লেনদেন ভারসাম্য: আট মাসে ২০২ কোটি ডলারের উদ্বৃত্ত

বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে বড় উদ্বৃত্ত ধরে রেখেছে বাংলাদেশ।

আবদুর রহিম হারমাছি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 April 2014, 03:12 PM
Updated : 20 April 2014, 05:46 PM

আড়াইশ কোটি ডলারের বেশি উদ্বৃত্তসহ গত অর্থবছর শেষের পর চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসেও সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে।

বৃহস্পতিবার প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের লেনদেন ভারসাম্যের সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে আমদানিসহ সার্বিক দেনা পরিশোধের পর দেশের লেনদেন ভারসাম্যে ২০২ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত হয়েছে।

রপ্তানি আয়ের ইতিবাচক ধারার পাশাপাশি আমদানি ব্যয়ের ধীর গতির কারণে এই উদ্বৃত্ত হয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

ফলে দেশের অর্থনীতিতে এক ধরনের ‘স্বস্তিদায়ক অবস্থা’ বিরাজ করছে বলেও তাদের অভিমত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২-১৩ অর্থবছরের একই সময়ে বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের পরিমাণ ছিল ১৯৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার।

এ হিসাবে চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে দুই কোটি ৫০ লাখ ডলার বেশি উদ্বৃত্ত রয়েছে।

২০১২-১৩ অর্থবছর শেষে লেনদেন ভারসম্যে মোট উদ্বৃত্তের পরিমাণ ছিল ২৫২ কোটি ৫০ লাখ ডলার। তার আগে ২০১১-১২ অর্থবছরে লেনদেন ভারসাম্যে ৪৪ কোটি ৭০ লাখ ডলারের ঘাটতি ছিল।

লেনদেন ভারসাম্যের এই উদ্বৃত্ত হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখত।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত বছরের শেষের দিকে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও আট মাসে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি উদ্বৃত্ত আমাদের অর্থনীতির জন্য অবশ্যই ভাল খবর।

“এক সময় মনে হচ্ছিল, আমদানি না বাড়ার কারণে উদ্বৃত্ত বাড়ছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে শিল্প স্থাপনের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন- মূলধনী যন্ত্রপাতির পাশাপাশি অন্যান্য পণ্যের আমদানিও বাড়ছে, যার ইতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে পড়বে।”

পদ্মা সেতুসহ বড় বড় প্রকল্পের কাজ শুরু হলে লেনদেন ভারসাম্যের বড় উদ্বৃত্ত কাজে লাগবে বলে জানান জায়েদ বখত।

বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মনে করেন, প্রধানত দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমায় লেনদেন ভারসাম্যে এই উদ্বৃত্ত হয়েছে।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রপ্তানি আয়ের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু আমদানি সে হারে বাড়ছে না, যার ফলশ্রুতিতে বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস পাচ্ছে। আর এটাই লেনদেন ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত বাড়াতে অবদান রাখছে।”

রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশে বিনিয়োগ কমে যাওয়াকেও এই উদ্বৃত্ত তৈরির অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন এই অর্থনীতিবিদ।

জায়েদ বখত বলেন, “স্বাভাবিকভাবে কোনো দেশের লেনদেন ভারসাম্যে বড় উদ্বৃত্ত থাকলে আমরা সে দেশের অর্থনীতির স্বাস্থ্য ভাল বলে মনে করি। আমরাও আমাদের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি বিচার-বিশ্লেষণ করে সেটা বলতে পারি। তবে বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি হলে আরো জোর দিয়ে আমরা বলতে পারতাম।

“দেশে এখন রাজনৈতিক অস্থিরতা নেই, সবকিছুই অনুকুলে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটা শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়াবে- এটা নিশ্চিত করে বলা যায়।”

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-অগাস্ট) উদ্বৃত্তের পরিমাণ ছিল ৬৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার, যা জুলাই-অক্টোবর সময়ে দাঁড়ায় ৯৩ কোটি ৩০ লাখ ডলারে।

নভেম্বর শেষে উদ্বৃত্ত বেড়ে ১৩৮ কোটি ৪০ লাখ ডলার হয়। ফেব্রুয়ারি শেষে তা ২০২ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে।

নিয়মিত আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য আয়-ব্যয় চলতি হিসাবের অন্তর্ভুক্ত। এই হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হলো, নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়।

বাণিজ্য ঘাটতি কমেছে ৪৪ শতাংশ

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ের বাণিজ্য ঘাটতি গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৪ শতাংশেরও বেশি কমেছে।

এই আট মাসে পণ্য বাণিজ্যে সামগ্রিক ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৫৬ কোটি ১০ লাখ ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৪৫৯ কোটি ৯০ লাখ ডলার।

২০১২-১৩ অর্থবছরে পুরো সময়ে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৭০১ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৯৩২ কোটি ডলার।

তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে বিভিন্ন পণ্য আমদানি খাতে (এফওবিভিত্তিক, ইপিজেডসহ) মোট দুই হাজার ৩১৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার ব্যয় করেছে বাংলাদেশ। আর পণ্য রপ্তানি থেকে (এফওবিভিত্তিক, ইপিজেডসহ) আয় করেছে এক হাজার ৯৫৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার।

এই হিসাবে সামগ্রিক ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩৫৬ কোটি ১০লাখ ডলার।

এর মধ্যে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে। গত অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে এ খাতের ঘাটতি ছিল ২১৫ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা বেড়ে ২৬৭ কোটি ৫০ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে।

মূলত বিমা, ভ্রমণ ইত্যাদি খাতের আয়-ব্যয় হিসাব করে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি পরিমাপ করা হয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে বাংলাদেশে ১১০ কোটি ৭০ লাখ ডলারের প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছিল।

চলতি বছরের একই সময়ে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়ে বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১৪ কোটি ৮০ ডলারে।

এই সময়ে পুঁজিবাজারে (পোর্টফোলিও বিনিয়োগ) ৩৯ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ২১ কোটি ডলার।