২০ গ্রহীতার কাছে পুঞ্জিভূত অর্ধেক ঋণ, ঝুঁকিতে রূপালী ব্যাংক

মাত্র ২০ গ্রহীতার কাছে মোট ঋণের প্রায় অর্ধেক বকেয়া রেখে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংক ‘অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ’ অবস্থায় রয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

শেখ আবদুল্লাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Nov 2014, 04:52 AM
Updated : 24 Nov 2014, 08:07 AM

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকটির মোট ঋণ ও অগ্রিমের ৪২ শতাংশই ওইসব ঋণ গ্রহীতার কাছে রয়েছে, যাদের মধ্যে পাঁচ ব্যবসায়ীর কাছে রয়েছে ২২ শতাংশেরও বেশি অর্থ।

রূপালী ব্যাংকের ২০১৩ সালের সামগ্রিক কার্যক্রমের ওপর পরিচালিত বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশদ পরিদর্শন প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

ওই ব্যাংকের ১০টি বড় শাখা সরেজমিনে পরিদর্শন এবং বাকি ৫৮১টি শাখার প্রধান কার্যালয়ের দেওয়া তথ্য নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালের ডিসেম্বর স্থিতিতে রূপালী ব্যাংকের বিতরণ করা ১০ হাজার ৭৪২ কোটি টাকা মোট ঋণ ও অগ্রিমের মধ্যে শীর্ষ ২০ গ্রহীতার কাছে বকেয়া রয়েছে চার হাজার ৫০৭ কোটি ৭৬ লাখ টাকা।

এগুলোর মধ্যে পাঁচটি গ্রুপের কাছে বকেয়ার পরিমাণ দুই হাজার ৩৯৮ কোটি ৯৮ লাখ টাকা, যা ব্যাংকের মোট ঋণের ২২ দশমিক ৩৩ শতাংশ।

প্রতিবেদনে মুষ্টিমেয় এসব ঋণগ্রহীতার কাছে পুঞ্জিভূত বড় অংকের এই ঋণ যাতে খেলাপিতে পরিণত না হয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে সে বিষয়ে সতর্ক করে ঋণ আদায়ের কার্যক্রম জোরদার করতে বলা হয়েছে।

গত বছরের ৩১ ডিসেম্বরের স্থিতি হিসাব অনুযায়ী, একক বা গ্রুপভিত্তিক শীর্ষ এই ২০ ঋণগ্রহিতার কাছ থেকে মাত্র ১০৪ কোটি ১১ লাখ টাকা আদায় হয় বলে প্রতিবেদনে পাওয়া যায়।

এতে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালের ডিসেম্বর শেষে রূপালী ব্যাংকের মোট সম্পদ ২০ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকার মধ্যে ১২ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদে পরিণত হয়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা পর্ষদের অদক্ষতার কারণে অল্প কিছু প্রতিষ্ঠানের হাতে অনেক ঋণ আটকে যাচ্ছে। ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এটি মারাত্মক ত্রুটি। এসব প্রতিষ্ঠান খেলাপি হয়ে আবার ঋণ নেয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ব্যাংক জিম্মি হয়ে পড়ছে।

“ব্যাংকের কাজ ঝুঁকি ছড়িয়ে দেওয়া, কেন্দ্রীভূত না করা। মাত্র ২০ গ্রাহককে ৪২ শতাংশ ঋণ দেওয়া অবশ্যই ঝুঁকিকে কেন্দ্রীভূত করা।”

এদিকে রূপালী ব্যাংকের আর্থিক ঝুঁকি নিরসন ও ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে প্রতিবেদনটির সারসংক্ষেপ অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সচিবকে পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এছাড়া নিজ্স্ব প্রতিবেদনে ঋণ বিতরণ, ঋণ জালিয়াতি ও খেলাপি ঋণের তথ্য সঠিকভাবে উপস্থাপন না করা, হিসাবের গরমিল এবং কর্পোরেট গভর্নেন্সের দুর্বলতা রূপালী ব্যাংকের আর্থিক ঝুঁকি বাড়াচ্ছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে রূপালী ব্যাংকের স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ঋণ খেলাপিদের কাছ থেকে মোট ১৯৪ কোটি টাকা আদায় করার কথা থাকলেও আদায় হয়েছে মাত্র ৭৬ কোটি ৫৬ লাখ টাকা, যাকে ‘এমওইউ এর শর্ত লঙ্ঘন’ বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।

আদায়ের হারকে অত্যন্ত ‘হতাশাজনক’ উল্লেখ করে এর জন্য সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে দক্ষ ও উদ্যোগী কর্মকর্তার অভাবকে দায়ী করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

সাধারণ হিসাবে ২০১৩ সালে রূপালী বাংকের ২০৫ কোটি টাকা মুনাফা দেখানো হলেও ওই বছরে ব্যাংকটির বকেয়া প্রভিশন ঘাটতি ৫৫৫ কোটি ৫৩ লাখ টাকা বাদ দিলে মুনাফার বদলে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৫০ কোটি টাকা।

প্রতিবেদনে রূপালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়, খুলনার শামস্ ভবন করপোরেট শাখা ও চট্টগ্রামের রূপালী সদন করপোরেট শাখায় ঋণ পুনঃতফসিলিকরণে অনিয়মের কথা বলা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা উপক্ষো করে ওই তিন শাখার মোট ১৩ গ্রাহকের ঋণ হিসাবগুলো নির্দিষ্ট পরিমাণ ডাউন পেমেন্ট ছাড়া ৬৪০ কোটি ৬২ লাখ টাকা ঋণকে পুনঃতফসিল করে অশ্রেণিকৃত হিসাবে রূপান্তর করে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা লঙ্ঘন করে খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে আরোপিত অনাদায়ী সুদ বাবদ ২৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা ‘স্থগিত সুদ’ হিসাবে সংরক্ষণ না করে আয় হিসেবে দেখিয়েছে রূপালী ব্যাংক, যার জন্য ব্যাংককে সতর্ক করা হয়েছে।

ব্যাংকটির গভর্নেন্সের অনিয়ম তুলে ধরতে গিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বার্ষিক কার্যপরিকল্পনায় ব্যবসায়িক ও অন্যান্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হলেও তা অর্জনে যথাযথ পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেই।

এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, বছরে একবার ক্রেডিট রিস্ক গাইডলাইনসহ অন্যান্য গাইডলাইনগুলো পর্যালোচনা করার কথা থাকলেও রূপালীর ব্যাংক ২০০৯ সালের পর ২০১৩ সালে গাইডলাইন পর্যালোচনা করেছে।

তবে যে ব্যাংক পরিদর্শন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে তার কর্তৃপক্ষ এসব বিষয়কে তেমন গুরুতর কিছু মনে করছে না।

রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম ফরিদ উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বড় বড় প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েই ব্যবসা করা হয়, এটা স্বাভাবিক। সম্প্রতি ব্যাংকগুলো এসএমই অর্থায়নে যাচ্ছে। এর আগে সব ব্যাংকই গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানে বড় বিনিয়োগ করেছে।”

নিজের সাবেক কর্মস্থল জনতা ব্যাংকের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, “সেখানে দেখেছি কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠানকে দিয়েই ব্যাংকের অধিকাংশ ঋণ চলে যাচ্ছে।

“এছাড়া এটা কোনো সমস্যা না, ব্যবসায় কিছু ঝুঁকি থাকবেই। সেটা নিতেও হবে। আমরা কোনো অনিয়ম করে ঋণ দিইনি বা আমার ব্যাংক থেকে কোনো জালিয়াতি হয়নি,” বলেন এই ব্যাংকার।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ব্যাংকের বিনিয়োগ যাতে পুঞ্জিভূত হয়ে না পড়ে সেজন্য আমরা সিঙ্গেল বরোয়ার এক্সপোজার লিমিট (একক গ্রহীতার ঋণসীমা) চালু করেছি।”

কিন্তু ব্যাংকগুলো এখনও পুঞ্জিভূত হয়ে পড়া অবস্থা থেকে বেরোতে না পারায় আরও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।