বেশি বিদেশি ঋণ ‘ভালো নয়’

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘোষিত নতুন মুদ্রানীতিতে বিদেশি ঋণ উৎসাহিতকে ভালো চোখে দেখছেন না বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 July 2014, 06:35 PM
Updated : 27 July 2014, 10:27 AM

তারা বলছেন, বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যাংকঋণের সুদের হার কমানোর উদ্যোগ না নিয়ে বিদেশি ঋণের অবাধ সুযোগ দিলে ‘হিতে বিপরীত’ হতে পারে।

দেশে বিনিয়োগ বাড়াতে ‘এ উদ্যোগ’ খুব একটা কাজে আসবে বলেও মনে করেন না তারা।

অর্থনীতির গবেষক জায়েদ বখত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিদেশি ঋণ ডলারে পরিশোধ করতে হয়। যখন সুদ-আসলসহ এই ঋণ শোধ করতে হবে তখন সমস্যা হবে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ পড়বে।”

সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, দেশে বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টি না করে বিদেশি উৎস থেকে ঋণগ্রহণ মোটেই ভালো বিষয় নয়।

বিদেশি ঋণকে উৎসাহিত করায় স্থানীয় ঋণ চাপে থাকবে বলে মন্তব্য করেছেন পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেলাল আহমদ চৌধুরী।

শনিবার ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যাতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ। এর মধ্যে ২ দশমিক ৫ শতাংশ আসবে বিদেশি ঋণ থেকে।

প্রথমবারের মতো মুদ্রানীতিতে বিদেশি ঋণকে যুক্ত করে বেসরকারি খাতের ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

অর্থাৎ নতুন মুদ্রানীতিতে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হবে সর্বোচ্চ ১৪ শতাংশ।

গত জানুয়ারি-জুন মেয়াদের মুদ্রানীতিতে বিদেশি ঋণ বাদেই বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল সাড়ে ১৬ শতাংশ, যাতে মে পর্যন্ত অর্জন হয়েছে ১১ দশমিক ৪ শতাংশ। আর বৈদেশিক ঋণ যুক্ত করলে ঋণ প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ। 

মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় বিদেশি ঋণ প্রসঙ্গে গভর্নর আতিউর রহমান বলেন, “সামনে অনেক বড় বড় প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। জাপান, চায়নাসহ অনেক দেশ বিনিয়োগ করবে। এসব প্রকল্পের কাজ শুরু হলে বিনিয়োগ বেড়ে যাবে। তখন বিদেশির পাশাপাশি দেশীয় ঋণও বাড়বে।

“এনিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। অবকাঠামো উন্নয়ন শুরু হলেই আরো বেশি ঋণের প্রয়োজন পড়বে।”

নতুন মুদ্রানীতির বিষয়ে সাবেক গভর্নর  সালেহ উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নতুন এ মুদ্রানীতি গতানুগতিক। নতুন কোনো বিষয় এতে নেই।

সালেহ উদ্দিন আহমেদ

“দেশে বিনিয়োগ নেই বলেই চলে। ব্যাংকগুলো আমানত নেয়া কমিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে বিদেশি উৎস থেকে ঋণগ্রহণ খুব একটা ভাল বিষয় নয়।

“আমাদের ব্যাংকগুলোতে প্রচুর অলস অর্থ (বিনিয়োগ হয় না এমন অর্থ) পড়ে আছে। অনুকূল বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টি করে এই অর্থ বিনিয়োগে নিয়ে আসাই হবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে উত্তম পথ।”

‘আবারও দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে’ মন্তব্য করে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সতর্ক এবং দক্ষতার সঙ্গে পরিকল্পনা প্রণয়নের পরামার্শ দিয়েছেন সালেহউদ্দিন।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখত বলেন, “নতুন মুদ্রানীতিতে বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সে চেষ্টা খুব একটা সফল হবে বলে মনে হয় না।”

এর কারণ ব্যাখা করে তিনি বলেন, “নতুন মুদ্রানীতিতে বিদেশি ঋণ বাড়িয়ে বেসরকারি খাতে ঋণ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যতে এটা সমস্যা হতে পারে। কেননা, এই ঋণ ডলারে শোধ করতে হবে। যখন সুদ-আসলে একসঙ্গে অনেক ঋণ শোধ করতে হবে তখন আমাদের রিজার্ভে চাপ পড়বে।”

প্রচুর খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলো ঋণের সুদের হার কমাতে পারছে না জানিয়ে জায়েদ বখত বলেন, “স্থানীয় ঋণের সুদের হার কম হলে আমাদের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশি ঋণ নেবে না।”

ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যসোসিয়শন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) ভাইস চেয়ারম্যান ও পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেলাল আহমদ চৌধুরী বলেন, “বিদেশি ঋণকে উৎসাহিত করায় স্থানীয় ঋণ চাপে থাকবে।”

স্থানীয় ঋণের সঙ্গে বিদেশি ঋণের একটা সমন্বয় করার পরামর্শ দেন তিনি।

বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ প্রবাহ বেড়েই চলেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত পাঁচ বছরে (২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল) সব মিলে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ এসেছে ৫৫০ কোটি ডলার, স্থানীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪১ কোটি ২৬ লাখ ডলার। ২০১০ সালে ৩০ কোটি ২৭ লাখ; ২০১১ সালে ৯৩ কোটি ৬৩ লাখ ডলার।

২০১২ সালে তা বেড়ে ১৫৮ কোটি ডলারে গিয়ে ঠেকে। ২০১৩ সালে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৫৫ কোটি ৫৩ লাখ ডলার।

কম সুদ হওয়ার কারণেই প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশি ঋণের দিকে ঝুঁকছে। স্থানীয় কোনো ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে গেলে সুদের হার ১৬ থেকে ১৮ শতাংশ পর‌্যন্ত পড়ে যায়। সেখানে বিদেশি কোনো ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে সুদের হার (লাইবর রেটের সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট হার যোগ করে) সর্বোচ্চ ৮ শতাংশের মত পড়ে।

বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি অর্থবছরের জন্য দু’বার মুদ্রানীতি ঘোষণা করে। এর মাধ্যমে পরবর্তী ছয় মাসে অভ্যন্তরীণ ঋণ, মুদ্রা সরবরাহ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ, বৈদেশিক সম্পদ কতটুকু বাড়বে বা কমবে তার একটি প্রক্ষেপণ করা হয়।