পাঁচ হাজার কোটি টাকা ক্ষতির হিসাব সিপিডির

বছরের শুরু থেকে রাজনৈতিক অস্থিরতায় অর্থনীতিতে ৫ হাজার কোটি টাকা উৎপাদন ক্ষতির এটি হিসাব দিয়েছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ- সিপিডি।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 April 2015, 03:11 PM
Updated : 5 April 2015, 03:11 PM

আসন্ন বাজেট নিয়ে রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে সামগ্রিক অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি তুলে ধরতে গিয়ে এই হিসাব জানায় গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি।

বছরের শুরুতে গত ৩ জানুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কার্যালয়ে আটকে পড়ার পর বের হতে বাধা পেয়ে লাগাতার অবরোধের ডাক দেন। ফেব্রুয়ারিতে তার সঙ্গে শুরু হয় প্রায় লাগাতার হরতাল।

এই কর্মসূচিতে সহিংসতায় শতাধিক মানুষের মৃত্যুর পর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ডামাডোলে আন্দোলন অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়ার মধ্যে তিন মাস পর খালেদার কার্যালয় ছাড়ার দিন সিপিডির এই সংবাদ সম্মেলন হয়।

রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক সেন্টার ইনে সংবাদ সম্মেলনে গবেষণা ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক তৌফিকুল ইসলাম খান।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান, সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য, গবেষক মোয়াজ্জেম হোসেনও উপস্থিত ছিলেন।

তৌফিকুল বলেন, “রাজনৈতিক এই অস্থিরতা না থাকলে অর্থনীতিতে যে উৎপাদন হয়েছে, তার সাথে আরও ৪৯০০ কোটি টাকার বেশি উৎপাদন হতে পারত। অবরোধ-হরতালের কারণে তা হতে পারেনি।”

১১টি খাতে এই উৎপাদন ক্ষতির কারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধির শূন্য দশমিক ৫৫ শতাংশ অর্জন হবে না বলে মনে করেন তিনি। 

৫ জানুয়ারি থেকে ১৭ মার্চ পর্যন্ত যে ১১টি খাতের ক্ষতির হিসাব করেছে সিপিডি, সেগুলো হচ্ছে- কৃষি, পোল্ট্রি, চিংড়ি, তৈরি পোশাক, প্লাস্টিক, পরিবহন, পর্যটন, ব্যাংক ও বীমা, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা, আবাসন ও শিক্ষা।

তৌফিকুল বলেন, “এসময়ে কৃষি খাত বড় ক্ষতির মধ্য দিয়ে গেছে। যে পরিমাণ আয় হতে পারত, তা হয়নি। উৎপাদিত ফসল মাঠেই পচে গেছে। কৃষকরা বাধ্য হয়েছেন কম দামে পণ্য বিক্রি করতে। কৃষকের লাভ চলে গেছে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের পকেটে।”

কৃষি খাতে ৩৯৮ কোটি টাকা, পোল্ট্রিতে ৬০৬ কোটি টাকা ক্ষতির হিসাব দেন তিনি। চিংড়ি রপ্তানি ২৫ শতাংশ কমে এখাতে উদ্যোক্তাদের ৭৪১ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে সিপিডির হিসাবে।

রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ৫০ শতাংশ অর্ডার বাতিল এবং ডলারের দরপতন মিলিয়ে তৈরি পোশাক খাতে ১ হাজার ৩১৮ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানান সিপিডির গবেষক।

প্লাস্টিক খাতে ২৪৪ কোটি টাকা, পরিবহন খাতে ৮৫ কোটি, পর্য‌টনে ৮২৫ কোটি, ব্যাংক ও বীমায় ১৫৬ কোটি, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায় ২৩২ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে হিসেব কষেছে সিপিডি।

তৌফিকুল বলেন, “কিছু ক্ষতির অর্থনৈতিক মূল্য পরিমাপ করা যায় না। তবে এসব খাতের ক্ষতি ভবিষ্যতে অর্থনীতিকে প্রভাবিত করবে।”

সামষ্টিক অর্থনীতির মুল্যায়নে তিনি বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে রাজস্ব আয়, মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি, বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহ স্থবির হয়ে পড়েছে।

তবে অর্থনীতির কিছু সূচক বিশেষ করে মুল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ, বিনিময় হার, বাজেট ঘাটতি ইতিবাচক রয়েছে জানিয়ে সিপিডির গবেষক বলেন, যে কারণে অর্থনীতিতে একটি শক্তিও রয়েছে।

রাজস্ব ঘাটতি হতে পারে ২৫০০০ কোটি টাকা

চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে, তা থেকে কমপক্ষে ২৫ হাজার কোটি টাকা কম আদায় হতে পারে বলে মনে করছে সিপিডি।

তৌফিকুল বলেন, আয়কর ও ভ্যাট আদায়ে যে উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল তা অর্জন না হওয়া এবং করবহির্ভূত রাজস্ব আদায় কম হওয়ায় এই ঘাটতি থাকবে।

চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে ১ লাখ ৪৯ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। কিন্তু প্রথম ৬ মাসে আদায় হয়েছে ৫৯ হাজার ৬৩ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৩৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ।

সিপিডি মনে করে, আগামী অর্থবছরে সরকারের উচিত হবে রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি মেনে নিয়ে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা।

একই সঙ্গে রাজস্ব বোর্ডের কর আদায়ের ক্ষেত্র বাড়ানো, এনবিআরের আধুনিকায়ন কার্যক্রমে গতি আনা, কর ফাঁকি রোধ এবং কর বহির্ভূত রাজস্ব আদায় বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

সিপিডি বলছে, সরকারি ব্যয়ে বড় ধরনের পরিবর্তন না হলেও নতুন যে বেতন কাঠামো বাস্তবায়নের কথা বলছে তা করতে গেলে অতিরিক্ত ২২ হাজার কোটি টাকা লাগবে। এটি সরকারের জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।

একারণে নতুন বেতন কাঠামো একবারে বাস্তবায়ন না করে পর্যায়ক্রমে করার পরামর্শ দিয়েছে তারা।

তৌফিকুল বলেন, বাজেট ঘাটতির অর্থায়ন সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এতে সরকারের সুদ ব্যয়ের চাপ বাড়ছে। এজন্য সঞ্চয়পত্রের কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুদ হার পুনর্নির্ধারণ করা দরকার।

জ্বালানি তেলের দাম কমার সুযোগ নিয়ে সরকার ভর্তুকি কমাবে বলে আশা করছে সিপিডি।

“জ্বালানি তেলের জন্য বিপিসিকে যে ভর্তুকি দিতে হয় এখন সেটা লাগছে না। তবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি অন্যান্য সময়ের মতোই বাস্তবায়ন হচ্ছে। যেটা আমরা ভালো মনে করছি না।”

সিপিডি দেখিয়েছে, চলতি অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতাভুক্ত ২৬টি প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এসব প্রকল্প সময়মতো বাস্তবায়ন হলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার যে লক্ষ্য তা অর্জন সহায়ক হবে।

সিপিডি বলছে, এর মধ্যে ১১টি প্রকল্প রয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের। এসব প্রকল্প থেকে দুই ৮৪২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। এসব বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হলে বিদ্যুৎ খাতে যে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, তা কম হবে।

চলতি অর্থবছরের সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) আমদানিতে যে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, বছর শেষে তা আরও কমবে বলে মনে করছে প্রতিষ্ঠানটি।

বাজেট বাস্তবায়ন ঠিকভাবে করতে বিকেন্দ্রিকরণের পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি। সরকার যে জেলা বাজেট করেছে, জেলা পর্যায়ে তার কোনো প্রতিফলন নেই বলেও তাদের পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে।

বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফের শর্তযুক্ত ঋণ প্রসঙ্গে সিপিডির গবেষকরা বলেন, এসব সংস্থা যেসব সংস্কার করার শর্তে ঋণ দিচ্ছে সেইসব সংস্কার সরকারের ভেতর থেকেই হওয়া উচিত।

সামগ্রিক অর্থনীতি নিয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতিতে বর্তমানে অনেকগুলো ইতিবাচক দিক রয়েছে। বিশেষ করে মুল্যস্ফীতি ও সুদ হারের নিম্নমুখিতা, স্থিতিশীল বিনিময় হার, কম বাজেট ঘাটতি, বৈদেশিক আয়-ব্যয়ে উদ্বৃত্ত এবং ভর্তুকির চাপ কম থাকা।

“তবে মূল কাঠামোগত সমস্যা হচ্ছে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগে তেজিভাব আসছে না। এর অন্যতম কারণ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, সঙ্গে যোগ হয়েছে অনুদার রাজনৈতিক পরিবেশ।”