গুমাই বিলে শঙ্কার ছায়া

অগ্রহায়ণের হালকা কুয়াশা ঘেরা সকালে ‘চট্টগ্রামের শস্য ভাণ্ডার’ রাঙ্গুনিয়ার গুমাই বিলে কাস্তে হাতে ধান কাটতে নামা কৃষকের মুখে এবার শঙ্কার ছায়া।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরী রাঙ্গুনিয়া গুমাই বিল থেকে ফিরেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Nov 2014, 03:29 AM
Updated : 18 Nov 2014, 08:54 AM

তারা বলছেন, অনাবৃষ্টি, পোকার আক্রমণ ও ব্লাস্ট রোগে চলতি মৌসুমে গতবারের চেয়ে উৎপাদন কমেছে। আর লাভের পরিমাণ কমার আশঙ্কায় কৃষকের মুখে নবান্নের হাসি তাই অনেকটাই ম্লান।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবেও এবার হেক্টর প্রতি ধানের ফলন গতবারের তুলনায় কিছুটা কম।

চট্টগ্রামের অন্যান্য অংশের তুলনায় ‘গুমাই বিলে’ ধান একটু আগেই পাকে। তাই কাটার উৎসবও শুরু হয়েছে সপ্তাহ খানেক আগে।

মধ্য হেমন্তের নীল আকাশের নিচে সোনালী গুমাই বিলে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ছে ফিঙে আর ধান শালিক। কবুতরের আনাগোনাও আছে।

বিলের এমাথা-ওমাথা চলে গেছে কুম্মা খাল। শুকিয়ে আসা খালের পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছে ধানের লোভে আসা হাঁসের দল।

সোমবার উপজেলার কদমতলি, কাটা বটতল, মাঝের বিল, নিশ্চিন্তাপুর সংলগ্ন গুমাই বিলের বিভিন্ন অংশে কথা হয় কৃষক ও ধান কাটা শ্রমিকদের সঙ্গে।

কদমতলি এলাকার কৃষক মোহাম্মদ ইসহাক জানান, এবার বিলের ছয় কানি জমিতে আমনের চাষ করেছেন তিনি। জমি চাষ থেকে শুরু করে ধান কাটা পর্যন্ত কানি প্রতি তার খরচ হয়েছে সাত হাজার টাকা করে। ইসহাকের হিসেবে এবার কানিতে ধান হবে সর্বোচ্চ দশ হাজার টাকার।

“গত মাসে বৃষ্টি হওয়া জরুরি ছিল। কিন্তু হয়নি। ধানের ছড়াও ভেঙে (আগা ভাঙ্গা রোগ) যাচ্ছে। ধান যা দেখছেন ঝারাই এর পর তা পাওয়া যাবে না।”

বিলের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এবার প্রতি কানি জমি চাষে তাদের খরচ পড়েছে গড়ে দুই হাজার টাকা করে। এক কানি জমিতে চারা রোপনে একদিনে চারজন শ্রমিক কাজ করতে হয়। জনপ্রতি পাঁচশ টাকা করে এ বাবদে খরচ হয় দুই হাজার টাকা।

চারা রোপনের পর জমির আগাছা বাছাইয়ের জন্য শ্রমিকদের দিতে হয়েছে পাঁচশ টাকা। সারের জন্য খরচ গেছে গড়ে আরও পাঁচশ।

পাঁচজন শ্রমিক একদিনে এক কানি জমির ধান কাটতে পারে। জনপ্রতি চারশ টাকা ‍হারে তাদের পেছনে খরচ আছে আরও দুই হাজার টাকা।

এর মাঝে কীটনাশক আর শেষ পর্যায়ের সেচের জন্য পাঁচশ টাকা করে খরচ হয়েছে। অন্যান্য খরচ মিলিয়ে এবার চারা লাগানো থেকে ধান গোলায় তোলা পর্যন্ত কানিপ্রতি খরচ দাঁড়াচ্ছে সাড়ে সাত হাজার ‍টাকার মতো।

এই বিলে কাঁটা বটতল এলাকার মো রুবেলের জমি আছে প্রায় আট কানি। তার হিসাবে এবার কানিতে ধান পাওয়া যাবে ১০ থেকে সাড়ে ১২ মণ।

“বাজার দর হিসাবে ১০ মণ ধানের দাম আট হাজার টাকা আর সাড়ে ১২ মণ ধানের ‍দাম এখন দশ হাজার টাকা। এবার ‍আপনিই বলেন, কয় টাকা থাকবে?”

কৃষক মোহাম্মদ হোসেন বলেন, বিলে যাদের নিজের জমি আছে তারা হয়ত খরচ তুলে আনতে পারবেন। কিন্তু বর্গা চাষীদের এবার ‘কিছুই থাকবে না’।

মাঝের বিলে ষষ্ঠ শ্রেণী পড়ুয়া মেয়ে মুন্নী আক্তারকে নিয়ে ধান কাটছিলেন বর্গা চাষী মাহবুবুল ইসলাম।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, এক কানি জমি তিনি বর্গা নিয়েছেন পাঁচ মণ ধানের চুক্তিতে। সাড়ে ১২ মণ ধান না হলে এবার খরচও উঠবে না।

“কামলা খরচ দেওয়ার টাকাও হাতে নেই। তাই নিজেই খাটছি।”

কৃষক মোহাম্মদ হোসেন বলেন, শেষ দিকে বৃষ্টির অভাবের সঙ্গে এবার সাদা পাঞ্জার (সাদা পাইজাম) জমিতে লেদা পোকার আক্রমণ দেখা দিয়েছে। আগা ভাঙার কারণে ধান আরো কম হবে।

কৃষক ও ধান কাটার শ্রমিকরা জানান, এবার বিলের কয়েকটি অংশে সাদা ও লাল পাঞ্জা (পাইজাম) ধানে পোকার আক্রমণ হওয়ায় ফলন কম হয়েছে। তবে বিরি ধানের ফলন গতবারের মতোই ভালো।

ধান কাটার মৌসুমে বাড়তি আয়ের আশায় কক্সবাজার, বাঁশখালী, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, বরগুনা আর বরিশাল থেকে এসেছেন শ্রমিকরা।

বরগুনা থেকে আসা মিলন বিশ্বাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তিন বেলা খাবার আর দিনে সাড়ে তিনশ ‍টাকা বেতনের চুক্তিতে তার কাজ। মাস খানেক কাজ করে আবার বাড়ি ফিরে যাবেন।

তিনি জানালেন, বিলের একেক অংশে ফলনের ধরন এবার একেক রকম। কোথাও ভাল দেখা গেলেও সব জায়গার অবস্থা এক রকম না।

রাঙ্গুনিয়ার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আকতারুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গুমাই বিলের দুই হাজার চারশ হেক্টরসহ এবার উপজেলায় মোট ১৬ হাজার হেক্টর জমিতে আমনের চাষ হয়েছে।

“ঘূর্ণিঝড় হুদহুদের সময় হওয়া বৃষ্টি ফসলের খুব কাজে লেগেছে। সেটা না হলে হয়ত সমস্যা হতো।”

তার দাবি, পোকা এবার তেমন ছিল না। ব্লাস্ট রোগের (ধান গাছের আগা ভাঙ্গা) বিষয়েও তারা কৃষককে আগেই সর্তক করেছেন।

তবে সরকারি হিসেবেও এবার বিলে ধানের ফলন কিছুটা কমছে। 

আকতারুজ্জামান বলেন, এবার হেক্টর প্রতি তিন দশমিক ১৫ মেট্রিক টন থেকে সর্বোচ্চ তিন দশমিক ৩০ মেট্রিক টন পর্যন্ত ধান উৎপাদন হয়েছে।

কৃষি অধিদপ্তরের হিসেবে গত বছর হেক্টর প্রতি ফলন ছিল তিন দশমিক ২৫ মেট্রিক টন থেকে তিন দশমিক ৬০ মেট্রিক টন।