সরকারের ভ্যাট ব্যর্থতায় ৩ কারণ: সিপিডি

নতুন বাজেটে ভ্যাট আইন কার্যকর করতে না পারার পেছনে সরকারের কারিগরি ‘প্রস্তুতির অভাব’, রাজনৈতিক ‘ঐকমত্যের অভাব’ এবং সামাজিক প্রভাব ‘অনুধাবন করতে না পারাকে’ তিন প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 July 2017, 01:57 PM
Updated : 10 July 2017, 01:58 PM

সোমবার ‘জাতীয় বাজেট ২০১৭-১৮ অনুমোদন পরবর্তী পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এই কারণগুলো তুলে ধরে ভ্যাটের ঘাটতি পুষিয়ে নিতে সরকারকে একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে বাজেট বাস্তবায়নে হাত দেওয়ার পরামর্শ দেন। 

তিনি বলেন, “এই তিনটি কারণেই এবার ভ্যাট আইন কার্যকর হতে পারেনি। আমরা নতুন ভ্যাট আইনের পক্ষে ছিলাম। আমরা সর্বদা বলেছি এটি একটি আধুনিক প্রগতিশীল পদ্ধতি। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে কর আহরণ ও সমতা সৃষ্টির সুযোগ বাড়বে।”

ভ্যাটের পক্ষে থাকলেও এর হার নিয়ে সরকারের সঙ্গে দ্বিমত ছিল সিপিডির। এই গবেষণা সংস্থার মত ছিল, সব ক্ষেত্রে অভিন্ন ১৫ শতাংশ হারে মূল্য সংযোজন কর আদায় করলে তা ‘অতিরিক্ত’ হয়ে যাবে। এই হার ১২ শতাংশ করার প্রস্তাব ছিল তাদের।

দেবপ্রিয় বলেন, “আমাদের সেই কথা যদি শোনা হত, কারিগরি প্রস্তুতি শেষ করে যাওয়া হত, তাহলে আমাদের ধারণা ভ্যাট আইনের এই পরিণতি নাও হতে পারত।”

সিপিডির দৃষ্টিতে তিন কারণ-

১. ভ্যাট আইন কোথায় প্রয়োগ করা হচ্ছে, কার উপরে কী প্রভাব পড়ছে- তার সামগ্রিক চিত্র স্পষ্ট ছিল না। ভ্যাট আদায়ের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রস্তুতিও কম ছিল।

২. যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ভ্যাটের সঙ্গে যুক্ত, বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে ঐকমত্য ছিল না।

৩. ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হলে ভোক্তার জীবনযাত্রায় যে প্রভাব পড়বে, তার সামাজিক তাৎপর্য বিবেচনা করা হয়নি। যে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও দক্ষতা এক্ষেত্রে দেখানোর প্রয়োজন ছিল, তার অভাব দেখা গেছে।

নতুন ভ্যাট আইন অনুযায়ী ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায়ের পরিকল্পনা রেখে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য ৪ লাখ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

বিশাল এই বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা, যার মধ্যে ভ্যাট থেকে ৯১ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা আসবে বলে ধরেছিলেন মুহিত।

কিন্তু ব্যাপক সমালোচনার মুখে ভ্যাট আইন কার্যকর দুই বছর পিছিয়ে দিতে বলেন সরকার প্রধান শেখ হাসিনা। ফলে মুহিতের বাজেট বাস্তবায়ন বড় ধরনের ধাক্কার মধ্যে পড়েছে।

ঢাকার ব্র্যাক সেন্টার ইনে সিপিডির সংবাদ সম্মেলনে দেবপ্রিয় বলেন, ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন না হওয়ায় সরকারের আয় প্রত্যাশার চেয়ে কমে যাবে। সেক্ষেত্রে তিনটি সম্ভাব্য চিত্রকল্প ভাবা যেতে পারে।

প্রথমটি হল- বাজেট অনুযায়ীই আয়-ব্যয় হবে, লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ হবে। দ্বিতীয়টি হল- বাজেটে আয় কম হলেও ব্যয় কম হওয়ায় ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আর তৃতীয়টি হল- কম আয়ের বিপরীতে ব্যয় বেশি হবে; ফলে বাজেট ঘাটতি বৃদ্ধি পাবে এবং সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বেড়ে যাবে।

পরিস্থিতি যদি তৃতীয় চিত্রকল্পের মত হয়, তাহলে দুটি সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন দেবপ্রিয়।

বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি বাড়ানো গেলে বৈদেশিক অর্থায়ন বেশি হতে পারে; সেক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ কম থাকবে।

আবার বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পের বাস্তবায়ন কম হলে, সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পের বাস্তবায়ন বেশি হলে বেশি অর্থের প্রয়োজন হবে। তখন অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাবে।

এমন পরিস্থিতিতে বাজেট বাস্তবায়েনে সরকারের জন্য কিছু পরামর্শ তুলে ধরা হয় সিপিডির সংবাদ সম্মেলনে।

দেবপ্রিয় বলেন, “সরকারকে একটি কর্ম পরিকল্পনা বানাতে হবে। এটা শুধু ভ্যট আইন বাতিল হয়েছে বলে নয়, সামষ্টিক অর্থনীতিতে যেসব পরিবর্তন এসেছে, যেমন রেমিট্যান্স, রপ্তানি ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, এগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যও সরকারকে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।”

এজন্য অর্থনীতির স্থিতিশীলতাকে রক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা এবং কর্মসংস্থান বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।

সিপিডির এই ফেলো বলেন, ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন না হওয়ায় আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট এক শতাংশের মত কম আদায় হতে পারে বলে তারা প্রাক্কলন করে দেখেছেন। আর অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে সম্পূরক শুল্ক প্রয়োগে আয় কিছুটা বাড়তেও পারে।

ভ্যাটের ঘাটতি পোষাতে প্রত্যক্ষ কর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বহির্ভূত কর আদায় বাড়ানোর ওপর জোর দিতে এবং কর বহির্ভূত রাজস্ব আদায় বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয় সিপিডির পক্ষ থেকে।

দেবপ্রিয় বলেন, “ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করা যায়নি বলে এর বাস্তবায়ন যেন বন্ধ করে না দেওয়া হয়। বরং অনলাইন প্রকল্প চালু রেখে ব্যক্তি খাতে কর আদায় বাড়াতে হবে।”

তিনি বলেন, সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নিয়ে সরকার এক ধরনের ‘দায়ের ভার সৃষ্টি করছে’, এটা রাজস্ব আয়ের একটি বড় অংশ খেয়ে ফেলছে। তাই কম সুদে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যাংকিং খাত সেই উৎস হতে পারে।

ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন না হওয়ায় অর্থের উৎস বের করতে এনবিআরের মামলা নিষ্পত্তির হার বাড়ানোর পাশাপাশি মোবাইল ফোনের যে ফোরজি লাইসেন্সের নিলাম হবে, সেখান থেকে সর্বোচ্চ আয় নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন দেবপ্রিয়।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশে করযোগ্য মানুষের এক তৃতীয়াংশও কর দেয় না। সুতরাং একটি লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে আয়কর বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা হোক। এলাকা ও পেশার ভিত্তিতে এটা করা হোক।”

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুনের সঞ্চালনায় অন্যদের মধ্যে সিপিডির সম্মানিত ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, রিসার্চ ফেলো খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ও তৌফিকুল ইসলাম খান উপস্থিত ছিলেন।