছে। প্রয়োজন হলে কল করে। আমি গাড়ি নিয়ে হাজির হই…।

প্রতিদিনের সব খরচ বাদ দিয়েও সাত-আটশ ডলারের মতো হাতে থাকে ফারুকের। ছেলে-মেয়ের পড়ালেখার খরচসহ সংসার খরচ চালানোর পর কিছু টাকা দেশেও পাঠাতে পারেন।

“ইকনোমিক ক্রাইসিসের কারণে মাঝে আয় কম হত। এখন আমেরিকানরা আবার খরচ করতে শুরু করেছে... আমাদেরও আয় বেড়েছে,” বলে চলেন হাসি-খুশি ফারুক।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় ৮০ লাখ বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। তাদের অধিকাংশই রয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে, কাজ করছেন বিভিন্ন শ্রমঘনিষ্ঠ পেশায়।

যুক্তরাষ্ট্রে সব মিলিয়ে প্রায় এক লাখের মতো বাংলাদেশি রয়েছেন, যাদের মধ্যে নিউ ইয়র্কেই থাকেন বেশি। নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস ও জ্যামাইকায় বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশির বসবাস।

জ্যামাইকার হিলসাইড এভিনিউয়ে ‘স্টার কাবাব রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড পার্টি হল’ চালান বাংলাদেশের শিবলী মাহমুদ।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তাদের উপার্জনও বাড়ছে।”

জ্যাকসন হাইটসের খান ইলেকট্রনিক্সের ম্যানেজার রিজভী নেওয়াজ বাবু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের দোকানে বাঙালিরাই বেশি কেনাকাটা করেন। আয়-রোজগার এখন মোটামুটি ভাল।”

যেসব দেশ থেকে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স আসছে, সেই তালিকায় যুক্তরাষ্ট্র রয়েছে তৃতীয় অবস্থানে।

২০১৪-১৫ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে বিভিন্ন দেশ থেকে মোট এক হাজার ১২৬ কোটি ডলার বাংলাদেশে এসেছে রেমিটেন্স হিসাবে, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে ১৭৪ কোটি ডলার।

গত কয়েক বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৯-১০ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৪৫ কোটি ১৯ লাখ ডলারের রেমিটেন্স দেশে এসেছিল। পরের অর্থবছরে তা বেড়ে ১৮৫ কোটি ডলার দাঁড়ায়।

বিশ্ব মন্দার কারণে ২০১১-১২ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা রেমিটেন্সের পরিমাণ ১৫০ কোটি ডলারে নেমে আসে। মন্দার ধকল কাটতে শুরু করায় ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা বেড়ে ১৮৬ কোটি ডলারে দাঁড়ায়।

গভর্নর আতিউর রহমান আশা করছেন, চলতি অর্থবছর শেষে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিটেন্সের পরিমাণ ২৫০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখত বলেন, বাংলাদেশের যারা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে আছেন, তারা মূলত বিভিন্ন খাতে শ্রমিক হিসাবে কাজ করেন। আর বিভিন্ন সময়ে ডিভি ভিসায় যারা যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন তারাও মোটামুটি ভালো কাজ করেন।

“সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত প্রবাসীদের আয়-খরচ দুটোই বেশি। মন্দার কারণে কিছু দিন তারা বেশি অর্থ দেশে পাঠাতে পারেননি। এখন অবস্থা বদলাতে থাকায় বেশি পাঠাচ্ছেন।”

এক্ষেত্রে মুদ্রা বাজারের স্থিতিশীলতাও ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে বলে মনে করছেন অর্থনীতির এই গবেষক।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশে আসা রেমিটেন্সে সৌদি প্রবাসীদের অবদান বরাবরই বেশি। তবে গত অর্থবছরে সেখান থেকে রেমিটেন্স কিছুটা কমেছে।

২০১৩-১৪ অর্থবছরে সৌদি আরব থেকে ৩১১ কোটি ৮৮ লাখ ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যেখানে তার আগের অর্থবছর এসেছিল ৩৮৩ কোটি ডলার।

এ হিসাবে সৌদি আরব থেকে গত অর্থবছরে রেমিটেন্স কমেছে ১৯ শতাংশ।

চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে সৌদি আরব প্রবাসীরা ২৪৪ কোটি ডলারের রেমিটেন্স দেশে পাঠিয়েছেন, যা এই সময়ে আসা মোট রেমিটেন্সের ২১ শতাংশ।

এর আগে ২০০৯-১০ অর্থবছরে সৌদি আরব থেকে ৩৪২ কোটি ডলারের রেমিটেন্স দেশে আসে। তার আগের অর্থবছরে আসে ৩২৯ কোটি, ২০১১-১২ অর্থবছরে ৩৬৮ কোটি এবং ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৩৮২ কোটি ডলার আসে।

আকামা পরিবর্তনসহ ভিসা জটিলতার কারণে সৌদি আরব থেকে রেমিটেন্স কমেছে বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান।

তিনি বলেন, “সৌদি আরবে আকামা পরিবর্তনের  (পেশা পরিবর্তন বা নবায়ন) জন্য সেখানকার শ্রমিকদের বেশ ভাল অংকের অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। সে কারণে দেশটি থেকে গত অর্থবছরে রেমিটেন্স কম এসেছে।”

শুধু সৌদি আরব নয়, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ থেকেও রেমিটেন্স কমেছে।

মধ্যপ্রাচ্য থেকে রেমিটেন্স প্রবাহ কমায় গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে আগের বছরের চেয়ে  ১ দশমিক ৬ শতাংশ রেমিটেন্স কম আসে। অথচ তার আগের বছরে রেমিটেন্স বেড়েছিল ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ।

২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রবাসীরা মোট ১৪ দশমিক ২২ বিলিয়ন  ডলারের রেমিটেন্স দেশে পাঠিয়েছেন, যেখানে আগের অর্থ বছরে পাঠিয়েছিলেন ১৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার।

তবে চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৭ দশমিক ২১ শতাংশ রেমিটেন্স বেশি এসেছে।