‘সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়নে চাই আলাদা দপ্তর’

অর্থনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যে কোনও পরিকল্পনা প্রণয়ন করার দায়িত্ব এককভাবে কোনও মন্ত্রণালয়ের হাতে দেওয়া উচিত নয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ নূরুল ইসলাম।

প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Nov 2014, 05:42 PM
Updated : 8 Nov 2014, 05:43 PM

বর্তমানে পরিকল্পনা কমিশন থাকলেও কার্যকর সমন্বয়ের কাজটি হচ্ছে না বলে মত প্রকাশ করে এজন্য আলাদা দপ্তর গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের এই ডেপুটি চেয়ারম্যান।

শনিবার বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) এবং বাংলাদেশ ইকনোমিস্ট ফোরাম (বিইএফ) আয়োজিত ‘বাংলাদেশে নীতি নির্ধারণ ও প্রতিষ্ঠানসমুহ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তব্যে এই পরামর্শ দেন তিনি।

বনানীর পিআরআই কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এই আলোচনায় অংশ নিয়ে অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও ব্যাংকাররা যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (আইএফপিআরআই) রিসার্চ ফেলো অধ্যাপক নূরুল ইসলামের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেন।

মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াকে উদারণ হিসেবে তুলে ধরে বাংলাদেশেও উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজটিতে সমন্বয় বাড়াতে পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেন প্রবীণ অর্থনীতিবিদ নূরুল ইসলাম।  

“বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রণীত বিভিন্ন নীতির মধ্যে কার্যকর সমন্বয় খুবই জরুরি । এই নীতিগুলোর মধ্যে সমন্বয় করতে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি ‘সুপার মিনিস্ট্রি’ তৈরি করা যেতে পারে।”

আলাদা মন্ত্রণালয় করা না হলেও নিদেনপক্ষে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি সমন্বিত ইউনিট তৈরি করা যেতে পারে বলে মত দেন তিনি।

এর পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে নূরুল ইসলাম বলেন, অনেক বিষয় আছে যেগুলো বিভিন্ন খাতের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং তার সামষ্টিক অর্থনৈতিক সংশ্লেষ রয়েছে। সে কারণেই পরিকল্পনা প্রণয়ন, মতামত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে বাংলাদেশে পরিকল্পনা কমিশন থাকলেও কার্যকর সমন্বয়ের কাজটি তারা ঠিকমতো করতে পারছে না।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সবার মত নিয়েই যে কোনও পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন এই গবেষক।

“মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় শক্তিশালী পরিকল্পনা প্রণয়ণ ও বাস্তবায়নের ব্যবস্থা রয়েছে। ইন্দোনেশিয়ায় সুহার্তোর আমলে অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়ন বা এ ধরনের নীতি প্রণয়নের জন্য আলাদা মন্ত্রী ছিলেন। তিনি পরিকল্পনা উত্থাপন করতেন। সেই পরিকল্পনা নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ বির্তক করত। এভাবেই ওই দেশে নীতি প্রণয়ণ হত।”

মালয়েশিয়ায়ও মাহাথির মোহাম্মদের শাসনামলে নীতি প্রণয়নের জন্য স্বাধীন ও স্বতন্ত্র সংস্থা ছিল বলে জানান তিনি।

“এছাড়া যারা নীতি প্রনয়ণ করবেন, তাদের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সুযোগ দিতে হবে,” বলেন নূরুল ইসলাম।

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন মূল আলোচক অধ্যাপক নুরুল ইসলামকে প্রশ্ন করেন, “আপনাকে যদি আবার পরিকল্পনা কমিশনে ফিরিয়ে আনা হত, তাহলে কী করতেন? পরিকল্পনা কমিশনে ডেপুটি চেয়ারম্যান থাকাকালে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে কতটা সমন্বয় করেছিলেন?”

ফরাসউদ্দিনের এই প্রশ্নে প্রবীণ এই অর্থনীতিবিদ হেসে ওঠেন। তবে কোনও উত্তর দেননি।

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নীতি কাঠামো প্রণয়নের সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পৃক্ত থাকা নূরুল ইসলাম শুরুর দিকেই বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) চেয়ারম্যান ছিলেন। জাতিসংঘের বিভিন্ন উচ্চ পর্যায়ের কমিটিতেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।

যুক্তরাষ্ট্রের বসবাসরত অধ্যাপক নূরুল ইসলাম মাঝে-মাঝে বাংলাদেশে আসেন। তার এবারের আগমনকে কেন্দ্র করেই পিআরআই এবং বিইএফ এই আলোচনার আয়োজন করে।

যার তথ্যের ওপর ভিত্তি করে পরিকল্পনা সাজানো হবে, সেই পরিসংখ্যান ব্যুরোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার ওপর জোর দেন নূরুল ইসলাম। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিষয়েও একই মত তার।

রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তুলনায় ‘স্বাধীনভাবে’ কাজ করে বলেই তার মূল্যায়ন।

অধ্যাপক নূরুল ইসলামের বক্তব্যের একমত পোষণ করে অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, পরিসংখ্যান এখন মূলধনের মতো। পরিসংখ্যানের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র উঠে আসে, যা বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে খুবই গুরত্বপূর্ণ।

“যে দেশে পরিসংখ্যান বিশ্বাসযোগ্য নয়, সে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য হবে কিভাবে?”

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য-উপাত্তে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের উদাহরণ দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে দায়িত্ব পালন করে আসা এই অর্থনীতিবিদ বলেন, “মন্ত্রীর সই ছাড়া মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করা যায় না। অথচ মন্ত্রীর মূল্যস্ফীতি নির্ণয়ের পদ্ধতি বুঝতেই তিন/চারদিন সময় লেগে যায়।”

বিবিএসের তথ্য-উপাত্ত বিকৃতির উদাহরণ দিয়ে সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমার সময়ে দেখেছি, বিবিএস মূল্যস্ফীতির তথ্য-উপাত্ত দেওয়ার পর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বলেছেন, ‘রাখো তিন দিন, তথ্য-উপাত্ত দেখি’। তবে এখন এমন হয় কি না, জানি না।”

ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা সম্পর্কে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, “সব সরকারের আমলেই কিছু লোককে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় সুবিধা দেওয়া হয়। আমাদের ব্যাংকিং খাতেও কিছু ‘দুষ্টু ছেলে’ আছে।

“সেক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠানকে (নিয়ন্ত্রক সংস্থা) বলা হয়, আমার ‘দুষ্টু ছেলেকে দুষ্টামি’ করার সুযোগ দাও। আর বাকিদের ক্ষেত্রে কঠোর হও। তখন দেখা যায়, ওই প্রতিষ্ঠানই দুষ্টামি শুরু করে দেয়।”

বাংলাদেশে বাস্তবতার সঙ্গে পরিকল্পনার ফারাক পেয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারে দায়িত্ব পালন করে আসা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামও।

“আমাদের যতটুকু অর্জন করা সম্ভব তার চেয়ে বেশি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় রাজনৈতিক কারণে,” বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার উদাহরণ দিয়ে বলেন তিনি।

নীতি নির্ধারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর চাপ থাকে- একথা স্বীকার করে নিয়ে গভর্নর আতিউর রহমান বলেন, পুঁজিবাজারে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক যখন নীতি নির্ধারণ করতে গেল, তখন ‘বাইরের’ অনেক চাপ সামলাতে হয়েছে। নতুন ব্যাংকের লাইসেন্সের সময়ও চাপ সামলাতে হয়েছে।

“কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুরো চাপ সামলাতে পেরেছে, তা নয়। তবে আমরা চেষ্টা করেছি,” বলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রধান।

আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি মহিউদ্দিন আলমগীর, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য শামসুল আলম, সাবেক অর্থসচিব জাকির আহমেদ, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক মোস্তফা কে মুজেরী, গবেষক বিনায়ক সেন, পিআরআই চেয়ারম্যান জাইদী সাত্তার, ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমদ, নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রমুখ।