তাই হেফাজতে ইসলাম কর্মক্ষেত্রে নারীর অবাধ বিচরণ রোধের দাবি তোলায় ক্ষোভ ঝরে পড়ল পোশাক শ্রমিক জুলেখার কণ্ঠে- “হুজুররা বললেই তো হবে না। ওনারা তো আর ঘরে খাওন পৌছায়া দিবেন না।”
তেজগাঁর হা-মীম গ্রুপের দ্যাটস ইট ফ্যাশনে নিরাপত্তা রক্ষী হিসেবে কাজ করছেন টাঙ্গাইলের জুলেখা, যার মতো শ্রমিকের সংখ্যা দেশে প্রায় ৩২ লাখ।
দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি তৈরি পোশাক শিল্পের নারী শ্রমিকরা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হেফাজতের দাবি নিয়ে, যা গত শনিবার মতিঝিলের সমাবেশ থেকে তোলা হয়েছে।
হেফাজতের ১৩টি দাবির চতুর্থটি হচ্ছে- ‘ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যাভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বালনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে’।
নারীবিহীন ওই সমাবেশে নারী উন্নয়ন নীতি বাতিলের দাবিও জানানো হয়। শুধু তাই নয়, নারীদের নিয়ে তাদের মনোভাবের প্রকাশও ঘটে নারী সাংবাদিকদের ওপর হামলার মাধ্যমে।
তবে নারীদের ছাড়া যে পোশাক খাত চলবে না, তা পোশাক শিল্প মালিকদের কথায় স্পষ্ট।
“ওরা (হেফাজতে ইসলাম) চাইলেই আমরা নারী কর্মীদের বাদ দিতে পারব না। কারণ ৮০ শতাংশ কর্মী নারী হওয়ায় প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোই তারা করে,” বলেন বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল ইসলাম।
তার মতে, পোশাক খাত গরিব নারীদের উপার্জনের মাধ্যমে ‘পুরুষশাসিত’ অবস্থা থেকে স্বনির্ভরতা এনে দিয়েছে।
এই স্বনির্ভরতার যে প্রয়োজন ছিল, তা ফুটে উঠল দ্যাটস ইট কারখানার শ্রমিক সুফিয়া বেগমের কথায়।
“স্বামী-স্ত্রী দুইজন কাজ না করলে এই ঢাকা শহরে থাকাডা, খাওয়াডা হয়তো চলবো, কিন্তু পোলাপাইন মানুষ করমু কেমনে?”
ময়মনসিংহ থেকে আসা হোসনে আরার অবস্থাও একই। পাঁচ বছর হলো ঢাকায় এসেছেন তিনি। কাজ ছাড়া যে টিকতে পারবেন না, তা বুঝে গেছেন।
ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ রেখেই তিনি বলেন, “হুজুরদের কথা আমরাও মানতে চাই। কিন্তু হুজুররা তো আমার, আমার পোলাপাইনের খাওনের দায়িত্ব নিবেন না।”
নিজে কাজ না করলেও বিষয়টি বোঝেন আশফিয়া বেগম। টফিকা গার্মেন্টসের সুপারভাইজার আবুল কালামের স্ত্রী হওয়ায় তিনি পোশাক শ্রমিকদের অনেক কথাই জানেন।
“তারা (হেফাজত) কারখানাগুলাতে কাজ করা হাজার হাজার মানুষের পরিবারের দায়িত্ব নেক। তাইলে সবাই বাসায় বসে থাকব,” বলেন আশফিয়া।
সেপাল গার্মেন্টসের মোহাম্মদ সবুজ মিয়া বলেন, “পর্দার বিষয়টা ঠিক আছে। কিন্তু তারা পরিবাররে সেভাবে সাহায্য করতেছে, সেইটা বন্ধ হয়ে গেলে তো সমস্যা।”
সবুজ মিয়ার বোন আনোয়ারা বেগমও কাজ করেন একই কারখানায়। শুধু স্বামীর আয়ে সংসার চলবে না বলে নিজেও আয়ে নেমেছেন তিনি; আর তাতে কিছুটা স্বচ্ছলতাও আসছে বলে জানান তিনি।
শারীরিক অসুস্থতার কারণে বর্তমানে কর্মহীন পোশাককর্মী মীমের মতে, সময় অনেক বদলেছে, এখন আর নারীদের আটকে রাখার সুযোগ নেই।
“১০ বছর আগেও যদি আপনারা মেয়েদের ঘরে বসে থাকতে বলতেন, সেইটা অন্যরকম ছিল। তখন সব জায়গায় এত মেয়ে ছিল না। আমরা সেভাবেই চলতে শিখতাম।”
শিক্ষাক্ষেত্রে গত কয়েকবছর ধরেই পুরুষের চেয়েও এগিয়ে রয়েছে নারীরা। গত বছর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাসের হারেও এর প্রতিফলন ঘটেছে। ৭৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ পাসের হারের মধ্যে ছাত্র ছিল ৭৮ দশমিক ২৩ শতাংশ এবং ছাত্রী ৭৯ দশমিক ০৯ শতাংশ। এছাড়া মাধ্যমিক এবং প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীতে ছাত্র ও ছাত্রীর পাসের হার প্রায় সমান।
“এখন এনজিও বলেন, গার্মেন্টস বলেন স্কুল-কলেজ বলেন, সবখানেই প্রচুর মেয়ে। এখন যদি সবাই বাসায় গিয়ে বসে থাকে, তাহলে তো হবে না,” বলেন মীম।