উন্নয়ন দর্শনের কেন্দ্রে মানুষকে রাখতে হবে: সেলিম জাহান

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হলেই মানুষের উন্নয়ন হবে-এই ধারণা কয়েক দশক আগেই বাতিল হওয়ার কথা তুলে ধরে অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান বলেছেন, সমাজ ও দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন চাইলে মানুষকে কেন্দ্রে রেখেই উন্নয়ন পরিকল্পনা সাজাতে হবে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 August 2017, 02:32 PM
Updated : 3 August 2017, 02:32 PM

কেবল প্রবৃদ্ধি অর্জন নয়, সেটা কীভাবে অর্জিত হবে এবং ব্যবহৃত হবে সেদিকে লক্ষ রেখে নীতি নির্ধারণেরও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি-ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয়ের এই পরিচালক বলছেন, সমাজকে এগিয়ে নিয়ে সক্ষমতা ও সুযোগের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করতে হবে। দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার পাশাপাশি তাদের কাজেরও সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।

বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক উন্মুক্ত বক্তৃতায় সেলিম জাহান বলেন, “আয় বা প্রবৃদ্ধি চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়। এটা একটা পন্থা, একটা উপকরণ। আয় বা প্রবৃদ্ধিকে আপনি কীভাবে ব্যবহার করছেন সেটা হচ্ছে বড় কথা।

“এই আয় বা প্রবৃদ্ধি দিয়ে আপনি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারেন অথবা একটি কর্মহীন অবস্থার মধ্যে আপনি চলে যেতে পারেন। আয় বা প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে আপনি দারিদ্র্য দূরীকরণের ব্যবস্থা করতে পারেন, অথবা এমন একটা ব্যবস্থা করতে পারেন যেখানে দারিদ্র্য বেড়ে যাবে। আয় বা প্রবৃদ্ধি আপনি জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে করতে পারেন, অথবা দেখা যাবে একটা স্বৈরাচারি ব্যবস্থার মাধ্যমে করলেন।”

উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষার উপরও জোর দেন ১৯৮৯-৯০ সালে পরিকল্পনা কমিশনের অর্থনৈতিক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করা সেলিম জাহান।

তিনি বলেন, “আপনি আয় বা প্রবৃদ্ধি বাড়াতে পারেন, আপনার যে প্রাকৃতিক সম্পদ আছে সেটাকে ব্যবহার করে, আবার অন্যদিকে পরিবেশকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে। এটা একটি সিদ্ধান্তের ব্যাপার। রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে সিদ্ধান্ত, আমাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত।

“চূড়ান্ত বিচারে যদি ধরি, আজকে একটি দেশের সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার করা হয়, দেশের ১০০ শতাংশ লোক যদি কাজ করে, তাহলে সেদেশের প্রবৃদ্ধি ১০০ শতাংশ বাড়ানো যাবে। কিন্তু সেই ১০০ শতাংশ করতে গিয়ে আপনি পুরো সমাজ, অর্থনীতি, পুরো প্রকৃতিটাকে ধ্বংস করে দিতে পারেন।”

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে বদলে যাওয়া বিশ্বে ষাটের দশকে এসে প্রবৃদ্ধিই মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে জানিয়ে সেলিম জাহান বলেন, “সে সময় প্রবৃদ্ধি কেন্দ্রিক চিন্তা ছিল। প্রবৃদ্ধিকে আমরা বাড়াব, তারপর আস্তে আস্তে মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়তে থাকবে। বাংলায় যেটাকে আমরা চুইয়ে পড়া অর্থনীতি বলে থাকি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হলে উন্নয়ন সবার কাছে পৌঁছে যাবে।

“ষাটের দশকের শেষের দিকে দেখা গেল, বিভিন্ন জায়গায় প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ৬ শতাংশ, ৭ শতাংশ হারে। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি সার্বজনীন হচ্ছে না। সামাজিক ও অর্থনীতির নানা দিক থেকে। আমরা যখন কোনো উৎপাদন বণ্টন প্রক্রিয়া করি, শ্রমিকের যে অংশগুলো, তাদের শ্রমের বিভাজনে সেভাবে যাচ্ছে না।

“বাজেটের ভারসাম্য রক্ষা হচ্ছে, কিন্তু মানুষের জীবনযাত্রার মানের ভারসাম্য রক্ষা হচ্ছে না। তার ফলে মানুষের শিক্ষা, মানুষের স্বাস্থ্য, পুষ্টির বিষয় রক্ষিত হচ্ছিল না।”

সেই অবস্থা থেকে মানব উন্নয়ন ধারণার সূত্রপাত উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আসল যে কথাটি আমরা বলতে চেয়েছি, ১৯৮৯-৯০ সালের দিকে সেটি হচ্ছে চূড়ান্ত বিচারে উন্নয়নের লক্ষ্য হচ্ছে মানব উন্নয়ন, সেটা আমরা কৃষি উৎপাদনই করি, অবকাঠামো তৈরি করি। সেই পর্যন্ত আমরা চাই, এটা মানুষের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, উন্নততর জীবন যাপনের সুযোগ, মানুষের অধিকার, মানুষের অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করা দরকার।

“মানব উন্নয়নের মূল বিষয় হচ্ছে- উন্নয়নের আলোচনা, উন্নয়নের যে বিতর্ক, উন্নয়নের যে বিধিমালা, উন্নয়নের যে দর্শন, তার কেন্দ্রে থাকবে মানুষ।”

সক্ষমতা ও সুযোগের মধ্যে ভারসাম্য তৈরির পরামর্শ দিয়ে সেলিম জাহান বলেন, “এই দুটির মধ্যে যদি কোনো ধরনের অভারসাম্য থাকে, তাহলে সমস্যা। প্রচুর সক্ষমতা আমরা তৈরি করেছি, কিন্তু সুযোগ নেই।”

সক্ষমতা ও সুযোগের ভারসাম্যহীনতায় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ এবং এক সময় শ্রীলঙ্কায় উন্নয়ন ধারণা কাজে লাগেনি বলে জানান এই অর্থনীতিবিদ।

তিনি বলেন, “এক সময় শ্রীলঙ্কায় সক্ষমতা আছে, তরুণ সমাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সনদ নিয়ে বের হচ্ছে, প্রশিক্ষণ নিয়ে বের হচ্ছে। কিন্তু রাজনৈতিক কারণেই হোক, বা সহিংসতার কারণেই হোক, সেখানে সুযোগ সেভাবে তৈরি হয়নি। সে সময় শ্রীলঙ্কায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদধারীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার ছিল সবচেয়ে বেশি। কারণ সুযোগ নেই।

“অপরদিকে মধ্যপ্রাচ্যে প্রচুর সুযোগ আছে। কারণ সম্পদ আছে। বিনিয়োগ হচ্ছে, অবকাঠামো হচ্ছে। যেহেতু সক্ষমতা নেই, সে কারণে দক্ষ থেকে শুরু করে অদক্ষ শ্রমিক সব কিছু তাদের বাইরে থেকে নিয়ে যেতে হচ্ছে।”

ব্যক্তিকেন্দ্রিক সক্ষমতার চেয়ে গোষ্ঠীকেন্দ্রিক সক্ষমতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে তিনি বলেন, “গোষ্ঠীকেন্দ্রিক সক্ষমতার বেশি প্রয়োজন প্রান্তিক পর্যায়ের ও দরিদ্রদের। কারণ আপনি আমি যেখানে আছি, আমরা মত প্রকাশ করতে পারি, আমাদের একটি প্রভাব আছে, বন্ধু-বান্ধবী বলুন, রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারি।

“কিন্তু প্রান্তিক পর্যায়ে আছে, যাদের কথা বলার জায়গা নাই। সেখানে গোষ্ঠীগত সক্ষমতা তাদের মত প্রকাশের সুযোগ দেয়, ওই গোষ্ঠীর মধ্যে একজন ব্যক্তি বেশি দূর যেতে পারবে না। যে মুহূর্তে সে গোষ্ঠীগত পর্যায়ে যাবে সে কিছু করতে পারবে।”

গড়ের ভিত্তিতে কোনো সমীকরণ করা ঠিক নয় মন্তব্য করে সেলিম জাহান বলেন, গড় মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার বাস্তব চিত্র তুলে ধরে না।

“কারণ গড়ের মধ্যে বিভিন্ন রকমের দারিদ্র্য আছে, বঞ্চনা আছে সেটা ঠিকভাবে আসছে না। গড়ের বাইরে গিয়ে আমাদের উপাত্তগুলো বিভাজিত করে দিতে হবে।

“উপাত্তকে যদি বিভাজিত করি, তাহলে দেখব ঢাকার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের একটা পার্থক্য আছে, দক্ষিণবঙ্গের একটা পার্থক্য আছে। আবার বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্য আছে। সেজন্য ।”

দেশের উন্নয়নের জন্য তরুণদের দায়িত্বে আনার উপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, “আমার কেবল একটিই প্রার্থনা তরুণদেরকে জাতির বর্তমান করে দিন। তরুণদের জাতির বর্তমান করে যারা তরুণ নন, তারা একটু পেছনে সরে যান। এটা যদি আপনারা করতে পারেন, তাহলে দেখবেন উন্নয়ন। আগামী দিনের অগ্রাধিকার, আগামী দিনে কোথায় যেতে হবে, সেটা ঠিক হয়ে যাবে।”

সেলিম জাহান ১৯৯২ সালে ইউএনডিপিতে যোগ দেওয়ার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন।

কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এই প্রভাষক একই সময়ে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং ফেলো এবং যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব পাবলিক পলিসি’র ভিজিটিং স্কলার ছিলেন।

জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয়ের উপপরিচালক হিসেবে ১৯৯৩ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত নয়টি বৈশ্বিক মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন প্রণয়নের ‘কোর টিমের’ সদস্য ছিলেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন অধ্যাপক এ জে এম শফিউল আলম ভূঁইয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের চেয়ারপার্সন অধ্যাপক আমিনুল হক। বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মঈনুল ইসলাম অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন।