রিল্যায়েন্স চেয়ারম্যান মুকেশ আম্বানি ও টাটা সনস এর চেয়ারম্যান সাইরাস মিস্ত্রিসহ ভারতের শীর্ষ শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের পাশে নিয়ে মঙ্গলবার নয়া দিল্লিতে এই প্রচারাভিযানের উদ্বোধন করেন নরেন্দ্র মোদী।
বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক ও বহুজাতিক বিভিন্ন সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন মোদীর এ অনুষ্ঠানে।
বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ভারতের হাইকমিশন ও দূতাবাসের উদ্যোগে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সাংবাদিকদের দাওয়াত দিয়ে এনে সরাসরি সম্প্রচারের মাধ্যমে মোদীর বক্তৃতা দেখানো হয়, জানানো হয় বিনিয়োগের আহ্বান।
ঢাকায় এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় রাজধানীর গুলশানে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারে। নিটল-নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুল মাতলুব আহমেদ, প্রাণ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহসান খান চৌধুরী, ভারত-বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাষ্ট্রিজের সহ-সভাপতি শাফকাত হায়দারসহ ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা এতে উপস্থিত ছিলেন।
দিল্লির অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ‘মেইক ইন ইন্ডিয়া’র লোগো, মেইকইনইন্ডিয়া ডটকম নামের একটি ওয়েব সাইট এবং ভারতের সম্ভাবনাময় ২৫টি খাতের ওপর প্রকাশিত একটি সাময়িকির মোড়ক উন্মোচন করেন।
‘ম্যানুফ্যাকচারিং’ খাতে বিদেশি বিনিয়োগের অবারিত সুযোগ দিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী তার এই ‘স্বপ্ন’ পূরণ করতে চান। এজন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর পাশাপাশি বিশ্বের সব দেশের উদ্যোক্তাদের ভারতে বিনিয়োগের আহ্বান জানান তিনি।
মোদী বলেন, “আমি বিনিয়োগকারীদের এই বিশ্বাস দিতে চাই- আপনাদের টাকা নষ্ট হবে না।”
গত নির্বাচনে চমক দেখিয়ে ক্ষমতায় আসা এই বিজেপি নেতা বলেন, “গত দুই তিন বছরে যার সাথে কথা হয়েছে, সে-ই বলেছে দেশের বাইরে চলে যাবে। ব্যবসা পাল্টাতে হবে। আমি এর সাথে রাজনীতির কোনো যোগ দেখি না। কিন্তু এতে আমার পীড়া হতো। আমার দেশের লোক কেন অন্য দেশে চলে যাবে?
“মানুষ নিজের, দেশের, সরকারের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল।… ব্যবসায়ীদের যেমন কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি আছে, তেমনি সরকারেরও রেসপনসিবিলিটি আছে। সরকারের সবচেয়ে বড় কাজ মানুষকে ভরসা দেয়া, মানুষের মধ্যে বিশ্বাস সৃষ্টি করা। এতোদিন সবাই সবাইকে অবিশ্বাস করেছে। আমরা এটা পাল্টাতে চাই।”
মোদীর ভাষায়, সরকারে থেকে সংসদের চার দেয়ালের মধ্যে বসে কেবল আইন প্রণয়ন করলেই চলবে না, সংসদের বাইরে সাধারণ মানুষের মনও জাগাতে হবে।
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সামনে ভারতের সম্ভাবনাগুলো তুলে ধরে দেশটির প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ভারত একটি বিশাল সুযোগ। এখানে বিশাল বাজার রয়েছে।
এ বিষয়টিকে একটি ‘চক্র’ হিসাবে উল্লেখ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষের কাজের ব্যবস্থা হলে আয় হবে, আয় হলে ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে, তাতে চাহিদা বাড়বে। সব মিলিয়ে বাড়বে উৎপাদন।
“ফলে দেশ এগিয়ে যাবে। এটাই হচ্ছে মেইক ইন ইন্ডিয়া”, বলেন মোদী।
ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের অনুষ্ঠানে মোদীর বক্তৃতার সম্প্রচার শেষে হাই কমিশনার পঙ্কজ শরণ বলেন, “ভারত অগ্রগতির নতুন যে যাত্রা শুরু করেছে তাতে দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশকেই পাশে চায়। বাংলাদেশেরও এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার অথবা এখানকার উদ্যোক্তারা চাইলে ভারতে বিনিয়োগ করতে পারেন।”
তিনি বলেন, বাংলাদেশ চাইলে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ করতে পারে। বিশেষ করে জলবিদ্যুতে। এছাড়া বেসরকারি খাতেও বিনিয়োগের অনেক সুযোগ রয়েছে।
মোদী তার বক্তৃতায় বলেন, শুধু প্রণোদনায় কাজ হবে না। কাজের পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। ব্যবসা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে কেউ লাভ চায় না। বিনিয়োগকারীরা প্রথমে চান নিরাপত্তা।
“বিনিয়োগের জন্য চাই থ্রি ডি। ডেমোক্রেসি, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড ও ডিমান্ড। আমি মনে করি, এগুলো দিতে পারলে বিশ্বকে বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানাতে হবে না, শুধু ঠিকানা দিতে হবে। আমরা সেটা দিতে পারব আশা করি।”
এজন্য সবাইকে এক সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।
আগামী দিনে ভারতের আরো বেশি দক্ষ জনবল দরকার উল্লেখ করে মোদী বলেন, “আমরা ম্যাপিং করছি- কোন খাতে কতো জনবলের চাহিদা আছে। সে অনুযায়ী জনগণকে দক্ষ করে তোলার উদ্যোগও নেয়া হচ্ছে। সরকার, অ্যাকাডেমিশিয়ান, উদ্যোক্তা ও চাকরি প্রার্থীদের মধ্যে কোন সমন্বয় নেই। তাজমহল আগ্রায় আর গাইড বানানো হচ্ছে তামিলনাড়ুতে। সমন্বয়ের এই অভাব দূর করতে হবে। অ্যাকাডেমিশিয়ানদের ভাবতে হবে- কোথায় কোন কাজ করা হবে।”
মানব সম্পদ উন্নয়নে তার সরকার সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ করবে বলে জানান মোদী।
তিনি বলেন, উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন করতে হলে দেশকে ‘ডিজিটাল ভারত’ হিসাবে গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।
“বিশ্ব এগিয়ে চলেছে, দেশের বেসরকারি খাতও এগিয়েছে। অথচ সরকারি খাত তথ্য-প্রযুক্তিতে এসব খাতের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। ইফেক্টিভ গভর্নেন্সের সাথে ইজি গভর্নেন্স দরকার। এজন্য দরকার ডিজিটাল ব্যবস্থা।”
বাণিজ্যের সুখবর দেয়ার পাশাপাশি নিজের কূটনৈতিক দর্শন নিয়েও কথা বলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
মোদী বলেন, ভারতীয় কোম্পানিগুলো কেবল দেশে ব্যবসা করলে হবে না, ভারতীয় পণ্য বিশ্ববাজারেও থাকতে হবে।
“এটা কোনো পলিটিক্যাল এজেন্ডা নয়। এটা আর্টিকেল অব ফেইথ।”
মোদী বলেন, ভারতের মোট জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশের বয়স এখন ৩৫ বছরের মধ্যে, যা একটি বড় শক্তির জায়গা।
অনুষ্ঠানস্থলে সবার বসার ব্যবস্থা না হওয়ায় অনেকে দাঁড়িয়ে মোদীর বক্তব্য শোনেন। এজন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী ক্ষমা চেয়ে বলেন, “আমি ক্ষমা চাইছি, আপনাদের সকলের বসার ব্যবস্থা করতে পারিনি। এর কারণ হলো- আগে এ রকম সভা করার অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। আপনাদের এই উপস্থিতি দেখে আমি বলতে পারি, আপনাদের আর আমার অতিরিক্ত কোনো ভরসা দেয়ার দরকার নেই।”
ভারতের শীর্ষ উদ্যোক্তারা অনুষ্ঠানে বলেন, ‘মেইক ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচি ভারতের প্রগতিকে এক নতুন দুয়ারে নিয়ে যাবে বলে তাদের বিশ্বাস।
তারা বলেন, উৎপাদন খাতের সম্প্রসারণ হলে কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি সামগ্রিক অর্থনীতি শক্তিশালী হবে। তবে এজন্য আইন-কানুন হতে হবে সাধারণ, স্বচ্ছ ও দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য।
ঢাকার মতো চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতেও মোদীর বক্তৃতা সম্প্রচারের ব্যবস্থা করে ভারতের সহকারী হাই কমিশন কার্যালয়।
চট্টগ্রামের একটি হোটেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মোদীর বক্তৃতার পর সহকারী হাই কমিশনার সোমনাথ হালদার দিল্লি-মুম্বাই ইন্ডাস্ট্রিয়াল করিডোরসহ, সাতটি রাজ্যে বিভিন্ন অর্থনৈতিক জোনের সম্ভাবনা এবং বিনিয়োগের সুযোগ নিয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অবহিত করেন।
বিএসআরএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আলী হুসেইন আকবারালী, বিজিএমইএর পরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম চেম্বারের সহ-সভাপতি সৈয়দ জামাল আহমেদ, পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ, পিএইচপির পরিচালক আলী হোসেন, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার চট্টগ্রাম কার্যালয়ের সিইও দেবাশীষ নন্দী, কেডিএস গ্রুপের নিতিন অরোরা, চট্টগ্রাম জুনিয়র চেম্বারসহ বিভিন্ন ব্যবসায়িক গ্রুপের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
রাজশাহীর নাইস হোটেল ইন্টারন্যাশনালে আয়োজিত অনুষ্ঠানেও সহকারী হাই কমিশনার সন্দীপ মিত্র স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সামনে ভারতে বিনিয়োগের সম্ভাবনাগুলো তুলে ধরেন।