বাংলাদেশ এগোলেও গতি ধীর: বিশ্ব ব্যাংক

বাংলাদেশের অর্থনীতি এগিয়ে চললেও সম্ভাবনার সবটুকু ব্যবহার করতে এখনও পারছে না বলে মনে করছে বিশ্ব ব্যাংক।

প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Oct 2014, 11:56 AM
Updated : 21 Oct 2014, 02:59 PM

বাংলাদেশের গতিচিত্র নিয়ে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রতিবেদনে এ মূল্যায়নের পাশাপাশি বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনিশ্চয়তার শঙ্কার কথাও জানিয়েছে ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থাটি।

মঙ্গলবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে এই প্রতিবেদনের খুঁটিনাটি তুলে ধরেন বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন, তার সঙ্গে সংস্থার বাংলাদেশ মিশনের প্রধান জোহানসেন জাটও ছিলেন।

দারিদ্র্য বিমোচন এবং মানব উন্নয়নে বাংলাদেশ ভালো করছে বলে বিশ্ব ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ। শ্রমশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধিও ধরা পড়েছে তাদের চোখে।

বিদ্যুৎ ও গ্যাস পরিস্থিতির উন্নতি হলেও যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে অসন্তোষ ঝরেছে বিশ্ব ব্যাংকের কণ্ঠে। বহু বিতর্কের পর নিজেরা সরে এলেও পদ্মা সেতুর কাজ দ্রুত শেষ করার পরামর্শ দিয়েছে তারা।

চলতি অর্থবছরে (২০১৪-১৫) বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ২ শতাংশ অর্জিত হওয়ার আভাস দিয়েছে ঋণদাতা বহুজাতিক সংস্থাটি। তবে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি বাড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে তারা।

সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে জাহিদ হোসেন বলেন, “বাংলাদেশ এগুচ্ছে। তবে সক্ষমতার চেয়ে কম গতিতে।”

“বিদ্যুৎ ও গ্যাসের উন্নতি হয়েছে। কিন্তু সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার কোনও উন্নতি হয়নি। এক বছর আগে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে যে সময় লাগত; এখন তার চেয়ে বেশি সময় লাগে।”

দারিদ্র্য বিমোচনে অগ্রগতি

দারিদ্র্য বিমোচনে অগ্রগতির কথা তুলে ধরে বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি ২০১৪ সালে দারিদ্র্যের হার ২৪ দশমিক ৪৭ শতাংশে নেমে আসবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের ৫৭ শতাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে ছিল। ২০১০ সালে ছিল ৩১ শতাংশ।

জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অনুযায়ী, ২০১৫ সালে তা ২৮ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়।

তবে গত এক দশকের (২০০০ থেকে ২০১০ সাল) তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বিশ্ব ব্যাংক পূর্বাভাস দিচ্ছে, ২০১৪ সালে দারিদ্র্যের হার ২৪ দশমিক ৪৭ শতাংশে নেমে আসবে।

বর্তমানে বাংলাদেশের ২৬ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে জানিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত দুদিন আগেই বলেছেন, ২০২১ সালের মধ্যে এই হার প্রায় অর্ধেকে নেমে আসবে। ২০৩০ সালেই দারিদ্র্যমুক্ত হবে দেশ।

দারিদ্র্য বিমোচনের পাশাপাশি মানবসম্পদ উন্নয়নেও বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা ঝরেছে বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে।

২০১৩ সাল শেষে কর্মসংস্থান বেড়ে ৫ কোটি ৬৫ লাখে দাঁড়িয়েছে বলে সংস্থাটির পরিসংখ্যান বলছে। ২০১০ সালে তা ছিল ৫ কোটি ১৯ লাখ।

“বিদেশে শ্রমশক্তি রপ্তানি বাড়ায় দেশে বেকার সমস্যা সমাধানে অবদান রেখেছে,” বলেন অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন।

প্রবৃদ্ধি ৬.২ শতাংশ

চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা সরকার ধরেছে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। বিশ্ব ব্যাংক এর চেয়ে কম ধরলেও তা-ও সন্তোষজনক মনে করছে তারা।

২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৬ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়। এবার তা ৬ দশমিক ২ শতাংশে উন্নীত হবে বলে বিশ্ব ব্যাংকের পূর্বাভাস।

কৃষি খাতে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ, শিল্প খাতে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ এবং সেবা খাতে ৬ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির আভাস দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বাড়বে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ।

৬ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধিকে ‘সন্তোষজনক’ উল্লেখ করে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থনীতিবিদ বলেন, “বিনিয়োগ বাড়ানো ছাড়া প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশে নিয়ে যাওয়া কোনওভাবেই সম্ভব নয়। ৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধির জন্য বর্তমানের ২৮ শতাংশ বিনিয়োগ (জিডিপির) ৩৪ থেকে ৩৫ শতাংশে নিয়ে যেতে হবে।”

বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির বিষয়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের আভাস আরেকটু বেশি। এডিবি ৬ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের সম্ভাবনা দেখছে।

৭ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার আশার কথাও শুনিয়ে আসছেন অর্থমন্ত্রী মুহিত।

অর্থবছর শেষে গড় মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৪ শতাংশ হবে বলে আভাস দিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়বে। তবে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতি কমতে পারে।”

জাহিদ হোসেন বলেন, “বর্তমানে ২২ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে। এটি খুবই সন্তোষজনক। এই রিজার্ভ দিয়ে ছয় মাসের বেশি আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।”

ঝুঁকি রাজনীতিতেই

এখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল দেখা গেলেও তা টিকে থাকবে কতদিন, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে বিশ্ব ব্যাংকের।  

জাহিদ হোসেন বলেন, “এ কথা ঠিক যে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এসেছে। তবে অনিশ্চয়তা কাটেনি।”

রাজনৈতিক পরিস্থিতির এই অনিশ্চয়তা বিনিয়োগে প্রভাব ফেললে অর্থনীতি ফের নেতিবাচক ধারায় যাবে বলে আশঙ্কা সংস্থাটির। সেক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে, চাপে পড়তে পারে  বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ।

তৈরি পোশাক কারখানার সমস্যা ইউরোপের বাজারে রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করে এই শিল্পের পরিবেশ উন্নত করতে নেওয়া পদক্ষপগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক।

সরকারি ব্যাংকগুলোর দুরবস্থাও আর্থিক খাতকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিতে পারে বলে সরকারকে সতর্ক করেছে সংস্থাটি।

পদ্মা সেতু দ্রুত চাই

নানা তিক্ততার পর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন না করলেও এই সেতুর কাজ দ্রুত শেষ করার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক।

প্রতিবেদনে পদ্মা সেতুসহ অবকাঠামো খাতের চারটি প্রকল্পকে অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে নিয়ে সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়নে জোর দেওয়া হয়েছে।

অন্য তিনটি প্রকল্প হচ্ছে- ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক চার লেইনে উন্নীত করা, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ ডাবল ট্র্যাকে উন্নীত করা এবং বিবিয়ানার গ্যাসভিত্তিক দুটি বড় বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বর্তমানে বাংলাদেশে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে ৬৬০ কোটি ডলারের ৩৬টি প্রকল্পের কাজ চলছে।