এক কিলো যেতে ২১ মাস!

সচিবালয় থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরত্বে কেন্দ্রীয়সহ সরকারি পাঁচ ব্যাংকে আয়কর সংক্রান্ত নির্দেশনা পৌঁছুতে সময় গেল একুশ মাস। আর তাতে আগের নিয়মে ব্যাংকের তহবিল থেকে কর্মকর্তাদের আয়কর পরিশোধ করায় ৪৩ কোটি টাকা গচ্চা গেছে সরকারের।

শেখ আবদুল্লাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 March 2015, 04:57 PM
Updated : 11 March 2015, 04:57 PM

ওই নির্দেশনায় ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে ব্যাংক কর্মকর্তাদের আয়কর নিজেদেরকেই পরিশোধ করতে বলা হয়েছিল।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগ থেকে এ বিষয়টি উল্লেখ করে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের কাছে চিঠি দেওয়া হয়।

তাতে বলা হয়, “জাতীয় বেতন স্কেল, ২০০৯ (ব্যাংক ও অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠান) এর ২৩ অনুচ্ছেদের সংশোধনী সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনটি ২০১২ সালের ২৭ মে জারি করা হলেও তা মূলতঃ ২০১৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি আমাদের হস্তগত হয়।”

“উক্ত সংশোধনীর পূর্বে বেতন স্কেল ২০০৯ এর ২৩ (গ) অনুচ্ছেদে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর পরিশোধযোগ্য আয়কর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পুনঃভরণের নির্দেশনা থাকায় গত দুটি অর্থবছরের (২০১১-১২ ও ২০১২-১৩) আয়কর পূর্বের ন্যায় ব্যাংক কর্তৃক পরিশোধ করা হয়েছে।”

নির্দেশনা ‘যথাসময়ে হস্তগত’ না হওয়ায় আগের নিয়মে আয়কর পরিশোধ করা হয়েছে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।

পাশাপাশি ওই দুই অর্থবছরের পরিশোধিত আয়কর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে আদায়ের ওপর থেকে অব্যাহতিও চাওয়া হয়।

রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কোম্পানিতে রূপান্তর হলেও এখনও রূপালী ব্যাংক বাদে বাকি তিনটির শতভাগ মালিকানা সরকারেরই। আর রূপালী ব্যাংকের ৯০ দশমিক ১৯ শতাংশ মালিক সরকার।

তাই ব্যাংকগুলোর তহবিল থেকে অর্থের অপচয় মানেই সরকারি ‘অর্থের অপচয়’ হিসেবে ধরে নেওয়া যায় বলে মনে করছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগ-২ এর মহাব্যবস্থাপক মো. আজিজুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রজ্ঞাপনের কপি সময়মত হস্তগত না হওয়ায় ২০১১-২০১২ এবং ২০১২-২০১৩ অর্থবছরের আয়কর আগের নিয়ম মেনে ব্যাংকের তহবিল থেকে পরিশোধ করা হয়েছে।

ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গত দুই অর্থবছরের আয়কর বাবদ তহবিল থেকে পরিশোধিত অর্থ এখন তাদের কাছ থেকে আদায় করতে হলে প্রশাসনিক ঝামেলার সম্মুখীন হতে হবে বলও মনে করেন তিনি।

কারণ হিসেবে এই কর্মকর্তা বলেন, “ইতোমধ্যে পদত্যাগ, চূড়ান্ত অবসর ও মৃত্যুজনিত কারণে এর উল্লেখযোগ্য অংশ আদায় করা সম্ভব হবে না। তাছাড়া, যারা কর্মরত আছেন, তাদের বর্তমান সীমিত আয় হতে আগের দুটি অর্থবছরের আয়কর আদায় করা হলে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।”

এসব বিবেচনায় ওই দুই অর্থবছরের আয়কর থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যয় ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রধান কার্যালয়সহ ব্যাংকটির অন্যান্য শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মূল বেতনের ওপর আয়করের পরিমাণ ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকা। আর অন্যান্য ভাতাসহ আয়কর হিসাব করলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় বছরে প্রায় চার কোটি টাকা।

এ হিসাবে দুই অর্থবছরে আট কোটি টাকা ব্যাংকের তহবিল থেকে আয়কর দেওয়া হয়েছে।

রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে অগ্রণী ব্যাংক নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আয়কর বাবদ ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে ২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা এবং চলতি অর্থবছরের জন্য ২ কোটি ৭৩ লাখ টাকা জমা দিয়েছে।

অন্য তিনটি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকও প্রতি অর্থবছরে প্রায় তিন কোটি টাকা করে এখাতে জমা দিয়েছে।

এই হিসাবে তিন অর্থবছরে চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষে ব্যাংকগুলো প্রায় ৩৫ কোটি টাকার মতো রাজস্ব দিয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদের কাছে, যিনি অর্থমন্ত্রণালয় ও রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে নিবিড় সম্পর্কের গুরুত্ব তুলে ধরে ‘তোপখানা থেকে মতিঝিল’ নামে বই লিখেছেন ।

তিনি বলেন, “আর্থিক সংশ্লেষ রয়েছে, সরকারের এমন যেকোন সিদ্ধান্ত তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হয়। সরকারের একটি প্রজ্ঞাপন দেরিতে পাওয়ার কারণ দেখিয়ে ব্যাংকগুলো যেটা করেছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। অন্যদিকে অর্থমন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্পর্ক হতে হয় খুবই গভীর ও নিবিড়।

মন্ত্রণালয়ের নেওয়া যেকোনো সিদ্ধান্ত ব্যাংকগুলো দ্রুততার সঙ্গে কার্যকর করবে- এমনটি হওয়া উচিত বলেই মনে করেন আবদুল মজিদ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যম সারির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করি। সরকারি সিদ্ধান্ত মানবো এই শর্ত মেনেই এখানে এসেছি। কর্তৃপক্ষ কি বিবেচনায় এ ধরনের চিঠি দিয়েছে তা জানি না।”

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, সুযোগ-সুবিধার প্রজ্ঞাপন দ্রুত পৌঁছে যায় বা পৌঁছানোর আগেই বাস্তবায়ন শুরু হয়। দেশের কোন প্রতিষ্ঠানই বলতে পারবে না বেতন স্কেলের প্রজ্ঞাপন না পাওয়ার কারণে তারা আগের স্কেলে বেতন দিচ্ছে। কিন্তু আয়করের প্রজ্ঞাপন সময়মত পাবে না এটা কেন হবে!