‘মন্থর দক্ষিণ এশিয়ায় এগিয়ে বাংলাদেশ’

মূল্যস্ফীতি, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, জ্বালানি সঙ্কট ও বিনিয়োগে খরার কারণে গত এক দশকের মধ্যে ২০১২ সালে সবচেয়ে মন্থর গতিতে এগিয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতি।

হুসাইন আহমদ সহ সম্পাদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Jan 2013, 03:42 AM
Updated : 18 Jan 2013, 04:14 AM
তবে এর মধ্যেও প্রবাসী আয়ের ওপর ভর করে বাংলাদেশ ও শ্রীলংকা প্রবৃদ্ধির গতি ধরে রেখেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে।  

বৃহস্পতিবার প্রকাশিত জাতিসংঘের উন্নয়ন নীতি ও পর্যালোচনা বিভাগের ‘বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও পূর্বাভাস ২০১৩’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিকভাবে একটি মন্থর বছর পার করলেও ২০১৩ সালে দক্ষিণ এশিয়ার প্রবৃদ্ধির গতি কিছুটা বাড়বে।

উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং পরিবহন ও জ্বালানি প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি ভোগ্যপণ্যের বিক্রি কমায় গত বছর দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্য ও বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে এতে উল্লেখ করা হয়েছে।

তাছাড়া উন্নত ও উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলোর মন্দার কারণে এ অঞ্চলের অধিকাংশ দেশের রপ্তানি বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

২০১২ সালে ‘কিছুটা ধীরগতির’ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মধ্যেও দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ও শ্রীলংকার অর্থনৈতিক চিত্র ‘অনুকূল’ ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।

আর এর পেছনে প্রবাসী আয় ও ভোক্তা ব্যয় বৃদ্ধি এবং বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধিই মূল ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করে জাতিসংঘের উন্নয়ন নীতি ও পর্যালোচনা বিভাগ।

“২০১২ সালে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলংকার প্রবাসী শ্রমিকদের আয়ে দ্রুত বৃদ্ধি ঘটেছে, যা দেশগুলোর বিশাল বাণিজ্য ঘাটতিতে কিছুটা ভারসাম্য এনেছে।”

২০১২ সালে বিদেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাওয়ায় গতবছরের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলাদেশে প্রবাসী আয় তার আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২০ শতাংশ বেড়েছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়।

দক্ষিণ এশিয়ার প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে এতে বলা হয়, ২০১১ সালে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হওয়ার পর ২০১২ সালে এ অঞ্চলের গড় দেশজ উৎপাদন বেড়েছে মাত্র ৪ দশমিক ৪ শতাংশ হারে।

তবে ভারতের ক্রমাগত উন্নতির প্রভাবে এ অঞ্চলের প্রবৃদ্ধি ২০১৩ সালে ৫ শতাংশ ও ২০১৪ সালে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ হারে বাড়বে বলে প্রতিবেদনে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে।

আর বাংলাদেশ ২০১২ সালে ৬ দশমিক ২ শতাংশ, ২০১৩ সালে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে বলে ধারণা করছেন জাতিসংঘের অর্থনীতিবিদরা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার কিছু এলাকায় খরা, খাদ্যের উচ্চমূল্য, স্থানীয় মুদ্রার উল্লেখযোগ্য দরপতন এবং জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির কারণে এ অঞ্চলে গড় ভোক্তা মূল্য সূচক ২০১১ সালে ১১ দশমিক ২ থেকে বেড়ে ২০১২ সালে ১১ দশমিক ৬ হয়েছে।

তবে ২০১২ সালে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতি তুলনামূলক কম হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কম রাখার কথা।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, সুদান ও ইয়েমেনের মতো যে দেশগুলো রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, ২০১০ ও ২০১১ সালে তাদের বিরূপ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশসহ আফ্রিকার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দেশে শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান অর্থনীতির দেশ ভারতের বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি ২০১০ সালের ৯ শতাংশ থেকে ২০১২ সালে ৫ দশমিক ৫ শতাংশে নেমেছে, যা গত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।

আর দক্ষিণ এশিয়ার মোট জিডিপির তিন চতুর্থাংশের যোগান ভারত থেকে আসে বলে এর প্রভাব পড়েছে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার ওপর।

তবে কিছুটা জোরদার রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ও পুঁজি বিনিয়োগের উপর ভর করে ভারতের জিডিপি ২০১২৩ সালে বেড়ে ৬ দশমিক ১ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়াবে বলে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ার কিছু অংশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তা শঙ্কা অর্থনীতিতে সংশয় তৈরি করেছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এ কারণে নেপাল ও পাকিস্তানে অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমেছে। পর পর চার বছর পাকিস্তানে মোট বিনিয়োগ কমেছে। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের তেল রপ্তানি হ্রাস ও রিয়ালের অবমূল্যায়নের কারণে দেশটির অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

পূর্বাভাসে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশে গড় মূল্যস্ফীতি ২০১৩ সালে কমে ১০ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে ৯ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে আসবে।

জাতিসংঘ মনে করে, বাংলাদেশসহ আরো কয়েকটি দেশে প্রবাসী আয় বাড়লেও দক্ষিণ এশিয়ার শ্রমবাজারকে মৌলিক কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে- বৃহৎ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কম উৎপাদনশীল কাজের প্রাধান্য, ব্যাপক কর্মজীবী দরিদ্র মানুষ, নারীদের কম অংশগ্রহণ এবং উচ্চমাত্রার যুব বেকারত্ব।

বিশ্ব অর্থনীতির দুর্বলতা এবং আঞ্চলিক বা দেশীয় ঝুঁকির কারণে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতির সামনে কিছুটা ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র অথবা ইউরোপ বা চীনের অর্থনীতির পতন হলে দক্ষিণ এশিয়ার রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে প্রবাসী আয়ের প্রবাহও ঝুঁকিতে পড়বে।