ইসলামী ব্যাংকের টাকা নিলে কী সমস্যা: লোটাস কামাল

পদ্মা সেতু নির্মাণে ইসলামী ব্যাংকের কাছে ১ হাজার কোটি টাকা চেয়েছেন জানিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল (লোটাস কামাল) এর পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন, কার্যরত একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে অর্থ চাওয়ায় তিনি কোনো ‘সমস্যা’ দেখছেন না। 

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 April 2014, 01:31 PM
Updated : 29 April 2014, 04:24 PM

সমালোচনা ওঠায় ‘লাখো কণ্ঠে সোনার বাংলায়’ ইসলামী ব্যাংকের অর্থ না নেয়া এবং এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তদন্তের উদ্যোগের মধ্যে মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে একথা বলেন তিনি।

ইসলামী ব্যাংকের অর্থ নিলে নতুন করে বিতর্ক হলেও তা উপেক্ষা করেই বহু প্রতীক্ষিত এই সেতু নির্মাণে এগিয়ে যেতে চান পরিকল্পনামন্ত্রী।

মুস্তফা কামাল বলেন, “ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যানের কাছে আমি পদ্মা সেতুর জন্য ১ হাজার কোটি টাকা চেয়েছি। তিনি আমাকে কথা দিয়েছেন, এই ১ হাজার কোটি টাকা তারা পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগ করবেন।”

বিকালে তার দপ্তরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথা বলার সময় মুস্তফা কামালের কক্ষে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান এবং পরিকল্পনা সচিব ভুঁইয়া সফিকুল ইসলামও ছিলেন।

গণজাগরণ মঞ্চ চিহ্নিত ‘যুদ্ধাপরাধীদের প্রতিষ্ঠান’ ইসলামী ব্যাংকের অর্থ নিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টির সম্ভাবনার বিষয়টি মন্ত্রীর কাছে তুলে ধরা হলে তার জবাবও দেন তিনি।

“বিতর্কের মধ্যেই আমাদের চলতে হবে। সব বিতর্কে কান দিলে দেশের উন্নয়ন হবে না। ইসলামী ব্যাংক দেশে সফলভাবে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে- তাতে কোনো সমস্যা নেই; আর তাদের টাকা পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগ হলে বিতর্ক হবে- এটা আমি মেনে নিতে পারি না।”

গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে লাখো কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গাওয়ার অনুষ্ঠানে ইসলামী ব্যাংক অর্থ দেয়ার পর গণজাগরণ মঞ্চসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠন তার প্রতিবাদ জানায়।

এরপর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, জাতীয় সংগীতের অনুষ্ঠানে ইসলামী ব্যাংকের কোনো অর্থ খরচ করা হচ্ছে না।   

ইসলামী ব্যাংকটির মালিকানা কাঠামোয় জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে বলে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের নেতাদের বক্তব্য।

যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর কাসেম আলী ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান।

ব্যাংকটির বর্তমান চেয়ারম্যান আবু নাসের মোহাম্মদ আব্দুজ জাহের মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম এলাকায় আল বদর বাহিনীর নেতা ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান শাহ আব্দুল হান্নানও জামায়াতে ইসলামীর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। এর সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. সালেহ জামায়াতের সাবেক সংসদ সদস্য সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহেরের ভাই।

দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগে থাকার পর এই প্রথম মন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়া মুস্তফা কামাল বলেন, “ইসলামী ব্যাংক আইডিবির (ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক) সহযোগী প্রতিষ্ঠান। আমরা আমাদের উন্নয়ন প্রকল্পে আইডিবি’র সহায়তা নিচ্ছি; তাতে কোন সমস্যা নেই।

“ইসলামী ব্যাংকের টাকা নিলে সমস্যা হবে কেন,” বিরোধিতাকারীদের উদ্দেশে পাল্টা প্রশ্ন করেন তিনি।

মুস্তফা কামাল বিসিবির সভাপতি থাকাকালে ২০১১ সালে বিশ্বকাপ ক্রিকেট আয়োজনের সময় ঢাকাকে সাজাতে ইসলামী ব্যাংকের অর্থ নেয়া হয়, যা নিয়েও তখন সমালোচনা ওঠেছিল।  

গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তদন্তের মধ্যে সঙ্কটে পড়া ইসলামী ব্যাংককে দেশের বৃহত্তম নির্মাণ প্রকল্পের অংশীদার করা হলে তা ব্যাংকটিকে নিজেদের বড় ধরনের বিজ্ঞাপন হিসেবে প্রচারের সুযোগ এনে দেবে বলে অনেকে মনে করেন।   

২৯০ কোটি ডলারে (২২০০০ কোটি টাকা) ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু নির্মাণে মূল অর্থ জোগানদাতা বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে আইডিবিও ছিল। এই সংস্থাটির দেয়ার কথা ছিল ১৪ কোটি ডলার।

আইডিবির ১৪ কোটি ডলারের সঙ্গে ইসলামী ব্যাংকের ১ হাজার কোটি টাকার কোনো সম্পর্ক আছে কি না- এ প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী বলেন, “না, আইডিবির ওই টাকার সঙ্গে ইসলামী ব্যাংকের এই ১ হাজার টাকার কোনো সম্পর্ক নেই।”

১২০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বিশ্ব ব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তোলায় প্রায় দুই বছর নানা টানাপোড়েনের পর বাংলাদেশ সরকার এই ঋণদাতা সংস্থাটির অর্থ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

বিশ্ব ব্যাংককে ‘না’ করার পর এডিবি এবং জাইকাও পদ্মা প্রকল্প থেকে সরে যায়। কিন্তু ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) এখন পর্যন্ত এই প্রকল্প থেকে সরে যাওয়ার কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়নি।

সরকার এখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে এগোলেও কেউ অর্থ দিতে চাইলে নিতে আপত্তি নেই বলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ইতোমধ্যে জানিয়েছেন।

পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, “আমরা আমাদের নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের অংশ হিসেবেই ইসলামী ব্যাংকের টাকা পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগ করা হবে।”

পদ্মা সেতু নির্মাণে ইসলামী ব্যাংকের কাছে ১ হাজার কোটি টাকা চাওয়ার পাশাপাশি দেশের শরীয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলোর সবগুলোকে সম্মিলিতভাবে একই পরিমাণ অর্থ দিতে অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।

সবমিলিয়ে দেশে ইসলামী শরীয়ার ভিত্তিতে কার্যক্রম পরিচালনাকারী ব্যাংক খাত থেকে পদ্মা সেতুতে দুই হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ আশা করছেন পরিকল্পনামন্ত্রী।

ইসলামী ব্যাংক ছাড়া বাংলাদেশে শরীয়াহভিত্তিক ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম চালাচ্ছে এক্সিম ব্যাংক, আল আরাফাহ ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক এবং ইউনিয়ন ব্যাংক।

পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্ব ব্যাংকের পুনরায় আসার কোনো সম্ভাবনা আছে কি না- এ প্রশ্নের উত্তর মন্ত্রী সরাসরি না দিয়ে দাবি করেন, সংস্থাটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ‘ভালো’ আছে।

“চলতি অর্থবছরে আমাদের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে বিশ্ব ব্যাংক ২৮০ কোটি ডলার সহায়তা দিচ্ছে। পদ্মা প্রকল্পে আমরা তাদের ১২০ কোটি ডলার না নিলেও তার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি অর্থ তারা আমাদের অন্য সব প্রকল্পে দিচ্ছে।”

“এর থেকেই প্রমাণিত হয় বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের কোনো অবনতি হয়নি। বরং অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে।”

বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তা অব্যাহত থাকলে সেতু নির্মাণে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে আসতে আস্থা পাবে বলে মনে করেন মুস্তফা কামাল।

জুন-জুলাইয়ের মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণের মূল কাজ শুরু করা যাবে বলে আশা করছেন পরিকল্পনামন্ত্রী।