বানের জলে ডুবেছে সাড়ে ৪ লাখ হেক্টর জমি, খাদ্য সঙ্কটের শঙ্কা

বন্যায় বাংলাদেশের প্রায় দুই ডজন জেলার কয়েক লাখ হেক্টরের বেশি ফসলি জমি তলিয়ে যাওয়ায় খাদ্য সঙ্কটের পড়ার আশঙ্কা করছেন একজন কৃষি বিশেষজ্ঞ।

জাফর আহমেদও ফয়সাল আতিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 August 2017, 05:37 PM
Updated : 16 August 2017, 05:41 PM

সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, কয়েক দিনের মধ্যে পানি নেমে গেলে কৃষকদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে আবারও স্বাভাবিক কৃষি উৎপাদন সম্ভব। সেটা করা গেলে তেমন সমস্যা হবে না।

তবে বন্যার যে লক্ষণ তাতে সহসাই পানি নামবে না বলে মনে করছেন কৃষি বিশেষজ্ঞ ড. আসাদুজ্জামান; তার ধারণাকে ভিত্তি দিচ্ছে বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পূর্বাভাসও।

সরকারি উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা বিআইডিএসের সাবেক গবেষণা পরিচালক আসাদুজ্জামান বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যদি অগাস্ট মাসের মধ্যে বন্যার পানি পুরোপুরি নেমে যায় তাহলে সরকারি সহায়তায় কৃষকদের পুনরায় মাঠে নামিয়ে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব। কিন্তু চলমান বন্যার লক্ষণে এটা আরও দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে।”

এই পরিস্থিতিতে খাদ্য সঙ্কট এড়াতে সরকার ‘প্রয়োজনীয় উদ্যোগ’ নিচ্ছে না বলে মনে করেন তিনি।

ড. আসাদুজ্জামান বলেন, “দেশের জনগণের খাদ্য নিরাপত্তার দিকে মনোযোগী না হয়ে আদালতের একটি রায় নিয়ে সরকার ব্যস্ত।

“আমাদের জানামতে, সরকারি গুদামে মাত্র আড়াই লাখ টনের মতো খাদ্য মজুদ রয়েছে। অথচ আমাদের কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ লাখ টন মজুদ রাখা উচিৎ।”

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের গত ১০ অগাস্টের তথ্য মতে, সরকারি গুদামে খাদ্যশস্যের মোট মজুদ চার লাখ ৩৪ হাজার টন। এর মধ্যে চাল রয়েছে দুই লাখ ৮৭ হাজার টন এবং গম রয়েছে এক লাখ ৪৭ হাজার টন। এছাড়া বন্দরে খালাসের অপেক্ষায় আছে ৮৩ হাজার টন খাদ্যশস্য।

বন্যার বিপদ টের পাচ্ছেন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামও। তিনি বুধবারই জানিয়েছেন, এবার ১৫ লাখ টন চাল এবং ৫ লাখ টন গম বিদেশ থেকে আমদানি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

খাদ্য মজুদের এই অবস্থায় আমনের চারা লাগানোর সময়ে দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা এখন প্লাবিত।

বন্যার পানিতে কুড়িগ্রামে ডুবেছে ঘর, সঙ্গে লাগোয়া সবজি বাগানও

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন দপ্তরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের বুধবারের তথ্য অনুযায়ী, রোপা আমনের চলতি মওসুমে সারা দেশে তিন কোটি ১০ লাখ ৫৫৪ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়েছে। এরমধ্যে ৩৩ জেলায় চার লাখ ৫০ হাজার ৭২৯ হেক্টর জমি বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।

এটা প্রাথমিক হিসাব; উত্তরাঞ্চল ছাড়িয়ে বন্যা এখন মধ্যাঞ্চলে বিস্তৃত হচ্ছে। ফলে বন্যার শেষ নাগাদ ক্ষতিগ্রস্ত ফসলি জমির পরিমাণ আরও বাড়বে।  

কৃষি সম্প্রসারণে অধিদপ্তরের সরেজমিন উইংয়ের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. তাজুল ইসলাম পাটোয়ারি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শস্য ক্ষেত্রে রোপা আমন, আমন বীজতলা, শাক-সবজি, বোনা আমন ও আউশ ধান রয়েছে। এরমধ্যে কিছু এলাকা পানিতে ডুবে গেছে।

“তবে পানি নেমে না যাওয়া পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নিরূপণ করা যাচ্ছে না।”

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, কিছু এলাকার আমন ধান পানিতে তলিয়ে গেলেও পানি সরে যাওয়ার পর তা টিকে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ধান নষ্ট হলেও নতুন বীজ বপনের জন্য হাতে এখনও কিছুদিন সময় আছে।

যেসব জেলা থেকে সারা দেশে চাল সরবরাহ করা হয়, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম দিনাজপুর জেলা। দিনাজপুর ও তার পাশের ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় মিলিয়ে মোট এক লাখ ৬৩ হাজার হেক্টর জমির ধান বন্যার পানিতে তলিয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দিনাজপুর অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক মো. জুলফিকার হায়দার এই তথ্য জানিয়ে বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এই তিন জেলায় মোট চার লাখ ৫৫ হাজার হেক্টর জমিতে আমন চাষ করা হয়েছিল। এখনও ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নিরূপণ করা হয়নি। তবে ১০ থেকে ২০ শতাংশ ফসলের ক্ষতি হতে পারে।

বুধবার সন্ধ্যা নাগাদ ৮০ ভাগ এলাকার পানি নেমে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, কৃষকদের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে এখন মনোযোগ দেবেন তারা।  

এক্ষেত্রে তাদের হাতে থাকা আমনের চারার পাশাপাশি কৃষি পুনর্বাসন কর্মসূচির পক্ষ থেকে কৃষকদের চারা দেওয়া হবে।

ঠাকুরগাঁও ভাসছে বন্যার পানিতে

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মঞ্জুরুল হুদা জানান, তার জেলায় এবার আউশ চাষ হয়েছে ৫২ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে, তার মধ্যে ৪৮০ হেক্টর জমি ডুবে গেছে। আমন চাষ হয়েছে ৪৬ হাজার ১৯০ হেক্টর জমিতে। এগুলো চারা পর্যায়ে আছে। এরমধ্যে ৮৯০ হেক্টর জমির ফসল নিমজ্জিত হয়েছে।

“আমন চারা পর্যায়ে আছে। পানি সরে গেলে এগুলো টিকে যেতে পারে। আর নষ্ট হলেও আবার রোপন করতে আরও কিছু দিন সময় হাতে আছে।”

ওই জেলায় সবজির চাষ হওয়া চার হাজার ৪৯৫ হেক্টর জমির মধ্যে ২০ হেক্টর বন্যার পানিতে ডুবে গেছে।

বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা প্রতুল কুমার জানান, এই জেলায় এক লাখ ৯০ হাজার হেক্টর জমিতে আমন রোপন করা হয়েছে। এরমধ্যে ৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল বন্যায় আক্রান্ত। আউশের ফলন ইতোমধ্যেই উঠে গেছে।

আমনের বীজতলাও বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে বীজতলা নষ্ট হয়েছে কি না তা এখনই বলা যাচ্ছে না।

তিনি জানান, বগুড়ায় তিন হাজার ১০৫ হেক্টর জমিতে সবজির আবাদ হয়েছে। বন্যার পানি উঠেছে ১২৮ হেক্টর জমিতে। এতে করে দেড় হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

যশোর বিভাগীয় কৃষি কর্মকর্তা চন্ডিদাস কুণ্ডু জানান, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, মাগুরা, মেহেরপুর ও ঝিনাইদহ জেলায় বন্যার প্রভাব তেমন পড়েনি। এসব এলাকায় স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হওয়ায় কোথাও স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়নি। ফলে ফসলের কোনো ক্ষতি হয়নি।

তবে যশোরের কেশবপুর উপজেলায় ভবদহে কিছুটা জলাবদ্ধতা আছে বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, “এই সময়টাতে মাঠে শাক-সবজি কম থাকে। এখন শীতকালীন শাক সবজির বীজ রোপনের সময়। সবজি চাষের জমিগুলো তুলনামূলক উঁচু হওয়ায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা কম।”