বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে

গত এক বছরে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকায় আমদানি বেড়েছে, সেই সঙ্গে বেড়েছে বাণিজ্য ঘাটতি।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Dec 2014, 04:12 AM
Updated : 17 Dec 2014, 04:12 AM

চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) পণ্য বাণিজ্যে সামগ্রিক ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩৭২ কোটি ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।

ঘাটতি বাড়লেও আমদানি বৃদ্ধির প্রবণতাকে ‘এই মুহূর্তে’ ইতিবাচক বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান বলেন, “আমদানি বাড়ার অর্থই হচ্ছে দেশে বিনিয়োগ বাড়ছে। শিল্পায়নে তথা সার্বিক অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের লেনদেন ভারসাম্য সারণীর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে, অর্থাৎ জুলাই-অক্টোবর সময়ে এক হাজার ৩২৫ কোটি ১০ লাখ (১৩ দশমিক ২৫ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ১৫ শতাংশ বেশি।

অন্যদিকে চার মাসে বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি থেকে বাংলাদেশ মোট ৯৫৩ কোটি ৩০ লাখ  (৯ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে, যা ২০১৩-১৪ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ের চেয়ে ১ শতাংশ কম।

এ হিসাবে চার মাসে পণ্য বাণিজ্যে সামগ্রিক ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩৭২ কোটি  (৩ দশমিক ৭২ বিলিয়ন) ডলার।

গত অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১৯৩ কোটি ২০ লাখ ( ১ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন) ডলার।

২০১২-১৩ অর্থবছরের পুরো সময়ে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৭০১ কোটি ডলার। তার আগের অর্থবছরে ঘাটতি ছিল রেকর্ড ৯৩২ কোটি ডলার।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি হওয়ায় বাংলাদেশে বরাবরই পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতি ছিল।

২০০৫-০৬ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ২৮৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার, পরের অর্থবছরে তা বেড়ে ৩৪৫ কোটি ৮০ লাখ ডলারে পৌঁছায়।

বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কারণে খাদ্য পণ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় ২০০৭-০৮ অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে ৫৩৩ কোটি ডলার হয়।

তবে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে তা ৪৭১ কোটি ডলারে নেমে আসে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ঘাটতির পরিমাণ আবার বেড়ে ৫১৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার হয়।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে গত বছর আমদানি ছিল কম। গত এক বছরে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসায় ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্যে  স্বস্তি ফিরে এসেছে।  এ কারণেই আমদানি ব্যয় বেড়েছে। আর স্বাভাবিকভাবেই বেড়েছে বাণিজ্য ঘাটতি।”

তবে এতে ‘চিন্তার কিছু নেই’ মন্তব্য করে অর্থনীতির এই গবেষক বলেন, “পর্যাপ্ত রিজার্ভ আছে। আমি মনে করি, আমদানি বাড়লে অর্থনীতির জন্য তা মঙ্গলজনকই হবে।”

তবে মূলধনী যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য পণ্য আমদানির আড়ালে বিদেশে অর্থ পাচার ঠেকাতে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত।

“অনেক সময় দেখা যায়, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানির কন্টেইনারে অন্য পণ্য বা খালি কন্টেইনার ধরা পড়ে।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমানের মতে দেশে বিনিয়োগ বাড়ানোই এখন ‘প্রধান কাজ’।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন,  “আমদানি বাড়ায় হয়তো আমাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্ট নেগেটিভ হবে। তাতেও সমস্যা নেই, কেননা ২২ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ আছে।”

বিদেশি মুদ্রার এই মজুদ দিয়ে প্রায় সাত মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব বলে জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রধান।

তিনি বলেন, “ইতোমধ্যে বিনিয়োগে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ক্যাপিটাল মেশিনারিজ, শিল্পের কাঁচামালসহ শিল্প খাতের প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি বাড়ছে। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহও বেড়েছে। সব মিলিয়ে দেশে এখন বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ ফিরে এসেছে।”

ঘাটতি বেড়েছে সেবা খাতেও

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, জুলাই-অক্টোবর সময়ে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতিও বেড়ে ১৭৩ কোটি ৭০ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে। গত বছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল ১১১ কোটি ১৫ লাখ ডলার।

মূলত বিমা, ভ্রমণ ইত্যাদি খাতের পরিস্থিতি বিবেচনা করে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি পরিমাপ করা হয়।

জুলাই-অক্টোবর সময়ে দেশে ৪৬ কোটি ৮০ লাখ ডলারের প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল ৪৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার।

এ হিসাবে এই চার মাসে দেশে এফডিআই বেড়েছে ৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ।

পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ (পোর্টফোলিও বিনিয়োগ) এসেছে ২৯ কোটি ডলারের। গত অর্থবছরে একই সময়ে এসেছিল এসেছিল ১৮ কোটি ৯০ লাখ ডলার।

চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ‘হোঁচট’

আমদানি বাড়ায় বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (ব্যালান্স অফ পেমেন্ট) হোঁচট খেয়েছে দেশের অর্থনীতি।

টানা আড়াই বছর বড় ধরনের উদ্বৃত্ত থাকার পর এখন তা উল্টো পথে (নেগেটিভ-ঋণাত্মক) হাঁটতে শুরু করেছে।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে উদ্বৃত্তের পরিমাণ ছিল ৭৯ কোটি ৩০ লাখ ডলার। আর চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে ঘাটতি রয়েছে ১২৬ কোটি ১০ লাখ ডলার।

নিয়মিত আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য আয়-ব্যয় চলতি হিসাবের অন্তর্ভুক্ত। এই হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হল, নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়।

২০১৩-১৪ অর্থবছরের পুরো সময়ে (১২ মাসে) লেনদেন ভারসাম্যে উদ্বৃত্তের পরিমাণ ছিল ১৫৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার। তার আগের অর্থবছর উদ্বৃত্ত ছিল ২৫২ কোটি ৫২ লাখ ডলার।