এখন চাল আমদানিতে মরিয়া সরকার

মজুদ তলানিতে নেমে আসার পর চাল আমদানি করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে সরকার, যে কাজটি আগেই করা উচিৎ ছিল বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন।

আবদুর রহিম হারমাছিও শহীদুল ইসলামবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 June 2017, 04:32 PM
Updated : 19 July 2017, 11:54 AM

আমদানির দরপত্র আহ্বানের পর বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি বাড়াতে শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে এক লাফে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় মঙ্গলবার।

এদিন ৫০ হাজার টন চাল আমদানির জন্য দরপত্রও আহ্বান করেছে খাদ্য অধিদপ্তর। আগের দিন প্রথম দফায় (প্যাকেজ-১) আহ্বান করা ৫০ হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানির জন্য একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সই করে অধিদপ্তর। এক মাসের মধ্যেই এই চাল ভিয়েতনাম দেশে আসবে বলে আশা করছে সরকার।

দ্বিতীয় দফায় (প্যাকেজ-২) দরপত্র আহ্বান করা ৫০ হাজার টনের আমদানির চুক্তি ঈদের আগেই করা হবে বলে জানান খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বদরুল হাসান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকার প্রাথমিক পর্যায়ে যে ৬ লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারমধ্যে ২ লাখ টনের টেন্ডার ইতোমধ্যেই আহ্বান করা হয়েছে। বাকি ৪ লাখ টনের দরপত্র জুলাই মাসের মধ্যেই আহ্বান করা হবে।”

প্রয়োজন পড়লে ৬ লাখের বাইরে আরও চাল আমদানি করা হবে, বলেন খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।

আমদানির প্রথম চালান কবে আসবে- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ৪০ দিনের মধ্যে সেই চাল আমাদের কাছে হস্তান্তর করার কথা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের। আমরা আশা করছি, তার আগেই এক মাসের মধ্যে এই চাল আমাদের কাছে আসবে।”

সে হিসাবে জুলাই মাসের শেষের দিকেই আমদানি করা প্রথম চালান দেশে আসবে বলে জানান বদরুল হাসান।

খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি পর্যায়ে চাল আমদানির জন্য প্রথম দরপত্রটি আহ্বান করা হয় ৮ মে। পরের তিনটি দরপত্র আহ্বান করা হয় যথাক্রমে ১৪ মে, ২৯ মে ও ২০ জুন।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ১৬ জুন শেষে সরকারি গুদামে ৪ লাখ ৮৬ হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্য মজুদ আছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৮১ হাজার টন চাল এবং ৩ লাখ ৫ হাজার টন গম।

গত বছরের এই সময়ে সরকারি গুদামে ৯ লাখ ৮০ হাজার টন খাদ্যশস্য মজুদ ছিল। এর মধ্যে ছিল ৬ লাখ ৪ হাজার টন চাল এবং ৩ লাখ ৭৬ হাজার টন গম।

হাওরে নষ্ট হয়েছে এবার কৃষকের ধান

কিন্তু এবার বোরো মৌসুমে আগাম বন্যায় সরকারি হিসাবেই হাওরে ছয় লাখ টনের মতো ধান নষ্ট হওয়ায় এবং খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে (১০ টাকা কেজি দরের চাল) সাড়ে সাত লাখ টন চাল বিতরণ করায় সরকারি মজুদ কমে আসে।

বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য চালের দাম গত কয়েক মাস ধরে বাড়তে থাকায় কষ্টে আছে সাধারণ মানুষ। সরকারি হিসাবে গত এক বছরে মোটা চালের দাম বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ।

চালের দরের ঊর্ধ্বগতিতে নানা মহল থেকে আলোচনা উঠেছে। চালের বাজার সহনীয় করতে বিরোধীদলীয় নেতা থেকে শুরু করে সরকারি দলের সদস্যরাও সংসদে দাবি তুলেছেন।

এই পরিস্থিতিতে বাজার সহনীয় করতে আমদানির যে উদ্যোগ সরকার নিয়েছে, তা আরও আগেই নেওয়া উচিৎ ছিল বলে মন্তব্য করেছেন কৃষি অর্থনীতিবিদ এম আসাদুজ্জামান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকারের গুদাম গুলোতে চালের মজুদ কমে গিয়েছিল জেনেই মিল মালিক ও আড়াতদাররা সিন্ডিকেট করে চালের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে দাম বাড়িয়ে দিয়েছিল।”

আমদানি শুল্ক কমানোর ফলে বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি বেড়ে গেলে তার প্রভাব বাজারে পড়বে বলে আশা করেন আসাদুজ্জামান।

“সরকারের আমদানির খবরে সিন্ডিকেটও তাদের মজুদ করা চাল বাজারে ছেড়ে দেবে। ধীরে ধীরে বাজার স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে মনে হচ্ছে।”

বাজারে চালের দাম নিয়ে অসন্তুষ্ট ক্রেতারা

সরকারের এসব পদক্ষেপে চালের দর দ্রুতই কমে আসবে বলে আশা করছেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদও।

চালের বাজারে এই অস্থিরতার জন্য তিনিও ‘ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকে’ দায়ী করছেন।

তোফায়েল মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, “দেশে চালের কোনো সঙ্কট নেই। কিন্তু মিল মালিকরা সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়িয়েছে।”

‘কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী’ সরকারকে সহযোগিতা করেনি বলেও জানান তিনি।

চালের সঙ্কট হবে না বলে দাবি করেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আতাউর রহমান (সংগ্রহ ও সরবরাহ)।

তিনি মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দেশে এবার ১ কোটি ৯০ লাখ টন বোরো উৎপাদন হয়েছে। সামনে আউশ কাটা হবে, এর সবই (চাল) তো বাংলাদেশের ভেতরে কারও না কারও কাছে আছে বা থাকবে।

“সে কারণেই আমরা বার বার বলছি, দেশে চালের কোনো সঙ্কট নেই। ব্যবসায়ী-মিল মালিকরা কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।”

শুল্ক কমায় দাম কমবে ‘৬ টাকা’

আমদানি শুল্ক কমানোয় চালের বাজার দর কেজিতে ৬ টাকা কমবে বলে মনে করেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল।

সন্তোষজনক বাড়তি মজুদ থাকায় আমদানি নিরুৎসাহিত করতে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে চালের শুল্কহার ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করেছিল সরকার। এর সঙ্গে রেগুলেটরি ডিউটি তিন শতাংশ যোগ হওয়ায় ব্যবসায়ীদের ২৮ শতাংশ শুল্ক গুণতে হত।

আমদানির প্রধান পথ চট্টগ্রাম বন্দর

ফলে গত দেড় বছর ধরে বেসরকারি পর্যায়েও চাল আমদানি প্রায় বন্ধ ছিল।

এখন বাজারের অস্থিরতায় লাগাম দিতে রেগুলেটরি ডিউটি তুলে নিয়ে আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হল।

মঙ্গলবার সচিবালয়ে এক কর্মশালার শুরুতেই বাণিজ্যমন্ত্রী সরকারের এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। আজকালের মধ্যে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।”

সব মিলিয়ে ১৮ শতাংশ শুল্ক কমানোর ফলে প্রতি কেজি চালের দাম কমপক্ষে ৬ টাকা কমবে বলে ধারণার কথাও জানান তিনি।

আমদানি শুল্ক কমানোয় বাজারে চাল নিয়ে যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছিল, তা দ্রুত কেটে যাবে বলে আশা করছেন খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বদরুল হাসানও।

“মোট কথা সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে চাল নিয়ে বাজারে যে প্যানিক সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা চলে যাবে।”

সঙ্কট মোকাবেলায় ব্যবসায়ীদের চাল আমদানিতে বিনা মার্জিনে ঋণপত্র খোলার সুযোগও দিয়েছে সরকার।