কেবল মনিরা নন, ঝুঁকি না থাকায় অনেকেই এখন সঞ্চয়পত্রে পুনর্বিনিয়োগ করছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন এ ধরনের শতাধিক আবেদন জমা পড়ছে। পাশাপাশি বাড়ছে নতুন বিনিয়োগ।
ব্যাংকগুলো আমানতের সুদ কমিয়ে দেয়ায় বেশি লাভের আশায় এবং নিরাপত্তার কথা ভেবে সাধারণ মানুষ তাদের জমানো টাকা সঞ্চয়পত্রে খাটাচ্ছেন বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
জাতীয় সঞ্চয় পরিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মোট ২৪ হাজার ৩০৯ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে ১২ হাজার ৬০২ কোটি টাকা সুদ-আসল বাবদ তুলেছেন বিনিয়োগকারীরা।
এ হিসাবে গত অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের (২০১২-১৩) চেয়ে ১৫ গুণেরও বেশি।
২০১২-১৩ অর্থবছরে পরিবার সঞ্চয়পত্রসহ মোট ২৩ হাজার ৩২৭ কোটি টাকার বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। এর মধ্যে সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসলসহ ২২ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা তুলে নেন বিনিয়োগকারীরা। নিট বিক্রি ছিল ৭৭৩ কোটি টাকা।
এই হিসাবে গত অর্থবছরে আগের বছরের তুলনায় সঞ্চয়পত্র ভাঙানোর পরিমাণ কমেছে ৪৪ দশমিক ১২ শতাংশ।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ হওয়ায় একদিকে যেমন নতুন নতুন বিনিয়োগকারী সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকছে; অন্যদিকে যাদের মেয়াদ পূর্ণ হচ্ছে তারাও আসলটা না তুলে ফের বিনিয়োগ করছেন। এ কারণেই নিট বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়েছে।”
প্রতিদিনই ভিড়
গত সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কার্যালয়ের নিচ তলায় পরিবার সঞ্চয়পত্রের মাসিক মুনাফা নিতে আসা নারীদের লম্বা লাইন দেখা যায়। অনেকে আবার কাউন্টারের সামনে চেয়ারেও বসে ছিলেন।
কাউন্টারে দায়িত্বরত এক কর্মকর্তা জানান, প্রায় প্রতিদিনই এখন এমন ভিড় সামাল দিতে হয় তাদের।
তিনি বলেন, প্রতিদিন গড়ে প্রায় পাঁচ শতাধিক নারী পরিবার সঞ্চয়পত্রের মুনাফা তুলতে আসেন। যাদের সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ পূর্ণ হয়ে গেছে, তাদের অনেকেই আবার পুনর্বিনিয়োগ করেন। এছাড়া এক থেকে দেড়শ মানুষ নতুন সঞ্চয়পত্র কেনেন।
ব্যাংকের চেয়ে মুনাফা বেশি পাওয়া যায় বলেই সঞ্চয়পত্র কিনেছেন বলে জানালেন শাকিলা আকতার নামে আরেক বিনিয়োগকারী।
নারীদের জন্য পরিবার সঞ্চয়পত্র চালু হয় ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ সরকার আমলে। এরপর বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার তা বন্ধ করে দিলেও ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে আবার তা চালু করে। বর্তমানে পরিবার সঞ্চয়পত্রের সুদের হারই সবচেয়ে বেশি, ১৩ শতাংশের মতো।
বিক্রির চালচিত্র
জাতীয় সঞ্চয় পরিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরের শেষ মাস জুনে রেকর্ড এক হাজার ৬৬৬ কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর আগে মে মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ছিল এক হাজার ২৮৮ কোটি টাকা।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছরের প্রায় প্রতি মাসেই সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বেড়েছে। অর্থবছরে প্রথম মাস জুলাইয়ে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৬২৫ কোটি টাকা। অগাস্টে তা বেড়ে হয় ৬৯২ কোটি টাকা।
এরপর জানুয়ারিতে তা বেড়ে এক হাজার ১২৬ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিলে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে এক হাজার ২৬২ কোটি, এক হাজার ২১৫ কোটি এবং এক হাজার ২৭৪ কোটি টাকা।
গত অর্থবছর বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের ৮০ শতাংশই ছিল পরিবার সঞ্চয়পত্র। এছাড়া ১৫ শতাংশ পেনশনার সঞ্চয়পত্র এবং বাকি ৫ শতাংশ অন্যান্য সঞ্চয়পত্র।
ঘাটতি মেটাতে সরকার ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল চার হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। বিক্রি বেশি হওয়ায় সংশোধিত বাজেটে তা প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে আট হাজার কোটি টাকা করা হয়।
এর ধারাবাহিকতায় চলতি বাজেটে (২০১৪-১৫) সঞ্চয়পত্র থেকে নয় হাজার ৫৬ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার।
সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বাড়ায় গত অর্থবছর ব্যাংক থেকে সরকারকে কম ঋণ নিতে হয়েছে জানিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, “মানুষ যেখানে ভালো মুনাফা পাবে সেখানেই বিনিয়োগ করবে। এটাই বিনিয়োগের চরিত্র।
“সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বাড়াতে চলতি বাজেটে আমরা পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত পেনশনার সঞ্চয়পত্রে মুনফার ওপর কর না কাটার ঘোষণা দিয়েছি। নারীর ক্ষমতায়ন বাড়াতে পরিবার সঞ্চয়পত্রকে তো প্রধানমন্ত্রী চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন।”
জাতীয় সঞ্চয় পরিদপ্তরের মাধ্যমে বর্তমানে পরিবার সঞ্চয়পত্র ছাড়াও প্রতিরক্ষা সঞ্চয়পত্র, পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, ছয় মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র ও পেনশনার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়।