অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সরকার সফল: ফরাসউদ্দিন

সরকার অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছে বলে বিরোধী দল মনে করলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রতিবেশী ভারত, শ্রীলংকা ও পাকিস্তানের চেয়ে ভালো অবস্থায় আছে।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদক, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Sept 2013, 03:17 PM
Updated : 15 Dec 2016, 10:34 AM

সরকারের অর্থনৈতিক উন্নয়নের দাবি ও বিরোধী দলের সমালোচনার প্রেক্ষাপটে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম কথা বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নরের সঙ্গে।

বর্তমান মেয়াদে সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার প্রশংসা করলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক আচরণের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন তিনি।

এক সাক্ষাৎকারে ফরাসউদ্দিন রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রসঙ্গ টেনে বলেন, “অর্থনীতিকে রাজনীতি থেকে আমরা যদি একটু আলাদা করতে পারতাম তাহলে আমরা আরও বেশি এগিয়ে যেতাম। তারপরও আমি আশাবাদী, অনেক বিপত্তির মধ্যেও আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। ৬ শতাংশের উপরে প্রবৃদ্ধি অবশ্যই বড় অর্জন বলে আমি মনে করি।”

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ বিরোধী দলের নেতারা সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার কট্টর সমালোচক। তাদের অভিযোগ, আর্থিক খাতে লুটপাট ও ব্যাপক দুর্নীতির কারণে দেশের সার্বিক অর্থনীতি বিপর‌্যস্ত।

দলনিরপেক্ষ গবেষণা সংস্থাগুলি রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিনিয়োগ না বাড়ায় সরকারি নীতির সমালোচনা করছে।

বিষয়গুলির দিকে ফরাসউদ্দিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, “দু-একটি সূচক ছাড়া অর্থনীতির অবস্থা ভালো। আমি এভাবে বলতে চাই-খুবই ভালো। পৃথিবীর যে কোনো দেশের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশের অর্থনীতি খুবই ভালো বলেই বিবেচিত হবে।

“আমি মনে করি অর্থনীতিতে গত পৌণে পাঁচ বছরে সরকার সঠিক পথেই চলেছে। ভালোভাবেই ম্যানেজ করেছে।”

এই ‘সাফল্যের’ জন্য দেশের বিশাল শ্রমশক্তির অবদানই সবচেয়ে বেশি বলে মনে করেন সাবেক এই সরকারি কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, “চীনারা পারছে না। তাদের শ্রমশক্তি নেই। ‘ওয়ান চাইল্ড’ কর্মসুচি তাদের বিপদে ফেলে দিয়েছে।তাদের এই সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী।

“কিন্তু আমরা এই শ্রমশক্তিকে কাজে লাগিয়েই এগিয়ে চলেছি। আমি মনে করি- আমাদের এই শ্রমিশক্তির কারণেই আমেরিকানরা সস্তায় পণ্য কিনতে পারছে। আগে তারা যে টাকায় একটা ট্রাউজার কিনতো, এখন তারা সেই টাকায় তিনটা কিনতে পারছে। বাংলাদেশের শ্রমিকদের কারণেই এটা হয়েছে।”

প্রসঙ্গক্রমে পোশাক শিল্প নিয়ে কথা বলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত সচিব ফরাসউদ্দিন।

তিনি বলেন, “আমাদের পোশাক শিল্প মালিকরা এই শ্রমিকদের নিয়ে মুনাফা করছে। অথচ তারা তাদের শ্রমের সঠিক মূল্যের ব্যাপারে সব সময়ই উদাসীন থেকেছেন। এটা মোটেই কাম্য নয়।

“সব সরকারই এদেরকে সমীহ করেছে। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পরও আমাদের দুর্ভাগ্য- যে আমরা এখনও বিজিএমইএ ভবনটি ভাঙ্গতে পারিনি। বিজিএমইএ কে ক্ষতিপূরণ দিয়ে হলেও এই ভবনটি ভাঙ্গা উচিৎ বলে আমি মনে করি।”

তিনি বলেন, “আমি অনেক আগেই প্রস্তাব করেছিলাম বিজিএমইএ ভবন ভেঙ্গে কারওয়ানবাজারে এরশাদের সময় আলোচিত ‘জনতা টাওয়ারে’ স্তানান্তর করা যেতে পারে। কিন্তু কেউ আমার কথা শোনেনি।”

গত অর্থবছরে ২৭ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয়কে ‘ট্রিমেনডাস এচিভমেন্ট’ মন্তব্য করে ফরাসউদ্দিন বলেন, “অনেক বাধা বিপত্তি সত্বেও এই বিশাল অংকের রপ্তানি আমাদের অর্থনীতির ভিতকে বেশ মজবুত রেখেছে।”

প্রবাসীদের পাঠানো ‘কষ্টার্জিত’ রেমিটেন্সও এক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছে বলে মনে করেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা উপাচার‌্য।

গলার কাঁটা ডলার

সামষ্টিক অর্থনীতির সূচক উন্নয়নে সরকারের ভূমিকার প্রশংসা করলেও সাবেক গভর্নর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনেক নীতির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন।

বাজার থেকে ডলার কিনে টাকার মান বাড়িয়ে রাখার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগকে ভালো মনে করছেন না তিনি।

ডলার এখন গলার কাঁটা বলে মন্তব্য করেন অর্থনীতির এই বিশ্লেষক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে ডলার কিনলে বাজারে টাকার সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে বলে মনে করেন তিনি।

ফরাসউদ্দিন বলেন, “সে কারণেই বলছি, বাজার থেকে ডলার কিনে টাকার মান বাড়ানো বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। ডলার এখন গলার কাঁটা।”

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ৮৮ কোটি ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর গত সপ্তাহে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১৫ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার।

চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরের প্রথম আড়াই মাসে (পহেলা জুলাই থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) ৯১ কোটি ডলার বাজার থেকে কিনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

২০১২-১৩ অর্থবছরে কিনেছিল ৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। 

বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট: ফরাসউদ্দিন

ভারতীয় রুপির দর পড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে ফরাসউদ্দিন বলেন, “ভারতে ডলারের বিপরীতে রূপির মান কমছে। আর বাংলাদেশে বাজার থেকে ডলার কিনে টাকার মান ধরে রাখা হচ্ছে। ভারত সরকার তাদের দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে সুদূর প্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই রুপির বিপরীতে ডলারকে শক্তিশালী হতে দিচ্ছে।”

এরফলে বাংলাদেশের বাজার ভারতীয় পণ্যে ‘সয়লাব’ হয়ে যেতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করছেন ফরাসউদ্দিন।

কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “আমাদের টাকা শক্তিশালী হওয়ায় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে রুপির দর কমায় সেদেশে জিনিসপত্রের দাম কমে যাবে। সে কারণে ভারতীয় পণ্য বেশি আসবে।

“এমনিতেই আমরা ভারত থেকে প্রচুর পণ্য আমদানি করি। আগামীতে এর পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে,” বলেন তিনি।

শুক্রবার রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ৬৩ টাকা ৭৮ পয়সায় ডলার কিনেছে।

সপ্তাহ খানেক আগে ভারতীয় রুপির বিপরীতে ডলারের দর ৬৮ টাকায় উঠেছিল।

চার মাস আগে রুপির দর ছিল ৫১ টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বুধবার প্রতি ডলার ৭৭ টাকা ৭৫ পয়সায় বিক্রি হয়েছে। গত চার মাস ধরে এই একই দামে ডলার বিক্রি হচ্ছে।

২০১২-১৩ অর্থবছরে ভারত থেকে ৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। আর ভারতে রপ্তানি হয়েছে ১ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। 

মিডিয়া বেসরকারি ব্যাংকের বিষয়ে চুপ’

ব্যাংকিং খাত প্রসঙ্গে ফরাসউদ্দিন বলেন, “সরকারি ব্যাংকগুলোতে হলমার্কসহ কিছু কেলেঙ্কারির ঘটনা ধরা পড়েছে। এ সব ঘটনা ব্যাংকিং খাতকে এক ধরনের অস্থিরতার দিকে ঠেলে দিয়েছে।

“এখানে আমার একটা প্রশ্ন আছে। আমার জানা মতে, বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে সরকারি ব্যাংকগুলোর চেয়ে দশ গুন বেশি দুর্নীতি-অনিয়ম হচ্ছে। কিন্তু সে সব খবর আমরা মিডিয়ায় দেখতে পাই না। যারা মিডিয়ার মালিক, তারাই বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মালিক। এ কারণেই হয়তো বেসরকারি ব্যাংকগুলো নিয়ে কোনো নিউজ হয় না।”

‘এত রিজার্ভ দিয়ে কী হবে?’

১৬ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে সরকারের আরেকটি সাফল্য উল্লেখ করে মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, “মূলত, রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স বাড়ায় এবং আমদানি ব্যয় কমায় বিদেশি মুদ্রার মজুদ এই জায়গায় পৌছেছে। তবে এখানে আমার কথা আছে। এই বড় অংকের রিজার্ভ ধরে রেখে কোনো লাভ নেই। এটা যে করেই হোক বিনিয়োগে নিয়ে আসতে হবে। তা নাহলে এই রিজার্ভ বা ডলার আমাদের গলার কাঁটা হবে।”

এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, “মানুষ না খেয়ে যাতে না মরে- সে পরিমাণ খাদ্য আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় রিজার্ভ জমা থাকলেই যথেষ্ট। কিন্তু বাম্পার ফলনের কারণে আমাদের গুদামগুলোতে ১৫ লাখ টনের বেশি খাদ্য মজুদ আছে। আগামী এক-দেড় বছরে কোনো খাদ্য আমদানি করতে হবে না।”

সে হিসাবে বেশি রিজার্ভ ধরে রাখা ‘বোকামি’ ছাড়া আর কিছু নয় বলে মনে করেন তিনি।

‘মুদ্রানীতি প্রবৃদ্ধিকে শ্লথ করেছে’

সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির সমালোচনা করে ফরাসউদ্দিন বলেন, “মুদ্রানীতি দিয়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে স্লো করা হচ্ছে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। আর এজন্য প্রয়োজন সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি।”

‘অর্থনীতির সূচকগুলোর মধ্যে বিনিয়োগ পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ’ মনে করিয়ে দিয়ে ফরাসউদ্দিন বলেন, “নির্বাচনের কারণে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। ব্যাংকগুলোতে টাকা পড়ে আছে। বিনিয়োগ হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিৎ সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতির মাধ্যমে ব্যাংকগুলোতে পড়ে থাকা টাকা বিনিয়োগে নিয়ে আসার উদ্যোগ গ্রহণ করা।

“মুদ্রানীতি দিয়ে বড়জোর মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল রাখা যেতে পারে। মুদ্রানীতি দিয়ে প্রবৃদ্ধি আটকে রাখা কোনভাবেই ঠিক নয়।”

বর্তমানে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে বলে জানান তিনি।

দেশে বিনিয়োগ বাড়াতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়ে ফরাসউদ্দিন বলেন, “দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে। এটা আরও বাড়াতে হবে। কারণ চাহিদা বাড়তেই থাকবে। এ চাহিদা মেটাতে আমাদের কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে যেতেই হবে। বড় বড় বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে।

“এতে রিজার্ভ ব্যবহার করতে হবে। রিজার্ভকে অর্থনীতির উৎপাদনশীল খাতে নিয়ে আসতে হবে।”

বিনিয়োগ ছাড়া কোনো উপায় নেই মন্তব্য করে সাবেক গভর্নর বলেন, “বাংলাদেশে তেমন এফডিআই আসে না। ছিঁটেফোটা আসে। স্থানীয় বিনিয়োগই বাড়াতে হবে। আর এজন্য জাইগান্টিক (বড়) সব প্রকল্প হাতে দিতে হবে।”

রিজার্ভ থেকে ২ বিলিয়ন ডলার পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগ করার পরামর্শ দিয়ে ফরাসউদ্দিন বলেন, “আমি আগেও বলেছি, সবচেয়ে ভালো হতো আমরা যদি বিশ্ব ব্যাকের টাকায় পদ্মা সেতু করতে পারতাম। কিন্তু যেহেতু সেটা আর হচ্ছে না। সেহেতু রিজার্ভ ব্যবহার করা যেতে পারে।

“এক্ষেত্রে প্রবাসীদের পদ্মা সেতুর ৪০ শতাংশ মালিকানা (ইকুইটি)দিয়ে তাদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করা যেতে পারে।

“মোদ্দা কথা যে করেই হোক রিজার্ভ কাজে লাগাতে হবে। বিনিয়োগে নিয়ে আসতে হবে। এবং সেটা অবশ্যই অর্থনীতির উৎপাদনশীল খাতে হতে হবে।”