ভোজ্যতেলে ‘তেলেসমাতি’

আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম পড়লেও দেশের বাজারে এর প্রভাব পড়ছে না।

শেখ আবদুল্লাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Sept 2014, 09:55 AM
Updated : 21 Sept 2014, 10:52 AM

যদিও ভোজ্যতেল আমদানিকারকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারের দাম কমে যাওয়ার পর এখন পর্যন্ত ভোজ্যতেল আর আমদানি করা হয়নি। ফলে দেশের বাজারেও ভোজ্যতেলের দাম কমেনি।    

অবশ্য ট্যারিফ কমিশনের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, ব্যবসায়ীরা জোটবদ্ধ হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজার অনুযায়ী দাম কমেনি।

কমিশনের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এক বছরের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম কমেছে ৩৭ শতাংশ। আর পাম অয়েলের দাম কমেছে ১৭ শতাংশ।

ব্যবসায়ীরা এই অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম অয়েল আমদানি করে পরিশোধনের মাধ্যমে দেশের বাজারে খোলা ও বোতলজাত করে বিক্রি করেন।

সরকারের বাণিজ্যিক সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসেব অনুযায়ী, অভ্যন্তরীণ বাজারে খোলা সয়াবিনের দাম কমেছে ১৭ শতাংশ, আর বোতলজাত সয়াবিনের দাম কমেছে ৭ শতাংশের কাছাকাছি। এছাড়া পাম অয়েলের দামও ৭ শতাংশ কমেছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “দেশে বছরে ১৪ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। এরমধ্যে আড়াই লাখ টন দেশে উৎপাদন হয়। বাকি ভোজ্যতেল আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমদানি করে চাহিদা মেটানো হয়।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তিন লাখ ৫৭ হাজার টন সয়াবিন তেল আমদানির জন্য ব্যবসায়ীরা এলসি খুলেছেন। এরমধ্যে আমদানি নিষ্পত্তি হয়েছে দুই লাখ ৮৭ হাজার টনের। আর পাম অয়েল আমদানির জন্য ব্যবসায়ীরা এলসি খুলেছেন ১০ লাখ ৯৩ হাজার টনের। এরমধ্যে আমদানি নিষ্পত্তি হয়েছে আট লাখ এক হাজার টনের।

চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-অগাস্ট) ৬৩ হাজার টন সয়াবিন আমদানির এলসি খুলেছেন ব্যবসায়ীরা। এ সময়ে ৩৩ হাজার টন সয়াবিন আমদানি নিষ্পত্তি হয়েছে। এই সময়ে এক লাখ ৩৭ হাজার টন পাম অয়েল আমদানির এলসি খোলা হয়েছে। আর পাম অয়েল আমদানি নিষ্পত্তি হয়েছে এক লাখ ৬৭ হাজার টন।

ভলেন্টারি কনজুমার ট্রেনিং অ্যান্ড অ্যাওয়ারনেস সোসাইটির (ভোক্তা) নির্বাহী পরিচালক খলিলুর রহমান সজল এ বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের দুর্ভাগ্য হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে আমাদের বাজারে আনুপাতিক হারে কমে না। কিন্তু বাড়ার বেলায় বাড়ে। এটা হওয়ার কারণ যারা আমদানি করে তারা সিন্ডিকটে তৈরি করে রাখে।

“দেশে প্রধানত ৪/৫ জন ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এই বাজারে প্রতিযোগিতা নেই। যদি দেশে প্রতিযোগিতা আইন বলবৎ থাকত তাহলে এইভাবে বাজারে কোম্পানিগুলো কাজ করতে পারত না। কিন্তু সরকারের সেইরকম হাতিয়ার নেই। টিসিবি সক্ষম নয়।”

তিনি সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থার জন্য দ্রুত প্রতিযোগিতা আইন কার্যকর করার জন্য আহ্বান জানান।

আন্তর্জাতিক বাজারের হারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম বাড়ার বা কমার কথা। কারণ অপরিশোধিত অবস্থা থেকে পরিশোধিত অবস্থায় পণ্য আনতে যেসব প্রক্রিয়া আছে তাতে খরচে প্রভাব পড়ে।

তাছাড়া ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো বায়ার্স ক্রেডিটের মাধ্যমে বিদেশ থেকে কম সুদে ঋণও পাচ্ছে।

ভোজ্য তেল পরিশোধনকারী ও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এস আলমের মহাব্যবস্থাপক সালাউদ্দিন আহমেদ এবিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,“আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে অভ্যন্তরীণ বাজারের লুজ তেলের দর তুলনা করা যেতে পারে। তাতে দেখা যাবে দেশের কোম্পানিগুলো কম দামে তেল বিক্রি করছে।

“কিন্তু প্যাকিং (বোতলজাত) তেলের দাম তুলনা করলে সমন্বয় হবে না। কারণ প্যাকিং, মার্কেটিং ও পরিবহন খরচ যোগ করে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যায়। দেশে প্রতিদিন প্রায় চার হাজার টন ভোজ্য তেলের চাহিদা রয়েছে। এরমধ্যে ২০ শতাংশ প্যাকিং তেল। বাকি ৮০ শতাংশই লুজ তেল।”

তিনি বলেন, “এখন আন্তর্জাতিক বাজার আর দেশের বাজারে কোন পার্থক্য নেই। ভোজ্যতেলের দেশের বাজার প্রধানত ঢাকার মৌলভীবাজার ও চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ। এখানকার ব্যবসায়ীরা সকালে ঘুম থেকে জেগে শিকাগো ও মালয়েশিয়ার কমোডিটি মার্কেট দেখে নেয়। তা থেকে তারা ধারণা করে আজকের পণ্য কবে দেশে আসবে, কী দাম পড়বে, সবই তাদের হিসেবে থাকে। ফলে আমরা চাইলে বেশি দামে বিক্রি করতে পারি না।”

এস আলম দৈনিক ৪০০ টন ভোজ্যতেল পরিশোধন করে।

দেশে ভোজ্য তেলের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী সিটি গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক বিশ্বজিৎ সাহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দেশের বাজারে তেলের দাম অনেক কমেছে। বর্তমানে পাম অয়েলের দাম প্রতি মণ ২৭০০ টাকা থেকে কমে  ২৪০০ টাকা আর সয়াবিন ৩৩০০ টাকা থেকে কমে ৩০০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতিকেজিতে ৮/৯ দাম টাকা কমেছে।

“কিন্তু দেশের কোম্পানিগুলো আন্তর্জাতিক বাজার থেকে এখনও কম দামে তেল কিনতে পারেনি। কারণ ঈদের সময় আনা দুই থেকে আড়াই লাখ টন মাল এখনও বন্দরে খালাসের অপেক্ষায় আছে। এখানে সিন্ডিকেট বলে কিছু নেই, ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে দাম কমছে, এখন যার কাছে যা আছে বিক্রি করে বের হতে হবে এটাই বিষয়। ব্যাংক লোন আছে, দাম কমলে লোকসান আছে- এসবই আগে।”

সিটি গ্রুপ প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার টন ভোজ্যতেল পরিশোধন করে।

নিজেদের পক্ষে ব্যবসায়ীরা যুক্তি দিলেও সচেতন ভোক্তাদের কেউ কেউ এ বিষয়ে সরকারের প্রতি ক্ষোভ ঝেড়েছেন। তারা বলছেন, সরকারের প্রচ্ছন্ন ‘মদদে’ ব্যবসায়ীরা সাধারণ মানুষকে জিম্মি করার সাহস পায়।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রফিকুল ইসলাম বলেন,“জনগণ ন্যায্য দামে পণ্য পাবে সেরকম ব্যবস্থা করার বিষয়ে সরকারের আগ্রহের অভাব রয়েছে। সরকার নির্বাচনের আগে বলছে পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখবে। ইশতিহার বানাচ্ছে এসব নিয়ে। ক্ষমতায় গিয়ে ব্যবসায়ীদের সাথে আঁতাত করছে। কেউ কেউ সরকারি ছত্রছায়ায় ব্যাংক থেকে টাকা লুটে নিচ্ছে, আবার কেউ কেউ বাজার থেকে টাকা লুটে নিচ্ছে।”

বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, আর্জিন্টিনা থেকে ভোজ্যতেল আমদানি করে থাকে।