বৈষম্য ‘স্থিতিশীল’ বাংলাদেশে

বৈষম্য পরিস্থিতিতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ তুলনামূলক ভালো অবস্থানে রয়েছে বলে বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Dec 2014, 05:49 PM
Updated : 9 Dec 2014, 10:51 AM

সংস্থাটি বলেছে, বৈষম্যের দিক থেকে এই অঞ্চলের আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। এর আগে রয়েছে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান। আর পেছনে রয়েছে নেপাল, ভারত, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ ও ভুটান।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মানুষের মধ্যে আয় বা ব্যয় বিতরণের তুলনামূলক হিসাব একটি সূচক তৈরি করে ‘অ্যাড্রেসিং ইনইক্যুয়ালিটি ইন সাউথ এশিয়া’ শীর্ষক প্রতিবেদনে তা তুলে ধরা হয়েছে।

গিনি কোএফিশিয়েন্টস বা গিনি ইনডেক্স হিসেবে পরিচিত বিশ্ব ব্যাংকের এই সূচকে ০ থেকে ১০০ পর্যন্ত মাত্রা ধরা হয়। কোনো দেশ বা অঞ্চলের অবস্থান শূন্য হলে তাকে চূড়ান্ত সমতা এবং ১০০ হলে চূড়ান্ত বৈষম্য পরিস্থিতি ধরা হয়।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, বৈষম্য সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান প্রায় দশমিক ৩১। সূচকে অষ্টম অবস্থানে রয়েছে আফগানিস্তান, এর সূচক প্রায় দশমিক ২৫। আর সূচকের শীর্ষে রয়েছে ভুটান, দেশটির অবস্থান প্রায় দশমিক ৩৬। এ সূচকে ভারতের অবস্থান প্রায় দশমিক ৩২।

সোমবার রাজধানীর শেরে বাংলা নগরে এনইসি সম্মেলন কক্ষে বিশ্ব ব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রধান অথর্নীতিবিদ মার্টিন রামা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আফগানিস্তানের ৪০ ভাগ প্রান্তিক দরিদ্র জনগোষ্ঠী দেশটির মোট সম্পদের ২৩ ভাগের মালিক। পাকিস্তানে এ হার ২২ ভাগ। আর বাংলাদেশে এই হার প্রায় ২১ ভাগ। এর পরেই রয়েছে ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে দরিদ্র ৪০ ভাগ মানুষের হাতে যে পরিমাণ সম্পদ আছে তা তুলনামূলকভাবে সন্তোষজনক। এছাড়া এই অঞ্চলের দেশগুলোতে শ্রম গতিশীলতাও মোটামুটি সন্তোষজনক।

প্রতিবেদনে বলা হয়, “তবে আয়ের ক্ষেত্রে অসমতার হার সবদেশে একরকমভাবে হ্রাস বা বৃদ্ধি পাচ্ছে না। মালদ্বীপ ও ভুটানে বর্তমানে অসমতা বৃদ্ধির হার নিম্নমুখী। বাংলাদেশে তা স্থিতিশীল রয়েছে। ভারতসহ অন্য দেশগুলোতে এ হার বিভিন্ন মাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছে।”

বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য ও প্রাথমিক শিক্ষা খাতে বাংলাদেশ বিনিয়োগ বাড়ছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। এসব খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে সাধারণ নাগরিকদের সুবিধা বাড়াতে হবে। এতে বৈষম্য কমবে।

“পৃথিবীর অন্য অঞ্চলগুলোর তুলনায় বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে মোট দেশজ উৎপাদন-জিডিপি  ও রাজস্ব  অনুপাত (ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও) সবচেয়ে কম। এটি এই দেশগুলোর জন্য অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ।”

এই দেশগুলোর খাদ্য জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতে দেওয়া ভর্তুকির বিষয়ে কাঠামোগত সংস্কার করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।

বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি দেশের বিলিওনিয়ারদের (এক বিলিয়নের বেশি সম্পদ আছে যাদের) সম্পদ সম্পর্কে  বলা হয়েছে, ভারতে ৫ হাজারের বেশি বিলিওনিয়ার রয়েছে। তাদের সম্পদের পরিমাণ জিডিপির প্রায় ১২ শতাংশ। দেশটিতে (ভারত) এ হার ক্রমশ বাড়ছে।

তবে প্রতিবেদনের এ অংশে বাংলাদেশের কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান।

পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য শামসুল আলমের সভাপতিত্বে এতে আলোচনা করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক  অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক বিনায়ক সেন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ।

পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা একটি দলিল, যাতে শুধু আগামী পাঁচ বছরের জন্য নয়, ২০৪১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ কিভাবে এগুবে তার পথ নির্দেশিকা থাকবে।

“দেশের প্রত্যেক মানুষের স্বপ্ন এতে প্রতিফলিত হবে। আমরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে আমাদের বরাদ্দ অব্যাহত রাখব। সেই সাথে এটা নিশ্চিত করব যাতে ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত ১৬ থেকে ১৭ ভাগ হয়।”

বর্তমানে এ হার ১৩ শতাংশ বলে উল্লেখ করেন মন্ত্রী।

“কেউ যাতে ট্যাক্স ফাঁকি দিতে না পারে সেজন্য সমস্ত কার্যক্রম কাগজহীন করা হবে। বর্তমানে আয়কর, কাস্টমস, এলজিইডি, টেন্ডার, ভূমি ইত্যাদি কার্যক্রম অন-লাইনভিত্তিক করা হয়েছে। ভবিষ্যতে সরকারের সমস্ত কার্যক্রমকে অনলাইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।”

এতে করে কারোরই দুর্নীতি করার সুযোগ থাকবে না বলে মনে করেন পরিকল্পনামন্ত্রী।

‘আমাদের দেশেও অসমতা রয়েছে’ উল্লেখ করে মুস্তফা কামাল বলেন, “বাংলাদেশে ১০ ভাগ ধনী লোকের হাতে মোট ৩৫ ভাগ সম্পদ রয়েছে। অপরদিকে ১০ ভাগ গরিব মানুষের কাছে মাত্র ২ ভাগ সম্পদ রয়েছে। এটা কাম্য হতে পারে না।”

আতিউর রহমান বলেন, ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত  বাংলাদেশে ভোগ ও আয় অসমতা দুটোই কমেছে। আয় অসমতার ক্ষেত্রে এর মাত্রা ০.৪৬৭ ভাগ থেকে ০.৪৫৮ ভাগে নেমে এসেছে। অপরদিকে ভোগ অসমতার ক্ষেত্রে এই মাত্রা ০.৩৩২ থেকে ০.৩২১ নেমে এসেছে।

“এ সময়ে মজুরি হার বাস্তবিক অর্থেও বেড়েছে। বিশ্ব ব্যাংক তার এক গবেষণায় দেখিয়েছে, ২০০১ সালে একজন শ্রমিক একদিন কাজ করে যে মজুরি পেত তা দিয়ে ৬ কেজি চাল কেনা যেত। ২০১২ সালে এসে সে যা মজুরি পায় তা দিয়ে ১২ কেজি চাল কেনা যায়,” বলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রধান।

প্রতিবেদনের নিয়ে আলোচনায় মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, দারিদ্র্য বিমোচনই দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নের একটি বড় উপাদান। কেননা এ অঞ্চলে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি গরিব মানুষ বাস করেন। মানুষের মাঝে বৈষম্য কমাতে আর্থিক স্বাস্থ্য শিক্ষাসহ সব মিলিয়ে একটি সমন্বিত উদ্যোগ থাকতে হবে।

বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত খুবই কম উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভোগমূলক ব্যয়ে এখন বেশি কর দিতে হচ্ছে সবাইকে। সেক্ষেত্রে বৈষম্য বাড়ছে কি না সেটা সমীক্ষা করে দেখা যেতে পারে। আর ব্যয়ের দিক থেকে খাদ্যে ভর্তুকি কমছে। আর বিদ্যুৎ-গ্যাসসহ জ্বালানিতে ভর্তুকি বাড়ছে। এটা অবশ্য দিতে হবে।

“কিন্তু কিভাবে অর্থবহভাবে ভর্তুকির কাঠামো পুনর্বিন্যাস করা হবে সেটাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে আমি মনে করি।”

‘যৎসামান্য টাকা দিয়ে সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না’ মন্তব্য করে বিনায়ক সেন বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সুবিধাভোগীদের সারা মাসে যে টাকা দেওয়া হয় তা একজন শ্রমিককের এক থেকে দেড় দিনের মজুরির সমান।

ভূমি ব্যবস্থার সংস্কারের ওপর তাগিদ দেন বিনায়ক সেন।।

এম এম আকাশ বলেন, বিশ্ব ব্যাংকের এই প্রতিবেদন থেকে  দেখা যাচ্ছে, শ্রমবাজারে বৈষম্য তুলনামূলকভাবে কম। তবে এটা অদক্ষ শ্রমের ক্ষেত্রে সত্য।

‘প্রবৃদ্ধি অসমতাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে- এটা মানতে হলে আমাদেরকে বিষয়টিকে গভীরভাবে দেখতে হবে’ উল্লেখ করে আকাশ বলেন, “বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমে দেখা যায়, গরিব মানুষ যা ঋণ নেয় তার প্রায় ১০০ ভাগই ফেরত দেয়। আর ধনীদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫৭ হাজার কোটি টাকা।

“এতথ্যই প্রমাণ করে যে, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারলে একদিকে যেমন জিডিপি বাড়ত; অন্যদিকে বৈষম্য বা অসমতা কমত।”