বাজেটে করের হার বৃদ্ধি চান না ব্যবসায়ীরা

নতুন বাজেটে করের হার না বাড়িয়ে করের আওতা বৃদ্ধি এবং সেইসঙ্গে খাত ভিত্তিক ভ্যাট নির্ধারণের দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 April 2015, 03:12 PM
Updated : 1 April 2015, 03:12 PM

আর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান এবারের বাজেটকে ‘স্বপ্ন বাস্তবায়নের বাজেট’ হিসেবে অভিহিত করে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানোর কথা জানিয়েছেন।

বুধবার ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন উপলক্ষে এক প্রাক-বাজেট আলোচনা সভার আয়োজন করে এনবিআর।

পুরো মাস জুড়েই এই প্রাক-বাজেট আলোচনা চলবে। ১৪টি সভায় ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, পেশাজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার প্রতিনিধিদের মতামত নেবে এনবিআর।

রাজধানীর সেগুনবাগিচাতে এনবিআরের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন নজিবুর রহমান।

অংশ নেয় পর্যটন, দোকান মালিক সমিতি, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় ব্যবসায়ী সমিতি, হোটেল ও রেস্তোরাঁ সমিতি, সুপার মার্কেট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, সিকিউরিটি সার্ভিস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, কুরিয়ার সার্ভিস, এয়ার এক্সপ্রেস অ্যাসোসিয়েশন, ট্যুর অপারেটরস, মুদ্রণ শিল্প সমিতি, পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সমিতির প্রতিনিধিরা এবং এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক আব্দুল হক ও এনবিআরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

সভায় আমদানি শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ও আয়কর নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনা হয়।

বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা তাদের প্রস্তাব তুলে ধরার পাশাপাশি মূসক পরিশোধ নিয়ে যেসব জটিলতা ও হয়রানি হয় তা তুলে ধরেন।    

সভার শুরুতে এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান আসন্ন বাজেট কেমন হবে তার একটি ধারণা তুলে ধরেন। পাশাপাশি রাজস্ব আদায় ব্যবস্থায় যে সংস্কার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে তাও জানান ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের।

নজিবুর রহমান বলেন, “আগামী বাজেট হবে বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের বাজেট। সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নিয়েছে সেই লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা থাকবে বাজেটে।”

চলতি বাজেটে এক লাখ ৪৯ হাজার ৭২০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য আছে। আগামী বাজেটে এই পরিমাণ আরও বাড়বে বলে জানান নজিবুর রহমান।    

ভ্যাট সার্কেলের কর্মকর্তারা দোকানদারকে হয়রানি করছেন বলে এনবিআরের চেয়ারম্যানের কাছে অভিযোগ করেন বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির চেয়ারম্যান এস এ কাদের কিরণ।

একইসঙ্গে অনলাইনে ভ্যাট নিতেও কর্মকর্তারা অনাগ্রহ দেখাচ্ছে বলে জানান তিনি।

কিরণ বলেন, “মাঠ পর্যায়ের ভ্যাট কর্মকর্তারা এখন প্যাকেজ ভ্যাট নিতে চাচ্ছে না। আমরা হয়রানির শিকার হচ্ছি। কর্মকর্তারা একবার বলছেন, ৪ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে, আবার বলছেন ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে। আমরা এই হয়রানি থেকে মুক্তি চাই।”

তিনি বলেন, “আপনারা (এনবিআর) অনলাইনে ভ্যাট জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। আমরা যখন অনলাইনে ভ্যাট জমা করছি সার্কিল অফিসাররা তা নিতে চাচ্ছেন না। তারা বলছেন অনলাইন জমার স্লিপ অ্যাটেসটেড করতে হবে। তো সেটা করার জন্য যখন কর্মচারী পাঠাচ্ছি তখন বলছে মালিককে আসতে হবে। মালিক গেলে টাকা চাচ্ছে।”

এ প্রেক্ষিতে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন,“আমি আলোচনার শুরুতে আপনাদেরকে সুশাসনের বিষয়ে বলেছি। আমরা অবশ্যই সুশাসন নিশ্চিত করতে চাই। ব্যবসায়ীদেরকে হয়রানিমুক্তভাবে রাজস্ব প্রদানের সুযোগ করে দিতে চাই। সবক্ষেত্রে ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে। এখানেও সেটা থাকতে পারে। আমরা তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করবো।”

বাংলাদেশ সিকউরিটি সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “দেশে প্রায় ৭০০ সিকিউরিটি সার্ভিস প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এরমধ্যে সর্বোচ্চ ১০০ প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট, ট্যাক্স নিবন্ধন আছে। বাকিদের নেই। সরকার যখন রাজস্ব আদায় বাড়ানোর জন্য বলে তখন এনবিআর এই নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানগুলোকেই ধরে। কিন্তু যাদের ভ্যাট, ট্যাক্স নিবন্ধন নেই তাদের কাছে যায় না।”

“এতে আমরা ব্যবসা করতে পারছি না। কারণ আমি যখন কোন ভবন বা প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তাকর্মী দেই, তখন ভবন বা ওই প্রতিষ্ঠানের মালিককে বলি ভ্যাট দিতে হবে। সে তখন আমাদের থেকে কর্মী নিতে চায় না। কারণ আমাকে বেতন দিতে হবে অন্যদের (যাদের ভ্যাট নেই) তুলনায় ২০০ টাকা বেশি। তাহলে আমরা ব্যবসা করবো কীভাবে।”

“আপনারা সবাইকে ভ্যাটের আওতায় নিয়ে আসেন। তাতে আমাদের ব্যবসার যেমন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হবে, তেমনি সরকারের রাজস্ব বাড়বে।”

একই অভিযোগ করেন বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির চেয়ারম্যান শহীদ সেরনিয়াবাত।

তিনি বলেন, “দেশে সাত হাজার মুদ্রণ শিল্প প্রতিষ্ঠান আছে। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ দেড় থেকে দুই হাজার প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট নিবন্ধন আছে। অন্যদের ভ্যাট নিবন্ধন নেই।”

“তবে তারা যে একেবারেই ভ্যাট দেয় না তা ঠিক না, তারা যেভাবে দেয় সেটা সরকারের কোষাগারে আসে না। আমরা যারা সরকারের বিধি বিধান মেনে ব্যবসা করছি তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছি। আমাদের দাবি সকলকে ভ্যাটের আওতায় নিয়ে আসেন।”

এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান এসব বিষয়ে ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করে বলেন, “আপনারা ভালো কিছু তথ্য দিয়েছেন। আমি নিজেও সিকউরিটি সার্ভিস নিয়ে কিউরিসিয়াস। আমি যার পেছনে লাগি তার একটা ভালো ফলাফল নিয়ে ছাড়ি। এবারের প্রাক-বাজেট আলোচনা সভা আগের মত নয়। শুধু শুনলাম-বললাম এমন হবে না। এই আলোচনা থেকে আপনাদের (ব্যবসায়ীদের)-সরকারের উভয়ের যাতে উপকার হয় সেই ব্যবস্থা আমরা করবো।”  

ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি আকবর উদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমরা ভ্যাট আইন যাতে ব্যবসাবান্ধব চাই। ভ্যাট দিতে আমাদের অসুবিধা নেই। কিন্তু সেটা হতে হবে আমাদের খাতগুলোর সাথে সমন্বিত।”

তিনি ভ্যাট বর্তমানের তুলনায় কমিয়ে অর্ধেক করার দাবি জানান। বর্তমানে ট্যুর অপারেটরদের আয়ের ১৫ শতাংশ ও ৭ শতাংশ ভ্যাট নির্ধারণ করা আছে।

সুপার মার্কেট অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি জাকির হোসেন বলেন, সুপার মার্কেটও অন্যান্য দোকানের একটি দোকান। বাইরের একটি দোকানে ইউনিলিভারের একটি পণ্য বিক্রি হচ্ছে, তাতে অতিরিক্ত ভ্যাট নেই অথচ সুপার মার্কেটে সেখানে ২ শতাংশ ভ্যাট দিতে হচ্ছে। সবক্ষেত্রে এক আইন হওয়া উচিত।”

হোটেল মালিক সমিতির চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন বলেন, “একটি ৫ তারকা হোটেল ও সাধারণ হোটেলে সমমানের ভ্যাট দিতে হয়। ছোট হোটেল ও রিসোর্টগুলোর গ্রাহক হয় সাধারণ মানুষ। এখানে লাভ করা কঠিন। করের স্ল্যাবটি একই রকম হওয়ায় লোকসান দেওয়ার শঙ্কায় অনেকেই কর দেন না। তাই প্রতিষ্ঠান হিসেবে করের স্ল্যাব পুনর্বিন্যাস করে এর হার কমালে সবাই করের আওতাভুক্ত হবে।”

বজলুর রহীম পশু খাদ্য আমদানিতে কর অব্যহতির সুপারিশ করেন।

ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজের চেয়ারম্যান এম কে বাশার স্কুল ভবনের ভাড়ার ওপর ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবি জানান।

অন্যদিকে এফবিসিসিআই পরিচালক আব্দুল হক শুল্ক হার কমানোর উপর জোর দেন।

এফবিসিসিআইয়ের উপদেষ্টা ও বাজেট প্রণয়ন কমিটির সদস্য মঞ্জুর আহমেদ বলেন, “দেশে বর্তমানে ১৫ শতাংশ ভ্যাট নির্ধারণ করা রয়েছে। সব ব্যবসায়ী ও শিল্পের পক্ষে এ ভ্যাট দেওয়া সম্ভব নয়। ট্যুরিজম, সিকিউরিটি সার্ভিস, মানি এক্সচেঞ্জ, ছোট হোটেল-রেস্তোরাঁ, কুরিয়ার সার্ভিসসহ কম লাভজনক ব্যবসা ও শিল্প এ হারে ভ্যাট দিলে ব্যবসার অগ্রগতির পরিবর্তে বন্ধ হয়ে যাবে। তাই এসব শিল্পের ক্ষেত্রে ভ্যাট সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসতে হবে।”

এনবিআরের সদস্য (শুল্কনীতি) ফরিদ উদ্দিন উচ্চ শুল্ক হারের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, “আমাদের সমস্ত অর্থনীতির কথা বিবেচনায় রেখে নীতি গ্রহণ করতে হয়, শুল্কের হারটা একটু বেশি আমরা এটা কমিয়ে আনতে পারতাম যদি সবাই শুল্ক দিত।”