‘পুড়ছে কৃষকের হাত’

প্রায় দেড় মাস ধরে বিএনপি জোটের টানা অবরোধ ও হরতালে কৃষিপণ্য পরিবহন বিঘ্নিত হওয়ায় গ্রামীণ অর্থনীতি বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন একজন কৃষি অর্থনীতিবিদ।   

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Feb 2015, 04:27 AM
Updated : 16 Feb 2015, 12:52 PM

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) প্রফেসরিয়াল ফেলো এম আসাদুজ্জামান বলছেন, সহিংসতা ও নাশকতার রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে গ্রামের কৃষকেরই।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দেশের কৃষি অর্থনীতিতে অস্থির রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রভাব বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন, টানা অবরোধ-হরতালে নাশকতার আশঙ্কায় পরিবহন সংকটের কারণে কৃষিপণ্য গ্রাম থেকে রাজধানী বা জেলা শহরে পাঠাতে না পেরে কৃষকরা পথে বসছেন। অনেকের উৎপাদিত কৃষিপণ্য ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে। কেউ আবার পানির দরে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।

“আমার বিবেচনায় চলমান সহিংস রাজনীতিতে কৃষকের হাত পুড়ে গেছে। এখন যদি সেই পোড়া হাত সেবা-শুশ্রূষা দিয়ে ভালো করা না হয় তাহলে সে ধুঁকে ধুঁকে মরে যাবে। আর কৃষি-কাজ করতে পারবে না। এতে করে সে নিজেও মরবে, আমাদেরও মরতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে।”

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: হরতাল-অবরোধ কৃষি খাতের পরিস্থিতি সম্পর্কে বলুন।

এম আসাদুজ্জামান: গ্রামীণ তথা কৃষি অর্থনীতিতে দুই ধরনের প্রভাব পড়ছে। প্রথমত, অবরোধ-হরতালে নাশকতার আশঙ্কায় পরিবহন সংকটের কারণে উত্তর-দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সবজি সরবরাহ ব্যাপকভাবে কমে গেছে। এ কারণে চাষিরা কম দামে সবজি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। কেউ কেউ আবার সবজি তুলছেনই না; খেতেই নষ্ট হচ্ছে। এতে লাভ তো দূরের কথা উৎপাদন খরচও উঠছে না। এটাকেই আমি বলছি কৃষকের হাত পুড়ে যাওয়া।

আর দ্বিতীয় প্রভাব হচ্ছে- এই যে হাত পুড়ে যাওয়া..এ কারণে, অর্থাৎ আর্থিক দিক দিয়ে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখিন হওয়ায় দেড়-দুই মাস পর যে বোরো চাষ শুরু হবে- তা করতে পারবে না। ফলে গত কয়েক বছর ধরে বাড়তে থাকা বোরো উৎপাদন ব্যাহত হবে। আর বোরো চাষে ভাল না হলে পরবর্তীতে সবজি চাষেও মনোযোগ দেবে না কৃষক। এভাবে দীর্ঘমেয়াদে আমাদের কৃষি খাতের ক্ষতি হবে।

এ ক্ষতি মোকাবিলায় কী করা উচিৎ বলে আপনি মনে করেন?

দেশে কীভাবে শান্তি-স্বস্তি ফিরিয়ে আনা যায়-সেটি তো একটি মূখ্য বিষয়। তার পাশাপাশি সরকারকে আরেকটি বিষয় জরুরিভিত্তিতে করতে হবে। এই যে কৃষকের হাত পুড়ল- তা সেবা-শুশ্রূষা দিয়ে দ্রুত সারিয়ে তুলতে হবে। সার-তেল-বীজ– আর্থিক বা ঋণ নানা দিক দিয়ে সহায়তা করতে হবে, যেন তারা ক্ষতি পুষিয়ে নিয়ে নতুন করে পরের ফলন ফলাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন।

হরতাল-অবরোধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি কোন খাতে হয়েছে?

সব খাতেই কম-বেশি ক্ষতি হয়েছে। তবে আমাদের প্রধান খাদ্যপণ্য ধান চাষে তেমন ক্ষতি হয়নি। সহিংসতা শুরুর আগেই আমন ঘরে উঠেছিল। আর বোরো চাষ শুরু হবে দেড়-দুই মাস পর। এ কারণে ধান চাষীরা এই ক্ষতি থেকে বেঁচে গেছেন বলা যায়। তবে পরিবহন সংকটের কারণে বাজারে চালের দাম যেটা সামান্য বেড়েছে সে লাভ কিন্তু ব্যবসায়ীদের পকেটেই যাচ্ছে। কেননা কৃষক তার ধান আগেই বিক্রি করে দিয়েছিল।

এই সময়ে শীতের সবজি, ফুল আর ফল চাষীদেরই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। পোল্ট্রি ও মৎস্য শিল্পেরও ক্ষতি হয়েছে। এই যে পহেলা ফাল্গুন ও ভ্যালেন্টাইনস ডে চলে গেল… যশোরের ফুল চাষীরা তাদের ফুলের দাম পেলেন না।

সামগ্রিক অর্থনীতিতে এর কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে?

আমাদের অর্থনীতিতে কৃষি খাতের অবদান ৬০ শতাংশের মতো। সেটা যদি কমে ৫৪-৫৫ ভাগে নেমে আসে তাহলে গত অর্থবছরে ৬ দশমিক ১২ শতাংশ যে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল সেটা এবার নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে গত কয়েক বছর ধরে ৬ শতাংশের উপরে যে প্রবৃদ্ধি হচ্ছিল সেটাও এবার হোঁচট খেতে পারে। অর্থনীতির অন্যান্য খাতের ক্ষতিতো আছেই। তার সঙ্গে কৃষি খাতের ক্ষতি যোগ হলে পরিমাণ বিশাল অংকে গিয়ে দাঁড়াবে।

 

গত কয়েক দিনে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া চলছে। পণ্য পরিবহনও বেড়েছে। সংকট কেটে যাচ্ছে বলে মনে করেন?

হ্যাঁ, অবস্থা ভালোর দিকেই যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। তবে মানুষের মধ্যে ভয়-আতঙ্ক কিন্তু কাটেনি। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই তারা রাস্তায় বের হচ্ছে, কাজ করছে। ৫ জানুয়ারির পর অবরোধ শুরু হলে প্রথম ৭দিন সবজিবাহী ট্রাক চলাচল একেবারেই কমে গিয়েছিল। মহাসড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যবস্থা নেওয়ার পর সবজিবাহী ট্রাক চলাচল বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা কম দামে সবজি কিনলেও ট্রাক ভাড়া অনেক বেশি। তাই তাদেরও খুব লাভ থাকছে না; সঙ্গে থাকছে জীবনের ঝুঁকি।

কৃষি খাতের যে ক্ষতি হয়েছে তা কীভাবে কাটিয়ে সম্ভব বলে আপনি মনে করেন?

আমি আগেই বলেছি, যে ক্ষতি হয়েছে সেটা পূরণ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তবে আর যাতে ক্ষতি না হয় সেজন্য সরকারকে কৃষি খাতের জন্য পুনর্বাসন কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। বন্যা বা অন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর সরকার কৃষকদের জন্য নানাভাবে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়; এক্ষেত্রেও তেমন করতে হবে।

সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগের এখন থেকেই এ বিষয়ে কাজ শুরু করা উচিৎ বলে আমি মনে করি।